তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এখনই শুরু হয়ে গেছে!

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে দুই প্রেসিডেন্টের কারও ভাষণেই আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু পায়নি বিশ্ব
ছবি : এএফপি

আমরা এখন একটা আত্মধ্বংসের যুগে বাস করছি। এ যুগের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ থেকেই যদি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান, তাহলে আগামী দিনের ঐতিহাসিকেরা অবশ্যই গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ স্মরণ করবেন। দুই প্রেসিডেন্টের বাগ্‌যুদ্ধ উল্লেখ করে তাঁরা তা করবেন। এর এক পক্ষে থাকবেন যুক্তরাষ্ট্রের পাষাণ হৃদয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যিনি ওয়াশিংটন থেকে কিয়েভে উড়ে যান ইউক্রেনীয়দের সংগ্রামে তাঁর আমৃত্যু সমর্থন ঘোষণার জন্য। আর অন্য পক্ষে থাকবেন কর্কশ হৃদয়ের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে দুই প্রেসিডেন্টের কারও ভাষণেই আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু পায়নি বিশ্ব। বাইডেন তাঁর বক্তব্যে অবরুদ্ধ ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের দেওয়া অতিরিক্ত ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর এই ভাষণের পরপরই পেন্টাগন থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাছে এমআইএ২ আব্রাহামস ট্যাংক (মেইন ব্যাটল ট্যাংকস) হস্তান্তরের ক্ষেত্রে যে ধীরে চলো নীতি তারা নিয়েছিল, সেখান থেকে তারা সরে আসবে। এর অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ভান্ডারে মজুত থাকা ট্যাংক থেকে কিয়েভের কাছে অগ্রসর প্রযুক্তির ট্যাংক হস্তান্তর করা হবে।

পুতিনের ভাষণ যে অর্থ বহন করে

অন্যদিকে পুতিনের ভাষণ ছিল দুই ঘণ্টা দীর্ঘ। তাঁর ভাষণে তিনি যথারীতি ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পূর্ণ জয়ের ব্যাপারে তাঁর অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। একইভাবে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে ‘শয়তানের উপাসক’ ও ‘মর্ষকামী’ হয়ে দুনিয়া শাসন করছে।

এটা বিস্ময়ের বিষয় নয় যে বেশির ভাগ পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম পুতিনের এই ভাষণ প্রচার করেনি। সীমিত যে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম তা প্রচার করেছে, তা-ও ছিল উপহাসমূলক। পুতিন তাঁর ভাষণে এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে দৃঢ় অঙ্গীকারই ব্যক্ত করেননি, সংঘাত তীব্র করার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। পুতিন মনে করেন, আমেরিকা সংঘাতে উত্তেজনা উসকে দিচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে, ন্যাটোর ওপর এই প্রথম বড় ধরনের হুমকি তৈরি করলেন পুতিন। তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ মার্কিন প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে বলেন, ইউক্রেন থেকে যদি যুক্তরাষ্ট্র তাদের দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা না সরায়, তাহলে রাশিয়ার সেনারা সেটাকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালাবে।

আগামী দিনের ঐতিহাসিকেরা আমাদের সময়ের রাষ্ট্রনেতারা কেন এমন নির্বোধের মতো আচরণ করেছিলেন, তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নিশ্চিতভাবেই দ্বিধায় পড়ে যাবেন। তাঁরা উল্লেখ করবেন যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট যে ভাষণ দিয়েছেন, সেই ভাষণই এই সংঘাতকে বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

পুতিনের এই হুমকিতে স্পষ্টত একটা বিপৎসীমা আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে দ্বিতীয়বারের মতো ভাবা প্রয়োজন বিপৎসীমাটা তারা অতিক্রম করবে কি না।

এই দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেন রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা করার জন্য ব্যবহার করতে পারে। পুতিন বলেছেন এ ধরনের কোনো হামলা হলে তার জন্য আমেরিকানরা সরাসরি দায়ী থাকবে। এ ছাড়া এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার ওপর রাশিয়া হামলা করলে আমেরিকানরা নিহত হতে পারেন। কেননা, দূরপাল্লার এসব ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে আমেরিকানরা নিয়োজিত।

দুই প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের সারবস্তু যদি আমরা গ্রহণ করি, তাতে যে ব্যাপারটি নিশ্চিত তা হলো, শিগগিরই শান্তি আলোচনার কোনো আশা নেই।

আরও পড়ুন

পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে

পুতিন তাঁর ভাষণে ওবামা আমলে সম্পাদিত পারমাণবিক চুক্তি (নিউ স্টার্ট ট্রিটি) থেকে বেরিয়ে আসার মতো দুঃখজনক একটি ঘোষণা দেন। ওই চুক্তি অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা সীমিত সীমার মধ্যে রাখতে ঐকমত্যে পৌঁছেছিল।

নিউ স্টার্ট ট্রিটি নামে পরিচিত চুক্তিটি সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও পুতিনের স্নেহধন্য সাবেক রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের মধ্যে স্বাক্ষর হয়েছিল। নিশ্চিতভাবেই এই চুক্তি রাশিয়াকে বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছিল। শীতল যুদ্ধের জমানা থেকেই রাশিয়ানরা আমেরিকানদের সঙ্গে বিশ্বে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সহমত পোষণ করে আসছেন।

অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সোচ্চার পুতিনই পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে এলেন। ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে অন্ধভাবে সমর্থন করে চলেছে তার প্রতিক্রিয়াতেই পুতিনের এই সিদ্ধান্ত। পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ হলো, পুতিন যেকোনো মূল্যে এ যুদ্ধ জয় করতে চান।

রাশিয়া এ যুদ্ধে নিশ্চিত করেই বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে। কিন্তু শেষ দিকে এসে ইউক্রেনের ক্ষয়ক্ষতিও বিশাল। ইউক্রেনীয়দের কাছে অপছন্দনীয় না-ও হতে পারে, কিন্তু হাজার হাজার রাশিয়ান সেনা পাঠিয়ে ইউক্রেন গুঁড়িয়ে দেওয়াই মস্কোর চূড়ান্ত পরিকল্পনা। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে এই দানবীয় কাজ যাতে তার বাহিনী করতে পারে, সে জন্য ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা ব্যবহারেও পিছপা হবেন না পুতিন।

ফিরে আসার পথ নেই

এক বছর আগে সংঘাত যখন শুরু হয়েছিল তারও আগে থেকেই কিয়েভ তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট করেছিল। ইউক্রেন চায় পুরো পূর্ব ইউরোপ ও ক্রিমিয়া তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।

প্রকৃতপক্ষে এটিও একটি বিপৎসীমা। ইউক্রেন যদি সেটা করতে উদ্যত হয়, তাহলে মস্কো পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করে দিতে পারে। সেভাস্তোপলের নৌঘাঁটি কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না মস্কো। কেননা, তাতে ভূকৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণসাগরে একঘরে হয়ে পড়বে রাশিয়া।

পশ্চিমারা একটি নিখাদ কল্পনার জগতে বাস করবে, যদি তাদের তথাকথিত নেতারা ভেবে বসেন যে পুতিন আরামকেদারায় শুয়ে সবকিছু চুপ করে দেখে যাবেন। পুতিনের দীর্ঘ বক্তৃতার মূল কেন্দ্রটি এটি। এ যুদ্ধ শেষ হচ্ছে না। মীমাংসারও কোনো বন্দোবস্তও নেই।

আরও পড়ুন

বাইডেন তাঁর দিক থেকে পরিষ্কার করেছেন যে তিনি কেবল প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সরকারকেই সমর্থন করেই যাবেন না। কিয়েভ থেকে ফিরে তিনি টুইট করেছেন, সেখানে তিনি তার হৃৎপিণ্ডের একটি অংশ রেখে এসেছেন।

বাইডেন ইউক্রেন নিয়ে যখন এই দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করছেন, তখন নিজ দেশের ওহিওতে বিপজ্জনক মাত্রায় রাসায়নিকের দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সেটা ঠেকাতে তেমন উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে না। অনেক সমালোচক এই রাসায়নিক নিঃসরণের ঘটনাকে ‘আমেরিকার চেরনোবিল’ বলে সমালোচনা করছেন।

এদিকে চীন সম্প্রতি আরও সরাসরি মস্কোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর অর্থ হলো রাশিয়াকে পুরোপুরি একঘরে করার জন্য পশ্চিম যখন মরিয়া প্রচেষ্টা শুরু করেছে, সে সময় মস্কো আরও বড় কৌশলগত নির্ভরতার কাঁধ পেল। রাশিয়া যদি যুদ্ধের ফলাফল নিজেদের পক্ষে নিতে পারে, তাহলে তারা কেন শান্তি আলোচনায় যাবে?

আগামী দিনের ঐতিহাসিকেরা আমাদের সময়ের রাষ্ট্রনেতারা কেন এমন নির্বোধের মতো আচরণ করেছিলেন, তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নিশ্চিতভাবেই দ্বিধায় পড়ে যাবেন। তাঁরা উল্লেখ করবেন যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট যে ভাষণ দিয়েছেন, সেই ভাষণই এই সংঘাতকে বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

  • ব্রান্ডন জে উইচার্ট উইনিং স্পেস: হাউ আমেরিকা রিমেইনস এ সুপারপাওয়ার বইয়ের লেখক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ মনোজ দে