৩০ বছরে তৃতীয়বার ও তিন বছরে দ্বিতীয়বার—আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল ঘিরে আজারবাইজান ও জাতিগত আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাত ঠেকাতে ব্যর্থ হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। সর্বসাম্প্রতিক সংঘাত শুরু হয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর। আজারবাইজান বাহিনী ছিটমহল পুনর্দখলে বড় অভিযান শুরু করে এবং দ্রুততার সঙ্গে অভিযান শেষ করে।
আজারবাইজান ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ অভিযান শুরুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বঘোষিত নাগোরনো-কারাবাখ রিপাবলিকের (এনকেআর) নেতারা অস্ত্র সংবরণ করেন। তিন দিন পর আজারবাইজানের বাহিনী নাগোরনো-কারাবাখের অনেক গ্রাম, খনি এবং কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নিয়ন্ত্রণ নেয়। জাতিগত আর্মেনিয়ানদের চারপাশ ঘিরে অবস্থান নেয়। এনকেআর তাদের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত ঘোষণা করতে সম্মত হয়।
এবারের সংঘাত মাত্র কয়েক দিন স্থায়ী হয়েছে। কিন্তু এই সংঘাতে অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। গণবাস্তুচ্যুতি এবং বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে অস্থিরতা উসকে দিতে পারে। বলা চলে, আরেকটি বড় মানবিক বিপর্যয় দৃশ্যপটে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
নাগোরনো-কারাবাখে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার জাতিগত আর্মেনিয়ান বাস করেন। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ বলেছেন, এই লোকদের তিনি আজারবাইজানের সমাজের সঙ্গে একীভূত করতে ইচ্ছুক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কয়েক দশকের সংঘাত ও নৃশংসতার পর দুই পক্ষের মধ্যে বিশ্বাসের জায়গাটা শূন্য এবং শত্রুতার মাত্রাটা অনেক বেশি।
নাগোরনো-কারাবাখে থেকে আর্মেনিয়ানরা এরই মধ্যে দলে দলে আর্মেনিয়া যেতে শুরু করেছেন। এনকেআরের নেতারা বলছেন, অস্থিতিশীল অঞ্চল ছেড়ে প্রায় সব আর্মেনিয়ান তাঁদের জন্মভূমিতে চলে যাবেন। এই গণবাস্তুচ্যুতি পুরো অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় করে তুলবে।
এই গভীর সংকটের পেছনে আন্তর্জাতিক মহলের নিষ্ক্রিয়তা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলেছেন। অথচ তাঁর বাহিনী নাগোরনো-কারাবাখের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখলে নিচ্ছে। এ ছাড়া আজারবাইজান তাদের ছিটমহল নাখছিভানের জন্য ‘স্থল করিডর’ তৈরির পথ খুঁজছে। এটি দুই দেশের মধ্যে জটিলতা আরও বাড়াবে।
কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (সিএসটিও) আওতায় আর্মেনিয়ার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করার কথা রাশিয়ার। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। এ কারণেই নাগোরনো-কারাবাখে আর্মেনিয়ানদের স্বার্থরক্ষায় তাদের অনেক কিছু করা উচিত। কিন্তু প্রতিবার সংঘাতের পর সিনেমার কায়দায় যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করা ছাড়া আর কিছুই করে না মস্কো।
রাশিয়া কখনোই আজারবাইজানের শত্রু হতে চায় না। সে কারণে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উত্তেজনায় হস্তক্ষেপ করতে তারা উৎসাহী নয়। এ কারণেই রাশিয়া আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডে ঢুকে আজারবাইজানের হামলা বন্ধে আর্মেনিয়ার অনুরোধ কানে তোলে না। এমনকি সর্বশেষ হামলায় রাশিয়ার পাঁচজন শান্তিরক্ষী মারা যাওয়ার পরও তারা নিশ্চুপ।
ওই অঞ্চলের সংঘাত নিয়ে রাশিয়া একমাত্র চোখ বন্ধ করে রেখেছে, তা নয়; সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী করার অঙ্গীকার দেওয়া সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র তিন দশক ধরে চলা রক্তপাত বন্ধে এবং সেখানে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখায়নি।
১৯৯৪ সালে প্রথম নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধে আর্মেনিয়ান বাহিনী ছিটমহলের চারপাশের আজেরি (আজারবাইজানে যে জাতিগোষ্ঠী) সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আজেরি জনগোষ্ঠীর হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। সে সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আজারবাইজানের সঙ্গে আলোচনায় বসার এবং দুই পক্ষের জন্য একটি টেকসই শান্তিচুক্তি করার জন্য আর্মেনিয়াকে কোনো চাপ দেয়নি।
সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার বদলে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র চোখ বন্ধ করে রাখে। তারা উল্টো আজারবাইজানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে মুনাফা করে। আজারবাইজানে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে ইসরায়েল ও তুরস্কও লাভবান হয়। আর রাশিয়া আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান—দুই পক্ষের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করে।
২০২০ সালের যুদ্ধে আজারবাইজান জিতে যায়। এ সময়ও বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলো চুপ করে বসে থাকে। দর-কষাকষি, কথাবার্তা, বিবৃতি সবকিছুই দেওয়া হয়। কিন্তু সহিংসতা বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
২০২২ সালে আজারবাইজানের সেনারা আর্মেনিয়ার সঙ্গে নাগোরনো-কারাবাখের যোগাযোগের পথ লাচিন করিডরে অবরোধ করেন। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা আরও স্পষ্ট হয়। এই অবরোধ চলে ২৫০ দিন ধরে। এ সময়ে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি ফর রেডক্রেসকেও সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এরপরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো অর্থপূর্ণ উদ্যোগ দেখা যায়নি।
রাশিয়ার দিক থেকে দেওয়া সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি যে ছদ্ম, সেই ধারণা আর্মেনিয়ানদের কাছে ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আজারবাইজানের জ্বালানি খাতে বেশির ভাগ বিনিয়োগ আসে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। এ কারণে পশ্চিমাদের খুশি রাখার যথেষ্ট কারণ আছে তাদের। জ্বালানি তেল বিক্রি কমে যাওয়ায় পশ্চিমা বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি বাড়িয়ে রাজস্ব ঠিক রাখতে চায় আজারবাইজান।
পশ্চিমাদের অনেকে এখনো আর্মেনিয়াকে রাশিয়ার অনুগত জোট বলে মনে করে। কিন্তু এ মাসের শুরুতে যে দেশটি আমেরিকার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে, সেই দেশকে পরিপূর্ণভাবে ‘রাশিয়ার মিত্র’ তকমা দেওয়া কতটা ঠিক?
নাগোরনো-কারাবাখের ১ লাখ ২০ হাজার মানুষকে যদি পুরোপুরি বাস্তুচ্যুত করা হয়, তাহলে ১৯৯০-এর দশকের মানবিক সংকটের পুনরাবৃত্তি ঘটবে—সেবার আজেরি, এবার আর্মেনিয়ানরা। এই সংকট আর্মেনিয়ার গণতন্ত্রের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে।
আজারবাইজানের নাগোরনো-কারাবাখ বিজয় আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের জনসমর্থন কমাবে। ২০১৮ সালে গণতন্ত্রপন্থীদের অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসা পাশিনিয়ানের গ্রহণযোগ্যতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সামরিক অভিজাতেরা আবার ক্ষমতায় ফিরতে পারে এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে ফেলতে পারে।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলেছেন। অথচ তাঁর বাহিনী নাগোরনো-কারাবাখের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখলে নিচ্ছে। এ ছাড়া আজারবাইজান তাদের ছিটমহল নাখছিভানের জন্য ‘স্থল করিডর’ তৈরির পথ খুঁজছে। এটি দুই দেশের মধ্যে জটিলতা আরও বাড়াবে।
আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান সংঘাতে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলের যে পদক্ষেপ, তাতে তাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। তাদের ব্যর্থতার কারণেই সেখানে তিনবার যুদ্ধ ও রক্তপাত হয়েছে।
ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস লন্ডনভিত্তিক ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফেলো
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত