বিজ্ঞান ভাবনার পথের দুর্ভাবনা সরাচ্ছে কুমিল্লা

কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে টানা তিন ঘণ্টা নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জীববিজ্ঞান ক্লাস নেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান। গত বছরের ফাইল ছবি।
প্রথম আলো

কোনো কোনো জেলায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশাসন উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সেদিন কুমিল্লায় এমন কিছু কার্যক্রম দেখলাম, যা প্রচলিত ধারায় সাধারণত দেখা যায় না । বিজ্ঞান সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের কিছু ব্যতিক্রমী উদ্যোগের কথা বলছি, যা তরুণদের জন্য সত্যিই আকর্ষণীয়।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা আমরা সব সময় বলছি। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই যুগে তরুণ প্রজন্মকে বিজ্ঞান সচেতন করার বিকল্প নেই। এ ছাড়া দেশের তরুণ ও যুবসমাজ এ বিষয়ে বেশ সচেতন। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সূচনালগ্নের চিত্রগুলো সবাইকে আরও জানা-বোঝার জন্য উন্মুখ করে তুলেছে। তরুণেরা বিজ্ঞান আরও জানতে-বুঝতে চান। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা অঞ্চল ভিত্তিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তরুণদের বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে তুলছেন।

আরও পড়ুন

আমরা গত কয়েক বছরে দেখেছি, গণিত অলিম্পিয়াড, ফিজিকস অলিম্পিয়াডস, জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, আন্তর্জাতিক রোবোটিকস প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে আরও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের তরুণ দলের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীরা সোনা-রুপা-ব্রোঞ্জ পদক জয় করে এনেছেন। তাঁদের এই অসাধারণ অর্জন বিশ্বে বাংলাদেশের মেধার স্বীকৃতি এনে দিচ্ছে।

দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বিজ্ঞানচর্চার প্রতি আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। এটা আমাদের আশার আলো দেখায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, দিনাজপুর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় বিজ্ঞানচর্চা আরও শক্তিশালী করার উদ্ভাবনী উদ্যোগ দেখা যায়। প্রতিটির ক্ষেত্রেই নতুনত্ব আছে।

দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বিজ্ঞানচর্চার প্রতি আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। এটা আমাদের আশার আলো দেখায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, দিনাজপুর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় বিজ্ঞানচর্চা আরও শক্তিশালী করার উদ্ভাবনী উদ্যোগ দেখা যায়

যেমন ঢাকায় এখন বেশ কয়েকটি জাতীয় বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে উঠেছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে প্রতিবছর নতুন নতুন বিজ্ঞান প্রজেক্ট তৈরির প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেই সঙ্গে থাকে বিজ্ঞান মেলার মাধ্যমে উৎসবমুখর পরিবেশ।

চট্টগ্রামে এমন আয়োজনও রয়েছে, কারও একক বা গ্রুপের উদ্যোগে পরিচালিত কোনো বিজ্ঞান গবেষণা তিন মিনিটে সহজ-সরল ভাষায় প্রকাশ করার প্রতিযোগিতা। সেখানে বিচারকমণ্ডলীতে থাকেন একজন গায়ক, একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তি, একজন সাংবাদিক, একজন আইনবিশেষজ্ঞ প্রমুখ। বিজ্ঞানের কঠিন কোনো বিষয় নিয়ে পরিচালিত গবেষণার বিষয়বস্তু কত সহজ ভাষায় সবার কাছে মাত্র তিন মিনিটে তুলে ধরতে কে কত পারদর্শী, সেটা বিচারকেরা বিবেচনায় নিয়ে মূল্যায়ন করেন। তাঁদের মধ্যে মানসম্পন্ন গবেষকদের অস্ট্রেলিয়ায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বিজ্ঞানের তরুণ মেধাবী ও সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশিষ্ট বিজ্ঞান অধ্যাপকদের অধীন তিন বা ছয় মাসের গবেষণা করার সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।

আরও পড়ুন

আমাদের বিজ্ঞান ম্যাগাজিন ‘বিজ্ঞানচিন্তা’ প্রতি মাসে প্রকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে বছরে অন্তত ছয়টি বিজ্ঞান বক্তৃতা, আটটি বিজ্ঞান উৎসব, অনলাইনে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে প্রজেক্ট, ফটোগ্রাফি ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এসব উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করে। কিন্তু কুমিল্লায় একটু ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা পেলাম। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসানের সঙ্গে বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁদের কাজের ধরন ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করি। আমি শুনেছি, তিনি নিজে আগ্রহী হয়ে বিজ্ঞান সচেতনতা সৃষ্টিতে এক দারুণ উদ্ভাবনী উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি কুমিল্লা রোবোটিকস অ্যান্ড প্রোগ্রামিং ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করার পর যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন। তিনি বিজ্ঞানের প্রতি খুবই আগ্রহী।

প্রথমে তিনি তাঁদের অফিসের লাইব্রেরিটি সচল করেন এবং অফিসের সবাই যেন অবসর সময়ে নিয়মিত বই পড়েন, সে ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন, পড়াশোনার অভ্যাস না থাকলে বিজ্ঞান সচেতনতা সৃষ্টি কঠিন। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের অফিসের একেবারে পাঁচতলায় চালু করেন একটি ছোট ব্যায়ামাগার। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে কর্মীরা কাজ করবেন কীভাবে? লক্ষণীয়, তিনি পঞ্চম তলায় ব্যায়ামাগারটি করেছেন। সিঁড়ি ভেঙে সেখান উঠতেও বেশ কিছুটা ব্যায়াম হয়ে যায়। সবাই যেন অফিসের কাজের অবসরে নিয়মিত ব্যায়ামাগারে আসেন, সেদিকেও বেশ নজরদারির ব্যবস্থা রেখেছেন।

আমার মনে পড়ল, একবার সুইডেনে গিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এ রকম ব্যবস্থা দেখেছি। অফিস থেকে গাড়িতে ১০ মিনিটের পথ দূরে ব্যায়ামাগার রয়েছে। সপ্তাহে অন্তত তিন-চার দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে কর্মীদের সেখানে গিয়ে সামান্য ব্যায়াম করতে হয়। এর সুফল পেয়েছেন বলে সেই প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারকেরা সেদিন জানিয়েছিলেন। এটাও কিন্তু বিজ্ঞান। স্বাস্থ্যবিজ্ঞান!

প্রশ্ন ওঠে, ব্যয়ামের সঙ্গে বিজ্ঞানের কী সম্পর্ক? এ বিষয়ে আমরা খুব এটা সচেতন না। আসলে ব্যয়াম করলে মস্তিষ্কে নতুন নতুন নিউরন সংযোগ সৃষ্টি হয়, যা মেধার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। উন্নত চিন্তা–ভাবনার সুযোগ বাড়ায়। তাই নিয়মিত ব্যয়াম করুন। নির্মল বাতাসে ৩০ মিনিট জোরে হাঁটলেও ভালো ব্যয়াম হয়। শরীর সুস্থ থাকে। মেধার বিকাশও ঘটে।

তবে সবচেয়ে উৎসাহিত হওয়ার দিকটি হলো, নিচতলায় একটি ছোট্ট ঘরে তিনি চালু করেছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ল্যাব। সেখানে বিভিন্ন এলাকার শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে এসে বিজ্ঞান বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেন। জেলা প্রশাসক আমাকে সেই বিজ্ঞানাগারে নিয়ে গেলেন। সেখানে তখন একজন শিক্ষার্থী একটি রোবট তৈরির কাজ করছিলেন। ইতিমধ্যে একটি মজার রোবটও প্রায় তৈরি হয়ে গেছে। চাবি দিলেই রোবটের মাথা ডানে-বাঁয়ে ঘোরে, চোখ বন্ধ করে ও খোলে। চোখের মণি প্রয়োজনমতো ঘুরায়, সংকেত পাঠায়। ল্যাবে কে কী কাজ করছেন, তার তথ্য পাঠায়।

জেলা প্রশাসক তাঁর নিজের স্মার্টফোন বের করে বোতাম টিপে দেখালেন, অন্তত পাঁচটি স্কুলের ল্যাবে শিক্ষার্থীরা কাজ করছেন। তার মানে, তিনি একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন, যেন যেকোনো সময় কোন ল্যাবে কী কাজ হচ্ছে, কারও কোনো সমস্যা আছে কি না, কারও কিছু দরকার আছে কি না, সবকিছু জানা সম্ভব। ল্যাবকক্ষের এক পাশে একটি আলমারি। এর ভেতর রয়েছে বালিশ-তোশক-চাদর। এসব দেখিয়ে জেলা প্রশাসক বললেন, ল্যাবে কাজ করতে করতে কোনো শিক্ষার্থীর বেশি রাত হয়ে যেতে পারে। তাই ল্যাবেই ঘুমানোর সুযোগ রাখা হয়েছে।

বিজ্ঞান সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রশাসনের এই উদ্যোগী ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয়। প্রশাসন যেখানে এত উদ্যোগী, সেখানে বেসরকারি উদ্যোগ আরও সহজে এগিয়ে আসতে পারবে এবং এভাবে পুরো অঞ্চলে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। বিজ্ঞানের জন্য কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের এসব উদ্যোগ একটি মডেল হিসেবে গণ্য হতে পারে। আমরা চাই, জেলায় জেলায় এ ধরনের আরও অনেক উদ্ভাবনী উদ্যোগ সৃষ্টি হোক।

  • আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক এবং মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক

    [email protected]