আমার এক মার্কিন বন্ধু আছে, নাম উইলি। রাজনীতি নিয়ে উইলির আগ্রহে বেশ ঘাটতি আছে। তবু হঠাৎ সে বলল, তোমাদের হাসিনা আর কত বছর থাকবেন? আমি বললাম, তাঁকে তো আমরা আট মাস আগেই বিদায় করে দিয়েছি। তুমি হয়তো জানো না।
উইলি বলল, কেন? ইলেকশনে ডিফিটেড হয়েছে নাকি? আমি বললাম, ‘না, আমাদের দেশে ইলেকশনে কেউ বিদায় হয় না। একবার গদিতে বসলে আর ছেড়ে যেতে চায় না। ভাগাতে হয়েছে ম্যাস এজিটেশন, মানে গণ-আন্দোলন করে। তুমি তো বাংলা কাগজ পড়ো না, তুমি এসব বুঝবে না।’ উইলি বলল, ‘উইয়ার্ড! আজগুবি তো!’
আজগুবি তো বটেই! এত বছর আমাদের দেশে কত কত নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু কোনো সিস্টেম তৈরি হয়নি যে একটা নিয়মমাফিক সরকার গঠিত হবে। যার যেমন দরকার, সেভাবে নির্বাচন দিয়েছে। আমাদের দেশের নির্বাচনগুলো নিয়ে ভাবলে সত্যি দুঃখ লাগে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে অনেক নির্বাচন হয়েছে, কিংবা নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। এগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তী সরকার-পূর্ববর্তী (১৯৭১-১৯৯০) এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তী সরকার-পরবর্তী (১৯৯১-২০২৪)।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন-পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোতে কোনো প্রকার প্রকৃত বিরোধী দলের অস্তিত্ব ছিল না। শাসকেরা যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবে নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে। প্রথম নির্বাচনটা ছিল শেখ মুজিবের সময়। জাসদকে দুটি আসন দিয়ে তিনি নির্বাচনের দায়ভার সম্পন্ন করেন। এরপরের নির্বাচনগুলোর ভাগ্য নির্ধারণ করেছিলেন মূলত ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা জেনারেল ও তাঁদের অনুসারী রাজনীতিকেরাই। এগুলো কোনোটি ছিল শুধু ‘হ্যাঁ’ ধরনের ভোট, আবার কোনোটি ছিল ‘হ্যাঁ-না’ নির্বাচনের প্রহসন, জনগণের তেমন কোনো অংশগ্রহণ ছিল না।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা তৈরি করে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়েছিলেন। এর পরবর্তী নির্বাচন বা নির্বাচনের প্রচেষ্টাগুলো রাজনীতিবিদদের নানাবিধ অপরিপক্ব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দূষিত হয়েছে। কখনো চেষ্টা হয়েছে নির্বাচনী নিরপেক্ষ সরকারকে নিজেদের ইচ্ছামতো বানাতে, কখনো বা নির্বাচন হয়েছে নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থা একদম উঠিয়ে দিয়ে। মধ্যে আরেকটা নির্বাচন ছিল জেনারেল মইনের দেওয়া। এসব নির্বাচনের কয়েকটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল—১. যে পক্ষ ক্ষমতাহারা, তারা হন্যে হয়ে চেয়েছে নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন এবং যারা ক্ষমতায় গেছে, তারা চেয়েছে নিজেদের অধীন নির্বাচন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলেরই ভূমিকা ছিল এই ডিগবাজিতে। ২. যে দল ক্ষমতায়, তারা সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে, আর যারা ক্ষমতার বাইরে তারা লাঠিসোঁটা হাতে অন্যকে ক্ষমতা থেকে তাড়াতে চেষ্টা করেছে। ৩. জাতীয় পার্টি নামে একটা দল প্রতিবার দারুণভাবে ক্ষমতা উপভোগ করেছে, কখনো কোয়ালিশনে গিয়ে বা কখনো অপজিশন থেকে মন্ত্রী হয়ে।
এই নির্বাচনগুলো নিয়ে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক প্রবন্ধ লেখা যায়। আমি সে চেষ্টা করব না। আমি এই নির্বাচনগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে সংক্ষেপে চারটি মডেল দাঁড় করিয়েছি, যাতে পাঠকেরা খুব সহজেই এই নির্বাচনী প্রচেষ্টাগুলো বুঝতে পারেন। এই মডেলগুলোর শিরোনাম, ‘নির্বাচনের চার মডেল’—
১. নিজেদের মতো ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন করা। বিচারপতি ও সরকারপ্রধান কে হবেন, তা সরকার নির্ধারণ করবে। নিজেদের মতো করে নিয়ম বানিয়ে নাও। যার সঙ্গে মতে মিলবে না, তাঁকে বাদ দিয়ে দাও। মোদ্দাকথা, নিজেদের মতো করে নিরপেক্ষ সরকারে নির্বাচন!
২. প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নতুন নিয়মে নির্বাচন। জবরদস্তি করে নিজের প্রার্থী ছাড়া সবাইকে বসিয়ে দেওয়া। সরতে না চাইলে তাঁকে ডিবিতে নাও। যেহেতু একজন মাত্র থাকবে, তাই আসলে ভোটের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিরোধী দলও তো দরকার। এ জন্য কিছু আসন ছেড়ে দিলেই হলো।
৩. পূর্বনির্ধারিত নির্বাচন হয়ে যাবে নির্বাচন। লিস্টে কে জিতবেন, কে হারবেন, তা থাকবে। কমিশন তা ঘোষণা দিয়ে দেবে।
৪. ডামি-আমি নির্বাচন। মাঠে কোনো অপজিশন নেই। যে জিতবে, সে-ই আপন। ঘোষণা দেবে কমিশন। এখানে কোনো কারচুপির প্রয়োজন নেই।
সীমিত সম্পদের দেশে সব সময় জনগণের পছন্দসই নীতিনির্ধারণ বা প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। তার ওপর আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এসব খবরদারি প্রতিষ্ঠান তো রয়েছেই। নিজেদের নীতি চর্চা করে নির্বাচনে হারাটাও গৌরবের। আমাদের রাজনীতিবিদদের এই হারটা মেনে নেওয়ার অভ্যাস করতে হবে। নাহিদ ইসলাম ঠিকই বলেছেন, একটা নির্বাচনই শেষ নির্বাচন নয়। সামনে জেতার অনেক সুযোগ হবে।
মডেলগুলো অনেক পাঠকের বেশ পরিচিত। তবে পাঠকদের জন্য একটা কুইজ আছে, এই মডেলগুলোর কোনটি কোন সময়ের এবং তখন কে ছিলেন ক্ষমতায়? পাঠকেরা মন্তব্য সেকশনে লিখতে পারেন।
সামনেই নির্বাচন। সরকার সংস্কার নিয়ে কাজ করছে যেন সামনের নির্বাচনগুলো নিরপেক্ষ ও অবাধ হয়। দেশের জনগণও তাই চান। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে-ই ক্ষমতায় যাক না কেন, তাদের ইচ্ছা থাকবে ভবিষ্যতে এই চারটা মডেলের একটাতে ফেরত যেতে। এই দুই ইচ্ছার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে সামনে এগিয়ে চলা আমাদের দেশের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ।
গণতান্ত্রিক দেশে সরকার পরিচালনায় দুটি স্তর থাকে। নিচের স্তরটা হলো, শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি। তার ওপরে পলিসি বা নীতিনির্ধারণ। ভিত্তি রাষ্ট্রের আর পলিসি হলো যারা সরকার গঠন করেছে তাদের। এই দুইয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ রাখা চলবে না। শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি একটা সরকারের পলিসি প্রয়োগে বাধা হতে পারবে না। যদি বাধা হয়, তাহলে বুঝতে হবে পলিসিতে গড়বড় আছে। আবার পলিসি প্রয়োগ করার জন্য ভিত্তিকে নাড়ানো যাবে না। গণতান্ত্রিক সরকারে, যেকোনো রাজনৈতিক দলকে তাদের পলিসি জনগণকে বুঝিয়ে, তাদের কাছে গ্রহণীয় করে পুনর্নির্বাচিত হতে হবে।
এতে কিছুটা ঝুঁকি থাকবেই। সীমিত সম্পদের দেশে সব সময় জনগণের পছন্দসই নীতিনির্ধারণ বা প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। তার ওপর আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এসব খবরদারি প্রতিষ্ঠান তো রয়েছেই। নিজেদের নীতি চর্চা করে নির্বাচনে হারাটাও গৌরবের। আমাদের রাজনীতিবিদদের এই হারটা মেনে নেওয়ার অভ্যাস করতে হবে। নাহিদ ইসলাম ঠিকই বলেছেন, একটা নির্বাচনই শেষ নির্বাচন নয়। সামনে জেতার অনেক সুযোগ হবে।
কিন্তু আমাদের দেশে সমস্যা দেখা দেয়, যখন রাজনীতিবিদেরা নির্বাচিত হওয়ার জন্য শাসনতান্ত্রিক ভিত্তিকে টেম্পারিং বা নড়বড় করেন। এই ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় সহায়ক থাকে পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সংবিধান সংশোধনীর ১৪৮(৩) ধারা। এই দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দাপটে কোনোভাবেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের আইন সংবিধানে রাখা যাচ্ছিল না। শাসকেরা বেছে নেন ওপরে বর্ণিত চার মডেলের একটি। আমাদের রাজনীতিবিদেরা যত দিন ভিত্তি ও পলিসির পৃথকীকরণ না বুঝবেন বা চর্চা না করবেন, তত দিন আমাদের ভুগতে হবে।
ট্রাম্প আসার পর পুরো দুনিয়ায় দারুণ হইচই শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ভালো করে দেখলে দেখা যাবে, সবই ট্রাম্পের পলিসি বা নীতিসংক্রান্ত পরিবর্তন। ট্যারিফ, ইমিগ্রেশন, ব্যয়সংকোচন, ইউক্রেনে সবই ওপরের স্তরের পরিবর্তন, ভিত্তি একই রয়ে গেছে। বাইরের থেকে মনে হচ্ছে, পুরো আমেরিকা ওলটপালট। আবার চার বছর পর নতুন নির্বাচন হবে, নতুন কেউ আসবেন-আশা করা যায় ট্রাম্পের চেয়েও ঠান্ডা মাথার কেউ এবং পলিসিও কিছুটা ধীরস্থির হবে।
ভারতের নরেন্দ্র মোদির প্রতি আস্থা বাংলাদেশে অনেকটা শূন্যের পর্যায়ে। তাঁর যত মুসলমানবিরোধী পলিসিতে সেখানকার লোকেরাও বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। তার ওপর যোগ হয়েছে মোদির নতুন বাংলাদেশ বৈরিতা। কিন্তু আমাদের দেশে অনেকেই জানেন না, ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি কোনো রকমে সরকার টিকিয়ে রেখেছেন বিহারের নীতীশ কুমারের জনতা দলের সমর্থনে। আবার যখন নির্বাচন হবে, হয়তো নতুন কেউ আসবেন এবং মোদির এই সাম্প্রদায়িক নীতির পরিবর্তন হবে।
এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে সামনে আমাদের দেশে রাজনীতিবিদেরা পলিসি ভালো বা খারাপ, যা ইচ্ছা পরিবর্তন করুন না কেন, শাসনতান্ত্রিক ভিত্তিটাকে যেন তারা নড়বড়ে না করেন এবং প্রতি চার-পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন দেবেন। রাজনীতিবিদেরা আর যেন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার যথেচ্ছ ব্যবহার না করতে পারেন। দেশের জনগণ আবার নির্বাচনে ওই চার মডেলের একটাতে ফিরে যেতে চায় না।
এই নিয়ে একটা পরামর্শ সংস্কার কমিশন বিবেচনা করে দেখতে পারেন। যেসব সংস্কার দরকার সব শেষ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যদি সংবিধানের কিছু পরিবর্তন করতে চান, আগে সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চের সম্মতি লাগবে। তাঁরা আলোচনা করে সম্মতি দিলে, তারপর সংসদে আলোচনা হবে। সরকারি দলের দুই-তৃতীয়াংশ এবং বিরোধী দলের দুই-তৃতীয়াংশ সম্মতি দিলে তারপর সংশোধনী পাস হবে। অবশ্য এর একটা পূর্বশর্ত আছে—দেশে একটি প্রকৃত বিরোধী দল থাকবে।
প্রশ্ন আসবে, যদি আবার মিলিটারি ক্যু হয়, তখন কী হবে? তাহলে আবার হয়তো আমাদের ‘হ্যাঁ–না’ ভোট দিয়ে শুরু করে এই চার মডেলের একটা দিয়ে শেষ করতে হবে।
তবে মন বলছে, সামনে এসব হবে না। আমাদের সেনাবাহিনীর জন্য ২০২৪ সালের আগস্টে কত বড় সুযোগ ছিল! তারা কোনো সুযোগ না নিয়ে সিভিল সরকার গঠনে সহায়তা করেছে এবং দেশের জনগণের আস্থা ও শ্রদ্ধা কুড়িয়েছে। ভবিষ্যতেও অবশ্যই তারা এই উদাহরণ মেনে চলবে।
সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক