আমরা যারা ‘মা’ নই, আইনি অভিভাবক

তার বয়স হয়তো তখন তিন বছর। তখন জীবনের অপূর্ব এক যোগসূত্রে আমি তার ‘মিতি-মা’ হলাম। মিতি আমার ডাকনাম।

আরও দু বছর পর আমি তার ‘মা’ হলাম। আলো হয়ে একটি নীল ফুল আমার জীবনে এল।

সে সঙ্গে করে এনেছিল শুধু ছোট্ট একটি ডাকনাম। যখন তার ভালো নাম খুঁজছি, ছোট্ট সেই জন নামের মধ্যে একটি নীল ফুল চাইল। স্বনির্বাচিত ফুলটি তাকে অপরাজেয়র পরিচিতি দিল।

ঢাকার একটি ব্যতিক্রমী স্কুলে একা-মা আমার মেয়ে হিসেবে সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেল। আদালতের পথ ঘুরে আরও পরে আমি তার আইনি অভিভাবকের স্বীকৃতি পেলাম। কিন্তু মুসলিম পারিবারিক আইনের ফেরে দাপ্তরিক দুনিয়ায় তার ‘মা’ হতে পারলাম না।

আমার অপরাজেয় নীল ফুল হয়ে গেল আমার ‘প্রতিপাল্য’। অন্যদিকে, তাকে নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলো পাইয়ে দেওয়ার জন্য আইনি অভিভাবক আমাকে প্রতিপদে বাড়তি পথ হাঁটতে হচ্ছে।

২৪ জানুয়ারি উচ্চ আদালত ২০০৯ সালে করা একটি রিট মামলায় রায়ে বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর তথ্যসংক্রান্ত ফরমে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবক-যেকোনো একজনের তথ্য দিলেই চলবে। আদালত শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সব শিক্ষাবোর্ডকে সেভাবে ফরমটি সংশোধন করতে বলেছেন।

স্বস্তি পাচ্ছি যে, মেয়ের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার নিবন্ধন এবং প্রবেশপত্র পাওয়ার জন্য আমাকে উদ্বিগ্ন হয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না। হয়তো।

হয়তো বলার কারণ, রায়ের নির্দেশনা দ্রুত ঠিকঠাক পালিত হতে হবে। মায়ের মনে তাই ভয় থেকেই যাচ্ছে।

তবে রায়টি আদালতে সুবিচার পাওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে, অন্তত এই ক্ষেত্রে। সেটা একটা বিরাট ভরসা। ‘আইনি অভিভাবক’ আমি তাই আদালতকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও নারীপক্ষকে, যাঁরা রিট আবেদনটি নিয়ে ১৪ বছর ধরে লড়েছেন।

একটা প্রশ্ন নতুন করে আমাকে পীড়িত করছে। বাবার নাম না থাকায় আমার মেয়েকে কেন সমাজের নানা পরিসরে প্রশ্ন ও খোঁটা শুনতে হবে, বঞ্চনার ঝুঁকিতে থাকতে হবে? রায়টি আমার মনে আরও প্রশ্ন আর দাবি ঠেলে তুলছে। মা শিশুকে গর্ভে ধারণ করেন। আমার মেয়েকে আমি মনের মধ্যে ধারণ করেছি। তবু আমি তাকে দত্তক নিয়ে তার মা হতে পারিনি। আমাদের সংবিধান কেন এটাসহ পারিবারিক জীবনে নারীর প্রতি গুরুত্বপূর্ণ বৈষম্যগুলো দূর করার কথা বলবে না?

‘মা’ আমি এই রায় দেওয়া আদালতকে এবং রিট আবেদনকারী প্রত্যেককে অনেক অনেক অনেক শুভকামনা জানাই। তাঁদের কল্যাণ হোক।

বছরখানেক আগে আমার মেয়ের স্কুল বদল করতে চাইলাম। অনলাইনে ভর্তি ফরম পূরণ করতে হবে। সেখানে বাবা-মা দুজনেরই নাম-তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। কেবল অভিভাবকের তথ্য দিলে ডিজিটাল প্রভু ফরমটি জমা নিল না।

আমি প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করে সমস্যা খুলে বললাম। তিনি অফলাইনে আমার ‘প্রতিপাল্য’কে ভর্তি করার ব্যবস্থা করলেন। তাঁর প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ।

মনে পড়ছে, আমার মেয়ের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষার প্রবেশপত্রে ‘মা’ হিসেবে আমার নাম ছিল। ‘বাবা’র ঘরটি খালি ছিল।

আমি আগে একদিন পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে প্রধান শিক্ষককে পরিস্থিতি খুলে বলে অনুরোধ করেছিলাম, এ বিষয়ে কেউ যেন মেয়েকে কোনো প্রশ্ন না করেন। দায়িত্ববান মানুষটি কথা দিয়েছিলেন এবং রেখেছিলেন।

আমি তবু মেয়েকে বলে রেখেছিলাম, দৈবাৎ কেউ প্রশ্ন করলে সে যেন প্রশ্নকারীকে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলে। পরীক্ষার পুরোটা সময় গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম।

কেবল তো শিক্ষার অধিকার নয়, অধিকারের দাবি জীবনজুড়ে। আইনি অভিভাবকত্ব পাওয়ার পর আমি তার জন্মনিবন্ধন করালাম। সেটা অফলাইনের যুগ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে গেলাম। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংবেদনশীল কর্মকর্তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী বাবা-মার তথ্য ‘অপ্রাপ্য’ লিখে তার জন্ম নিবন্ধিত করে দিলেন।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনবিষয়ক আইনের ২০১৮ সালের বিধিমালা বলছে, ‘কোন ব্যক্তি এতিম, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি, পিতৃ বা মাতৃপরিচয়হীন, পরিচয়হীন, বেদে, ভবঘুরে, পথবাসী বা ঠিকানাহীন বা যৌন কমী হওয়ায় নিবন্ধক তথ্যের ঘাটতির কারণে উক্ত ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধন প্রত্যাখ্যান করিতে পারিবেন না…।’ অসম্পূর্ণ তথ্য ‘অপ্রাপ্য’ লিখে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে।

আরও পড়ুন

সেদিন জন্মনিবন্ধনের অনলাইন ফরম খুলে বাবা-মার তথ্য না দিয়ে ভরার চেষ্টা করে দেখলাম সেটা এগোচ্ছে না। আইনি অভিভাবকের জন্য কোনো ঘর সেখানে নেই।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন তথ্য ব্যবস্থা’র ওয়েবসাইটে ‘প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন’ পাতায় ১০ নম্বর প্রশ্নের উত্তর বলছে, বিবাহবিচ্ছেদ বা পিতা-মাতার একজন অপ্রাপ্য বা নিখোঁজ হলে শুধু একজনের তথ্য এবং অন্যজনের কেবল নাম দিয়ে সন্তানের জন্ম নিবন্ধিত করা যাবে।

আমার মেয়েটির জন্য অবশ্য ‘অপ্রাপ্য’ই ভরসা। সে বড় জটিল ভরসা, যার নিষ্ঠুরতা সারা জীবন হয়তো তাকে আঘাত করবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্রের ভিত্তিতে আইনি অভিভাবক হিসেবে আমি তার মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) করাতে পেরেছিলাম। গত বছর তার ই-পাসপোর্ট করাতে চাইলাম। অনলাইন আবেদন ফরমে বাবা ও মার পর আইনি অভিভাবকের তথ্যের জন্য ঘর ছিল। শুধু সেটা পূরণ করলাম।

বায়োমেট্রিক তথ্য দিতে গিয়ে বাবা-মার তথ্য না-থাকা নিয়ে মেয়েকে যেভাবে হেনস্তা হতে হয়েছিল, সে কথা প্রথম আলোতেই লিখেছিলাম। তার পর অবশ্য পাসপোর্ট অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেন।

তাঁদের সহযোগিতায় আমার মেয়ে আবার এমআরপি পাসপোর্ট পায়, তবে তার ই-পাসপোর্ট পাওয়া হয়নি। জানতে পারি, ই-পাসপোর্ট ছাপার ছকে অভিভাবকের তথ্য বসানোর সুযোগ নেই। তাঁরা বলেছিলেন, সেটা দ্রুত সংশোধন করা হবে।

অদূর ভবিষ্যতে আমার মেয়েকে জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে হবে। ভাবছি, তখন কী হবে। সেখানে কি মা-বাবার নাম ছাড়া চলবে? সংক্ষিপ্ত অনলাইন সফরে তা জানতে পারিনি।

ফিরে যাই উচ্চ আদালতের সদ্যঘোষিত রায়ের পটভূমির কথায়। এসএসসি পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করা হয় নবম শ্রেণিতে। একটি মেয়ে নিবন্ধনের জন্য শিক্ষার্থীর তথ্যসংক্রান্ত ফরমে শুধু মার নাম দিয়েছিল, বাবার নাম দিতে পারেনি। দুজনের নাম ও তথ্যই বাধ্যতামূলক ছিল।

সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ড মেয়েটিকে নিবন্ধিত করল না, এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্রও পাঠাল না। মেয়েটি পরীক্ষা দিতে পারল না। এ ঘটনা ধরেই ১৪ বছর আগে রিট আবেদনটি হয়েছিল।

মেয়েটির বঞ্চনা আজ অন্যদের জন্য অধিকার আদায়ের সুযোগ করে দিয়েছে। রিট আবেদনের সঙ্গে প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন যুক্ত করা হয়েছিল। শিরোনাম, ‘বাবার পরিচয় নেই, বন্ধ হলো মেয়ের লেখাপড়া’ (২৮ মার্চ ২০০৭)।

সেই প্রতিবেদনে মেয়েটি বলেছিল, তার বাবা কে সে শুনেছে। কিন্তু লোকটি তার মা এবং তাকে স্বীকৃতি দেননি। তাই সে ফরমে তাঁর নামটি লিখতে পারেনি।

অনেকে তাকে বলেছিল, চুপেচাপে লিখে দিতে। কিন্তু তা সে করেনি। মনেপ্রাণে আশা করি, আমার মেয়ে যেন তার মতো সৎ থেকে জীবনের কঠিন সিদ্ধান্তগুলো নেয়।

তার হারানো সময়ের কষ্ট আজ আমাকে গ্রাস করছে। আমি আমার মেয়ের মুখে তার না-দেখা মুখটি দেখছি। আশা করছি, একদিন আমরা মা-মেয়ে তার দেখা পাব।

আজ তাকে বলি, ‘মা গো, জীবনে জয়ী হ। এখন এসএসসি পরীক্ষা দে। রাষ্ট্র তোকে সে সুযোগ দিতে বাধ্য।’

কিন্তু অভাব-অনটনের পাকে ঘুরে তার জীবন আজ থিতু হয়েছে। সেই জীবনে নিজেকে বিকাশের সুযোগটাই হয়তো অবান্তর। কষ্টটা ফিরে আসে, সময়কে তো আর ফিরিয়ে আনা যায় না। থাকে বাবার পরিচয় না-পাওয়ার কথা জানাজানি হওয়ার ভয়।

একটা পুরোনো প্রশ্ন নতুন করে আমাকে পীড়িত করছে। কেন আমার মেয়েকে বাবার নাম না-থাকা নিয়ে সমাজের নানা পরিসরে প্রশ্ন ও খোঁটা শুনতে হবে, বঞ্চনার ঝুঁকিতে থাকতে হবে? সদ্যঘোষিত রায়টি আমার মনে আরও প্রশ্ন আর দাবি ঠেলে তুলছে।

মা শিশুকে গর্ভে ধারণ করেন। আমার মেয়েকে আমি মনের মধ্যে ধারণ করেছি। তবু আমি তাকে দত্তক নিয়ে তার মা হতে পারিনি।

আমার ছোট ভাইটা মারা গেলে তার স্ত্রীকে আদালতের কাছ থেকে নিজের শিশু সন্তানের আইনগত অভিভাবকত্ব নিতে হলো; তা–ও আবার সেই মামলায় পিতৃকুলের প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে বিবাদী করে।

সংবিধান কেন অভিভাবকত্বসহ পারিবারিক জীবনে নারীর প্রতি গুরুত্বপূর্ণ বৈষম্যগুলো দূর করার কথা বলবে না?

আপাতত আমি আমার মেয়েকে শক্তপোক্ত করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি। আর অনেক ভরসা নিয়ে তাকিয়ে আছি রাষ্ট্র ও সমাজের শুভ শক্তি এবং ভালো মানুষদের দিকে। ভবিষ্যতের জন্য, সবার জন্য।

  • কুর্‌রাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা সাংবাদিক

[email protected]