ভারত-পাকিস্তানের লড়াই নিয়ে চীনে এই উত্তেজনা কেন

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগরের কাছে বিধ্বস্ত একটি যুদ্ধবিমান দেখছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ৭ মেছবি: রয়টার্স

‘অপারেশন সিঁদুর’ এখনো চলছে। এ নিয়ে ইতিমধ্যে ইন্টারনেটে কথা–চালাচালি ও প্রচার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

চীনে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে পাকিস্তানকে ঘিরে। চীনের সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েইবোতে ‘Pakistan_shoots_down_6 _Indian_jets’ নামের একটি হ্যাশট্যাগ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ৯ কোটির বেশি বার দেখা হয়েছে।

চীনের কিছু বড় সংবাদমাধ্যম এমনভাবে সংবাদ প্রচার করছে, যা পাকিস্তানকে উৎসাহিত করবে বলে মনে হয়। যেমন গুয়ানচা লিখেছে, ‘পাকিস্তান ৬টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, যার মধ্যে ৩টি রাফাল’ এবং ১৬৩ নেটইজ লিখেছে, ‘প্রথম লড়াইতেই পাকিস্তানের জয়’।

এভাবে খবর প্রকাশ করা দেখে বোঝা যায়, চীনে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি বদলে যাচ্ছে। আগে চীনে পাকিস্তানকে দুর্বল একটি দেশ মনে করা হতো। তবে এখন তাকে শক্তিশালী এক সামরিক শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এমনকি পাকিস্তানকে ভারতের সমান বলে ভাবা হচ্ছে।

পেহেলগামে জঙ্গি হামলার পর চীনের বিশ্লেষকেরা ভারতের সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে বেশি করে আলোচনা করছেন। তাঁরা বলছেন, পাকিস্তান এখন যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত।

পাকিস্তানের জেএফ-১৭ জেট বিমানে চীনে তৈরি পিএল-১০ মিসাইল বসানো হয়েছে। এটি যেন চীনের অস্ত্রশক্তি দেখানোর একটা উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও চীন বহু বছর ধরে কোনো বড় যুদ্ধ করেনি, তারপরও তাদের তৈরি অস্ত্র ব্যবহারে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।

কথাগুলো শুধু সংবাদে প্রচারিত হচ্ছে না, গবেষক ও বিশেষজ্ঞরাও এ কথা বলছেন। লং শিংচুন, হুই সুইশেং এবং লিউ জংইসহ চীনের অনেক বিশেষজ্ঞ বারবার বলছেন, ভারতই দক্ষিণ এশিয়ায় অশান্তির মূল কারণ। তাঁদের মতে, পাকিস্তান শুধু আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে।

ফুডান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক লিন মিনওয়াং বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি অনেক আগ্রাসী কথা বলছিলেন, তাই পাকিস্তানের হামলা ‘অপরিহার্য’ হয়ে উঠেছিল। তিনি লিখেছেন, ভারতের আক্রমণের জবাবে পাকিস্তান যদি কিছু না করত, তাহলে সেটি তাদের জন্য লজ্জার হতো।

আরও পড়ুন

ভারত মনে করছে, কাশ্মীরে সম্প্রতি যে হামলা হয়েছে, তার লক্ষ্য ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী। কিন্তু লিন বলছেন, এই হামলার পেছনে যে পাকিস্তান আছে, সেটা পরিষ্কার নয়। তিনি বলছেন, ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ নামে যে গোষ্ঠী হামলা চালিয়েছে, তারা স্থানীয় বিদ্রোহী দল, যদিও বাস্তবে তাদের লস্কর-ই-তাইয়েবার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। অবশ্য বিষয়টি লিন এড়িয়ে গেছেন।

চীনের অনেক জায়গায় পাকিস্তানকে এখন আধুনিক ও শক্তিশালী একটি দেশ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ‘India_opens_fire_on_Pakistan_without_provocation’ নামের একটি হ্যাশট্যাগে অনেক আলোচনা হয়েছে। এতে বলা হচ্ছে, পাকিস্তান বড় ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনকি পাকিস্তানের রাশিয়ায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত চীনের সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, দরকার হলে পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্রও ব্যবহার করবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা আমাদের সব ধরনের শক্তি ব্যবহার করব, চাই সেটা সাধারণ যুদ্ধ হোক বা পারমাণবিক।’

যখন এই অপারেশন নিয়ে আলোচনা এগোচ্ছে, তখন একটি বড় প্রশ্ন সামনে আসছে—চীন কি কোনো বড় যুদ্ধ হলে পাকিস্তানকে সমর্থন দেবে? কিছু বিশ্লেষক বলছেন, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান এবং চীনের সীমান্ত বিরোধ এখনো মেটেনি। তাঁদের মতে, ভারতের কিছু কাজ আসলেই উসকানি।

বলা হচ্ছে, পুরোনো সোভিয়েত যুগের ট্যাংক, পশ্চিমা দেশগুলোর যুদ্ধবিমান আর নিজেদের তৈরি কিছু অস্ত্রের একটা অদ্ভুত মিশেলই হলো ভারতের সেনাবাহিনী। এতে একধরনের সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। তার বিপরীতে পাকিস্তানের সামরিক সরঞ্জামকে অনেক বেশি ‘ইন্টিগ্রেটেড’ ও লক্ষ্যভেদী হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

একজন মন্তব্যকারী লিখেছেন, ‘ভারত কি ১৯৬২ সালের শিক্ষা ভুলে গেছে?’ এ ধরনের মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, অনেকেই মনে করছেন, চীনের সহায়তা পাকিস্তানকে ভারতের সামরিক শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে সাহায্য করছে।

পাকিস্তান আকারে ছোট হলেও এখন অনেকেই মনে করছেন, তাদের সেনাবাহিনী প্রযুক্তিগতভাবে অনেক আধুনিক এবং কৌশলগতভাবে দক্ষ হয়ে উঠেছে।

ভারতের বিশাল সেনাবাহিনী (যার সদস্য ১৪ লাখের বেশি এবং ভারতের ২০২৫ সালের প্রতিরক্ষা বাজেট ৬.৮১ লাখ কোটি রুপি) চীনা বিশ্লেষকদের লেখায় মাঝেমধ্যেই খণ্ডিত ও বিক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে।

বলা হচ্ছে, পুরোনো সোভিয়েত যুগের ট্যাংক, পশ্চিমা দেশগুলোর যুদ্ধবিমান আর নিজেদের তৈরি কিছু অস্ত্রের একটা অদ্ভুত মিশেলই হলো ভারতের সেনাবাহিনী। এতে একধরনের সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। তার বিপরীতে পাকিস্তানের সামরিক সরঞ্জামকে অনেক বেশি ‘ইন্টিগ্রেটেড’ ও লক্ষ্যভেদী হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন

চীনের বিশ্লেষণগুলো অবশ্য স্বীকার করে নিচ্ছে যে ভারত তার সামরিক খাতে কিছু আধুনিকায়ন করেছে। যেমন তারা কাশ্মীরে টি-৯০ ট্যাংক মোতায়েন করেছে; মেটেওর মিসাইলসহ রাফাল যুদ্ধবিমান নামিয়েছে। কিন্তু এগুলোও তারা ব্যাখ্যা করছে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রভিত্তিক ভয় দেখানোর কৌশলের জবাব হিসেবে।

২০১৯ সালের সেই ঘটনার কথা বারবার আসছে, যখন পাকিস্তান একটি ভারতীয় মিগ-২১ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে পাইলটকে আটক করেছিল। এটিকে এখনো চীনা আলোচনায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে ধরা হয়।

চীনের সহায়তায় পাকিস্তান এখন এসএইচ-১৫ কামান এবং জে-১০সি যুদ্ধবিমান হাতে পেয়েছে। যদিও ভারত এখনো সংখ্যায় এগিয়ে, তবে চীনের বিশ্লেষকেরা বলছেন, বেইজিংয়ের সহায়তায় পাকিস্তান কৌশলগতভাবে ভারসাম্য এনে ফেলছে।

সাংহাই অবজারভার নামের একটি চীনা পত্রিকায় লেখা হয়েছে, পাকিস্তান যেসব অস্ত্র পরীক্ষা করছে (মে মাসে ফাতাহ মিসাইল আর আবদালি অস্ত্র সিস্টেমের ট্রায়াল), সেগুলো তারা ভারতের ২০১৯ সালের পর করা যুদ্ধবিমান আধুনিকীকরণের সরাসরি জবাব হিসেবে করেছে। চীনা বিশ্লেষণে ভারতের যুদ্ধবিমানের হামলাকে সেই সময়ের ‘অপমান’ ও ‘লজ্জার অভিজ্ঞতা’ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

পাকিস্তানকে চীনের কৌশলগত সমর্থন

চীন অনেক দিন ধরেই পাকিস্তানকে ভারতের ভারসাম্য রক্ষাকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে দেখে আসছে। এই ভাবনার পেছনে রয়েছে বেইজিংয়ের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় চীন পাকিস্তানকে জে-৬ যুদ্ধবিমান ও কামান দিয়েছিল, যাতে তারা ভারতের সামরিক ব্যবস্থার পাল্টা জবাব দিতে পারে। এখনো চীনা বিশ্লেষকেরা পাকিস্তানকে এমন এক কৌশলগত মিত্র হিসেবে দেখেন যে কূটনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সরবরাহভিত্তিক সহায়তা পাচ্ছে চীনের কাছ থেকে; যদিও চীন সরাসরি কোনো যুদ্ধে জড়াতে চায় না।

চীনের বিশ্লেষণে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাবনা এখন আর শুধু দুই দেশের বিষয় নয়, বরং চীনা অস্ত্রের ক্ষমতা প্রমাণ করারও এটি একটি সুযোগ। পাকিস্তান যে জে-১০ সিই যুদ্ধবিমান ও ওয়াইজে অ্যান্টি-শিপ মিসাইল মোতায়েন করেছে, তা নাকি ভারতের ফরাসি রাফাল জেট ও নিজস্ব বিমানবাহী রণতরীর জবাব।

ভারতের সেনাবাহিনী এবং প্রতিরক্ষা বাজেট বড় হলেও, চীনের বিশ্লেষকেরা মনে করেন, পাকিস্তান এখন বিমান শক্তির ওপর জোর দিচ্ছে, আর চীনের প্রযুক্তি দিয়ে তারা এই ঘাটতি পূরণ করতে পারছে।

তবে কিছু চীনা বিশ্লেষক স্বীকার করেন, পাকিস্তানের স্থলবাহিনী এখনো দুর্বল। বিশেষ করে যখন ভারত ড্রোন (ইউএভি) ও এফপিভি ড্রোনে বেশি বিনিয়োগ করছে, তখন পাকিস্তানের স্থলবাহিনীর দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। তবু পাকিস্তান নিয়ে সামগ্রিকভাবে চীনের মনোভাব আশাবাদী। তাদের মতে, সংস্কার আর চীনের দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা পাকিস্তানকে ধীরে ধীরে ভারতের সঙ্গে ব্যবধান কমাতে সাহায্য করবে।

আরও পড়ুন

পক্ষপাতদুষ্ট আলোচনার ধরন

চীনের আলোচনায় ভারত-পাকিস্তান সম্ভাব্য যুদ্ধে ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ বা বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি প্রায় একেবারে উপেক্ষিত; বরং পুরো আলোচনায় পাকিস্তানকে বিজয়ী ও ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি হিসেবে দেখানো হচ্ছে, যার পেছনে রয়েছে চীনের অংশীদারত্ব। চীনকে শুধু মিত্র নয়, বরং এক প্রভাবশালী চালিকা শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যার অস্ত্র ও প্রযুক্তিকে যুদ্ধের গতিপথ বদলে দেওয়ার উপাদান হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এখন চীনা আলোচনায় কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। চীনা সামাজিক মাধ্যমে এ ঘটনাকে পাকিস্তানের কোনো ক্ষতি নয়, বরং একটি কৌশলগত মোড় বলেই দেখা হচ্ছে।

একজন উইবো ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘পাকিস্তান একটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে। এটি বৈশ্বিক সামরিক কৌশলের দিক থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এবং চীনের শক্তির প্রমাণ।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘জে-১০সিই বিমান, ওয়াইজে মিসাইল আর ভবিষ্যতে আসা জে-৩৫ ও ০৫৪বি ফ্রিগেটের মাধ্যমে পাকিস্তান পরিষ্কারভাবে প্রাধান্য পাবে।’

বার্তাটি পরিষ্কার—চীনের সহায়তায় পাকিস্তান শুধু ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিতেই নয়, ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতাও রাখে।

এই উত্তেজনার মধ্যে চীন ক্রমে পাকিস্তানকে এমন এক প্রক্সি মিত্র হিসেবে তুলে ধরছে, যে কিনা ভারতীয় উপমহাদেশের কৌশলগত পরিবেশ গঠনে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখছে। এটি এখন আর শুধু ভারত-পাকিস্তানের শত্রুতা নয়; এটি হয়ে উঠেছে এক পরীক্ষার ময়দান, যেখানে ভারতের দেশীয় ও পশ্চিমা প্রযুক্তির মিশ্র ব্যবস্থা চীনা অস্ত্রের মুখোমুখি হচ্ছে। চীনের জন্য এটা আঞ্চলিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং তাদের সামরিক প্রযুক্তি প্রদর্শনের সুযোগ।

আর ভারতের কাছে এই বার্তা একেবারে স্পষ্ট—চীন কখনোই নিরপেক্ষ ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না।

  • সানা হাশমি তাইওয়ান-এশিয়া এক্সচেঞ্জ ফাউন্ডেশনের ফেলো।

দ্য প্রিন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ