বাঙালি ও জাপানি—দুই মায়ের লড়াই

দুই মা। একজন বাঙালি, আরেকজন জাপানি। দুই মায়ের নাগরিকত্ব ভিন্ন, সামাজিক মর্যাদা ভিন্ন। অর্থনৈতিক অবস্থা ভিন্ন। তারপরও একটা জায়গায় মিল আছে, সন্তানের জন্য তাঁদের সংগ্রাম। দুই মাকে দুই ধরনের সংগ্রাম করতে হয়েছে, হচ্ছে।

প্রথমে আসি বাঙালি মায়ের কথায়। তাঁর বাড়ি বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও। তিনি কন্যাকে একাই লেখাপড়া শেখান। বাবা খোঁজখবর নিতেন না। কন্যা যখন নবম শ্রেণিতে ওঠে, শিক্ষা বোর্ডে নিবন্ধনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু মা সন্তানের নিবন্ধন করতে গেলে স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, অভিভাবক হিসেবে বাবার নাম ব্যবহার করতে হবে। যে বাবা কন্যার স্বীকৃতি দেননি, সেই বাবার নাম বসাতে রাজি হননি মা। সে সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে বাবার নাম লেখা বাধ্যতামূলক ছিল।

২০০৭ সালের ২৮ মার্চ ‘বাবার পরিচয় নেই, বন্ধ হলো মেয়ের লেখাপড়া’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। শিক্ষার্থীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘আমিও শুনেছি, আমার বাবা কে। তারপরও আমি বাবার নামটি রেজিস্ট্রেশন ফরমে লিখতে পারিনি। কারণ, ওই লোকটি আমার মা ও আমাকে স্বীকৃতি দেননি। আমাকে সবাই বলেছিল চুপ করে ওই লোকটির নাম লিখে দিতে। আমি লিখিনি। আমার রেজিস্ট্রেশন কার্ডও আসেনি। সেই সঙ্গে অ্যাডমিট কার্ডও এল না। আমি এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারলাম না।’

এই অনুভূতি যে কত কষ্টের, কত বেদনার  তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেন না। কবির ভাষায়, ‘কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে’। প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি যুক্ত করে ব্লাস্ট, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও নারীপক্ষ ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতে যে রিট করেছিল, তারই চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হয় ২৪ জানুয়ারি। বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায়ে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর তথ্যসংক্রান্ত ফরম পূরণের ক্ষেত্রে বাবা এবং মায়ের নাম লেখার যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা এখন আর থাকছে না। বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবক—এই তিনটির যেকোনো একটি লিখলেই চলবে।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে অনারারি নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, লৈঙ্গিক বৈষম্যমূলক চর্চা দূর করতে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির পরিচয় ও শিক্ষার অধিকারের স্বীকৃতিকে এগিয়ে নিতে হাইকোর্টের এ রায় গুরুত্বপূর্ণ।

যুগ যুগ ধরে সমাজে যে পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য চলে আসছে, উচ্চ আদালতের এই রায় তারও সমুচিত জবাব বলে মনে করি। এর মাধ্যমে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে বাবার অনুপস্থিতিতে মায়ের একক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।

এই যুগান্তকারী রায়ের পর প্রথম আলো ঠাকুরগাঁওয়ের সেই সংগ্রামী মাকে খুঁজে বের করে। হাইকোর্টের রায়ের বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন, এখন তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। কেন এই কষ্ট, তা কখনো জানতে চায়নি পাথরমন সমাজ। নিবন্ধন না হওয়ায় মেয়েটির লেখাপড়াই বন্ধ হয়ে যায়।

আরও পড়ুন

উচ্চ আদালতের রায় পেতে লেগেছে ১৪ বছর। রায়টি এক-দুই বছরের মধ্যে হলে মা হয়তো মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারতেন। এ ঘটনা আমাদের বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার একটি দৃষ্টান্তও বটে। যে বিদ্যালয়ে মেয়েটি পড়াশোনা করত, সেই বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষককেও প্রথম আলো খুঁজে বের করে। তিনিও তাঁর মনোবেদনার কথা জানান।

আমরা যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে শিক্ষার্থীর অভিভাবক হিসেবে বাবার নাম লেখা ছিল বাধ্যতামূলক। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার বাবার সঙ্গে মায়ের নাম লেখাও বাধ্যতামূলক করে। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধনসহ  অনেক ক্ষেত্রে। অর্থাৎ সন্তানের প্রতি বাবা-মা উভয়ের সমানাধিকার আছে। হাইকোর্টের রায় মায়ের অধিকারের পাশাপাশি আইনগত অভিভাবকের কথাও উল্লেখ করেছেন। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনবিষয়ক আইনের ২০১৮ সালের বিধিমালা বলছে, ‘কোনো ব্যক্তি এতিম, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি, পিতৃ বা মাতৃপরিচয়হীন, পরিচয়হীন, বেদে, ভবঘুরে, পথবাসী বা ঠিকানাহীন বা যৌনকর্মী হওয়ায় নিবন্ধক তথ্যের ঘাটতির কারণে উক্ত ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যুনিবন্ধন প্রত্যাখ্যান করিতে পারিবেন না…।’ ওই আইনের সঙ্গে উচ্চ আদালতের রায়টি কেবল সংগতিপূর্ণ নয়, নির্দেশনামূলকও।

এ নিয়ে সাংবাদিক কুর্‌রাতুল-আইন-তাহমিনা একটি চমৎকার কলাম লিখেছেন, সোমবার প্রথম আলোয়। তাঁর এই লেখায়ও মায়েদের আরেক ধরনের সংগ্রামের কথা আছে।

সন্তানের প্রতি একজন মায়ের মমতা কত গভীর হলে তিনি শিশুসন্তানকে জাপানে আত্মীয়স্বজনের কাছে রেখে দুই মেয়েকে ফিরে পেতে বাংলাদেশে এসে মাসের পর মাস আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন, এরিকো তার প্রমাণ। শেষ পর্যন্ত তিনি সন্তানের অভিভাবকত্ব ফিরে পেয়েছেন। এ জন্য তাঁকে অভিবাদন। সেই সঙ্গে অভিবাদন জানাই ঠাকুরগাঁওয়ের বাঙালি মাকেও, যিনি মেয়ের অভিভাবকত্বের জন্য লড়াই করেছিলেন।

এবার আসি জাপানি মায়ের কথায়। এই মায়ের নাম এরিকো। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইমরানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় ২০০৮ সালের ১১ জুলাই। তাঁদের তিনটি মেয়ে আছে। ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি এরিকোর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন ইমরান। এরপর ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়েকে (বড় ও মেজ) নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি। ছোট মেয়ে জাপানে মায়ের কাছে ছিল।

এরপরই মা এরিকোর সংগ্রাম শুরু হয়। ইমরানের কাছ থেকে দুই মেয়েকে ফিরে পেতে ঢাকায় এসে ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। অন্যদিকে ছোট মেয়েকে ফিরে পেতে পৃথক একটি রিট করেন ইমরান। পৃথক রিটের ওপর শুনানি নিয়ে দুই শিশু তাদের বাবা ইমরানের হেফাজতে থাকবে বলে ওই বছরের ২১ নভেম্বর হাইকোর্ট আদেশ দেন। এ আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন এরিকো, যা চেম্বার আদালত হয়ে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে। এরিকোর করা আবেদন (লিভ টু আপিল) নিষ্পত্তি করে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। আদেশে বলা হয়, ঢাকার পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাটি (২০২১ সালে শিশুদের বাবার করা) নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জাপান থেকে আসা দুই শিশু তাদের মায়ের হেফাজতে থাকবে। তবে শিশুদের বাবা তাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন।

আরও পড়ুন

এরপরও অনেক ঘটনা ঘটে। জাপানি মা সন্তানদের নিয়ে জন্য বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। বাবাও মাঝে মধ্যে মেয়েদের দেখতে যেতেন।  প্রায়ই গণমাধ্যমে এরিকো, ইমরান ও তাঁদের সন্তানদের নিয়ে পত্রিকা–টিভিতে প্রতিবেদন হতো।  স্বামী-স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে। কিন্তু তাঁদের সেই বিচ্ছেদ সন্তানদের ওপর যাতে কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে সেটা অবশ্যই তাদের দেখা উচিত। বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জানানোর এক মাসের  দুই মেয়েকে নিয়ে ইমরানের দেশে আসার ঘটনাও  স্বাভাবিক ঘটনা নয়। সন্তানের ওপর মা ও বাবা উভয়ের অধিকার আছে।  এরিকোকে না জানিয়ে তিনি সন্তানদের দেশে নিয়ে আসতে পারেন না। তা-ও আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে!

জাপান থেকে আসা দুই শিশুর হেফাজত ও অভিভাবকত্ব চেয়ে ইমরান ঢাকার পারিবারিক আদালতে যে মামলা করেছিলেন, সেই মামলারই রায় পাওয়া গেল রোববার। সাক্ষ্য গ্রহণ ও দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান মামলাটি খারিজ করে দেন। এর অর্থ শিশু দুটি এখন তাঁদের মায়ের হেফাজতে থাকবে। মা তার অধিকার ফিরে পেলেন।

এর আগে এরিকো নাকানো বলেছিলেন, ‘২০২১ সালের জুলাইতে বাংলাদেশে এসেছি, আমার বাচ্চাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছিলাম। কারণ, তাদের বাবা ইমরান শরীফ জাপান থেকে আমাকে না বলে পালিয়ে তাদের নিয়ে এসেছে। আপিল বিভাগ আমাকে বাচ্চাদের প্রবেশনাল কাস্টডি দেয়। মামলাটি (পারিবারিক আদালতে থাকা) তিন মাসের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়। তিনটি সন্তানের মধ্যে একটি বাচ্চাকে জাপান ফেলে এসেছি, দুটি বাচ্চার জন্য লড়াই করছি। এ মামলার শেষ দেখতে পাচ্ছি না। তার মধ্যে আমার মা অনেক অসুস্থ, মৃত্যুশয্যায়। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির বিষয়টি বিবেচনা করতে আদালতকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’

সন্তানের প্রতি একজন মায়ের মমতা কত গভীর হলে তিনি শিশুসন্তানকে জাপানে আত্মীয়স্বজনের কাছে রেখে দুই মেয়েকে ফিরে পেতে বাংলাদেশে এসে মাসের পর মাস আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন, এরিকো তার প্রমাণ। শেষ পর্যন্ত তিনি সন্তানের অভিভাবকত্ব ফিরে পেয়েছেন। এ জন্য তাঁকে অভিবাদন। সেই সঙ্গে অভিবাদন জানাই ঠাকুরগাঁওয়ের বাঙালি মাকেও, যিনি মেয়ের অভিভাবকত্বের জন্য লড়াই করেছিলেন। তাঁর লড়াইয়ের সুফল তাঁর কন্যা না পেলেও উত্তর প্রজন্ম পাবে। এখন থেকে কোনো বিদ্যালয় বলতে পারবে না, শিক্ষার্থীর নিবন্ধনপত্রে বাবার নাম থাকতেই হবে। সেখানে বাবা ও মা, বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নামও থাকতে পারে।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি