১.
একটি প্রচলিত কৌতুক দিয়ে শুরু করি।
আকাশে উড়ন্ত বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। বিমানে যাত্রী মোট চারজন। একজন পাইলট, একজন রাজনৈতিক নেতা, একজন শিক্ষক, অপরজন ছাত্র। কিন্তু বিমানে প্যারাসুট আছে তিনটি! একটা প্যারাসুট নিয়ে পাইলট বললেন, ‘আমি লাফিয়ে পড়ছি, আমাকে তাড়াতাড়ি রিপোর্ট করতে হবে যে বিমান ক্রাশ করছে।’ রাজনৈতিক নেতা একটি প্যারাসুট নিয়ে বললেন, ‘দেশ ও জাতির জন্য আমার অনেক কিছুই করার এখনো বাকি। তাই আমার বেঁচে থাকা দরকার।’
পাঠক, নিশ্চয়ই ধরতে পারছেন এ রাজনৈতিক নেতা বাংলাদেশি ছাড়া আর কে হবেন। দেশের সব রাজনৈতিক নেতাই যে এমন তা বলছি না। এটিও তো ঠিক, আমাদের অনেক রাজনৈতিক নেতাও আছেন যারা দেশ ও দশের জন্য রাজনীতি করার কথা বলে গলা ফুলিয়ে ফেললেও বিপদে আগেই সরে পড়েন। নিজের দলের কর্মীদেরও বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে পালাতে একমুহূর্ত দেরি করেন না।
তবে কৌতুকটি এখানেই শেষ নয়। বাকি আছেন শিক্ষক ও এক ছাত্র। শিক্ষক বললেন, প্যারাসুট তো আছে আর একটা। এখন কী হবে? ছাত্র বলল, চিন্তা নেই স্যার। প্যারাসুট দুইটিই আছে। ওই নেতা ব্যাটা প্যারাসুট মনে করে আমার স্কুলব্যাগ নিয়ে ঝাঁপ দিয়েছে। এতক্ষণে নির্ঘাত অক্কাও পেয়েছেন। শিক্ষকের প্রাণে পানি এল। তাঁরা শুধু বাঁচার উপায় পেয়েই আনন্দিত হলেন না, নেতার করুণ পরিণতি দেখেও যেন ‘নিষ্ঠুর আনন্দ’ পেলেন। কেনই–বা পাবেন না?
২.
একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে। স্বাভাবিকভাবেই কেউ মনোনয়ন পাবেন, কেউ পাবেন না। এতে কেউ হতাশ হবেন, কেউ উল্লসিত হবেন—এটিই তো স্বাভাবিক। শুধু তা–ই নয়, আরও একটা ‘স্বাভাবিক’ প্রতিক্রিয়াও এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়েছে। তা হচ্ছে মনোনয়নবঞ্চিত হলে সড়ক অবরোধ করা, ধর্মঘট-হরতাল ডাকা, ভাঙচুর করা, আগুন জ্বালানো ইত্যাদি ইত্যাদি।
হ্যাঁ, আরও একটা ‘স্বাভাবিক’ ঘটনাও আছে। মনোনয়ন পাওয়ার পর বঞ্চিত পক্ষের ওপর হামলে পড়া। এটিই তো দেখলাম গতকাল সোমবার দেশে বর্তমান বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রার্থিতা ঘোষণার পর।
আমরা সংস্কার সংস্কার বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি ঠিকই, কিন্তু গাছের গোড়াতে পানি ঢালার কথা কেউ বলছি না, বললেও সেটি খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। গাছের গোড়ার পানি ঢালার বিষয়টা কী? যারা রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার সংস্কার আনবে, তাদের ভেতরেই সংস্কারটা আগে হতে হবে। এর জন্য জরুরি হচ্ছে, মন ও মগজে সংস্কার আনা। সেটিই যদি করা না যায়, প্রায় তিন হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের বলে যাওয়া সেই উক্তিই সঠিক হয়—গণতন্ত্র হচ্ছে মূর্খ ও অযোগ্যদের শাসন।
সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ-আশাশুনি আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য মনোনয়ন না পাওয়ার প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার অর্ধদিবস হরতাল ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছেন তাঁর কর্মী-সমর্থকেরা। অথচ এ দেশে হরতালের রাজনীতি বহু আগেই আবেদন হারিয়ে ফেলেছে, সেটি তাদেরই সবার আগে বোঝার কথা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে। ফলে এ হরতাল জন-স্বতঃস্ফূর্তামূলক ছিল না। যার যার ব্যস্ততা নিয়েই মানুষ কাজেকর্মে যোগ দিতে ঘর থেকে বের হয়েছে। কিন্তু মনোনয়নবঞ্চিত নেতার সমর্থকেরা জোরপূর্বক হরতাল পালন করতে গিয়ে সড়ক অবরোধ করে যে চরম যানজট তৈরি করলেন, তাতে হাজার হাজার মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হলো।
গতকাল সন্ধ্যায় প্রার্থিতা ঘোষণার পরপরই দ্রুত প্রতিক্রিয়াটা আসে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড আসন থেকে। সে আসনে বিএনপির এক সাবেক যুগ্ম মহাসচিবকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তাঁর বিক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকেরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
ঢাকা-চট্টগ্রামের যোগাযোগের লাইফলাইনখ্যাত দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক আটকে দেওয়া হয়। এতে দীর্ঘ যানজট ছড়িয়ে মহাসড়কের দুই পাশে, এমনকি এর প্রভাব পড়ে চট্টগ্রাম শহরের ভেতরেও। শুধু তা–ই নয়, মনোনয়নবঞ্চিত নেতার ক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকেরা ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনও অবরোধ করেন।
একইভাবে মনোনয়ন না পেয়ে কুষ্টিয়া সদর আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্যের অনুসারীরা, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা আসনের জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির এক যুগ্ম আহ্বায়ক, মেহেরপুরের গাংনী আসনে জেলা বিএনপির সভাপতির অনুসারীরাও এমন বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সাধারণ মানুষের ওপর নিজেদের বঞ্চনার ‘শোধ’ তুলতে রাস্তায় নেমে গেছেন। দেশের আরও আরও জায়গায় এমনটি ঘটেছে।
কথা হচ্ছে, এই যে সন্ধ্যার পর ঘরফেরত বা সকালে কর্মস্থলে যাওয়া মানুষকে তাঁরা চরম দুর্ভোগে ফেললেন কেন? তাঁরা মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন এর দায় কি সাধারণ মানুষের? এখানে ‘তাঁরা’ বলতে নিশ্চয়ই দলের সাধারণ কোনো কর্মী-সমর্থক নন। সংবাদমাধ্যমগুলো খুলে দেখেন, বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারীরা জেলা-উপজেলার বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা। মনোনয়নবঞ্চিত নেতার ‘ইশারা’ ছাড়া এসব বিক্ষোভ হয়, তা কি কেউ বিশ্বাস করবে? দলের সিদ্ধান্ত আশানুরূপ না হতেই পারে, এর জন্য প্রতিবাদও হবে। ‘মানি না, মানব না’ বলে দলের কেন্দ্রীয় অফিস ঘেরাও করুক। দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে জবাবদিহি চাক। কিন্তু সেটি ব্যস্ততম রাস্তা অবরোধ করে কেন?
গণতন্ত্র নিয়ে আরেকটি কৌতুক মনে পড়ল। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম ক্লাসে শিক্ষক নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাইলেন: তোমরা গণতন্ত্র বলতে কী বোঝো? এক শিক্ষার্থী জবাব দিলেন: গণতন্ত্র হলো এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে মানুষ তাঁর পছন্দের প্রতিনিধিকে বেছে নেন, আর তারা মানুষের পছন্দের কাজ করে না।
৩.
লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠকের মধ্য দিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষিত হয়। তখন থেকে অপেক্ষা কখন বিএনপি কাকে মনোনয়ন দিচ্ছে, কাকে দিচ্ছে না।
এদিকে জামায়াত নির্বাচনের জন্য নিম্নকক্ষে পিআর চালুর জন্য আলটিমেটাম দিয়ে মাঠ গরম করলেও দেশজুড়ে নিজেদের সব আসনে ঠিকই প্রার্থিতা নিশ্চিত করে ফেলেছে। দু–একটা জায়গায় অসন্তোষ দেখা দিলেও তাদের সাংগঠনিক কাঠামোগত অনুশীলন বা চর্চার কারণে সবাই দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় নেমেও গেছেন। ফলে বিএনপি নির্বাচনের প্রস্তুতিতে পিছিয়ে পড়ছে, এটিই ছিল অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের পর্যবেক্ষণ।
নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা বা বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে বাধা দেওয়ার নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্বমূলক আলোচনার মধ্যে একটাই প্রশ্ন ছিল—বিএনপির যদি নির্বাচন নিয়ে এতই আশঙ্কা থাকে, তাহলে সরকারের ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী তারা কেন দ্রুত নির্বাচনী প্রস্তুতিতে নেমে পড়ছে না। জামায়াতকে কেন তারা এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে?
বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতি নামা দেরি দেখে আবার কারও কারও বক্তব্য ছিল, প্রার্থিতা ঘোষণার আগে মনোনয়নবঞ্চিতরা যে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, সেটি সামলানোর প্রস্তুতিতে আছে দলটি। নির্বাচনের প্রার্থিতা নিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে কয়েক মাস ধরে দেশের অনেক উপজেলায় সহিংসতায় বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, প্রার্থিতা ঘোষণার পর কী না ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হয়! বলতেই হবে, প্রার্থিতা ঘোষণার পর বড় কোনো ধরনের সংঘাত এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। এটি অবশ্যই স্বস্তিদায়ক। তবে নির্বাচনের ক্ষণ আরও ঘনিয়ে এলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে, যখন কোথাও কোথাও বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়ে যাবেন। ফলে সংঘাতের আশঙ্কাটা এখনই পুরোপুরি শেষ হচ্ছে না। তখনো কি আমরা রাজনীতির নামে মানুষের দুর্ভোগ দেখব?
৪.
গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের চিল্লাফাল্লার শেষ নেই। একাত্তর গেল, নব্বই গেল, চব্বিশও পার হলো। আর কত ত্যাগ ও সংগ্রামের পর প্রকৃত গণতন্ত্রের দেখা পাব আমরা? তাহলে কি গণতন্ত্র নিজেই কোনো সমস্যা, এমন প্রশ্নও যে উঠে না, তা নয়। কিন্তু গণতন্ত্র বলতে তো আমরা এটিই বুঝি—যেখানে জনগণ সুশাসন পাবে। নাগরিক অধিকারপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকবে। নাগরিকদের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকবে।
কিন্তু একটি রাষ্ট্রে যারা এই অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা করবে, সেই রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেই তো গণতন্ত্রের চর্চা নেই। দলের সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে তার জন্য জনগণকে ‘শাস্তি’ দেওয়া তো গণতন্ত্রের চর্চা হতে পারে না না।
আমরা সংস্কার সংস্কার বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি ঠিকই, কিন্তু গাছের গোড়াতে পানি ঢালার কথা কেউ বলছি না, বললেও সেটি খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না।
গাছের গোড়ার পানি ঢালার বিষয়টা কী? যারা রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার সংস্কার আনবে, তাদের ভেতরেই সংস্কারটা আগে হতে হবে। এর জন্য জরুরি হচ্ছে, মন ও মগজে সংস্কার আনা। সেটিই যদি করা না যায়, প্রায় তিন হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের বলে যাওয়া সেই উক্তিই সঠিক হয়—গণতন্ত্র হচ্ছে মূর্খ ও অযোগ্যদের শাসন।
আরেকটি কৌতুক দিয়ে শেষ করি।
এক জনপ্রিয় নেতা জনসভায় বক্তৃতা দেবেন। সামনে লোকে লোকারণ্য। তা দেখে এক সাংবাদিক ওই নেতাকে বললেন, ‘আপনি বক্তৃতা দেবেন শুনলেই লোকজন ছুটে আসে—ময়দান ভরে যায়। এতে আপনার কেমন লাগে?’
নেতা বললেন, ‘ভালোই তো লাগে। গর্বে বুক ভরে যায়। কিন্তু তখনই আমি আরেকটা কথা ভাবি।’
‘কী ভাবেন?’
‘ভাবি যে এটা আমার বক্তৃতার মঞ্চ না হয়ে যদি আমার ফাঁসির মঞ্চ হতো, তাহলে এর তিন গুণ লোক জমায়েত হতো।’
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই-মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব