নারী ফুটবলার: উন্নয়নের গল্পে দেখি শুভঙ্করের ফাঁকি

খুলনায় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ জেলা পর্যায়ের খেলা। এভাবে স্কুল থেকেই শুরু হয় আজকে সাফজয়ী নারী ফুটবলারদের যাত্রা
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পণ্ডিত মশাই’ গল্পের পটভূমি মনে আছে নিশ্চয়ই। ফিরিঙ্গি লাট সাহেব এন ডি বিটসন বেলের তিন ঠ্যাংয়ের কুকুরের জন্য মাসিক খরচ ছিল ৭৫ টাকা। পণ্ডিত মশাইয়ের বেতন ছিল ২৫ টাকা। এ বেতনেই আটজনের পরিবার নিয়ে পণ্ডিত মশাই জীবন নির্বাহ করতেন।

সদ্য সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের সদস্যদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান পণ্ডিত মশাইয়ের চেয়ে খুব বেশি উন্নত নয়। আমরা রাষ্ট্রের আকাশছোঁয়া উন্নয়নের গল্প শুনি। সকাল-বিকেল ইউরোপ-আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মিথ্যা স্বপ্নের বুনন তুলে ধরা হয়। এসবের বিপরীতে একজন নারী ফুটবলারের বাড়িতে ফুটো চালের যে বিবরণ আমরা গণমাধ্যমে দেখতে পেলাম, তাতে বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না যে তাঁদের কারও কারও অবস্থা পণ্ডিত মশাইয়ের চেয়েও খারাপ। হাজার কোটি টাকার নিচে কম উন্নয়নপ্রকল্পই গ্রহণ করা হয়। শুধু আমলাদের জন্যই গাড়ি, মুঠোফোনসহ নানাবিধ সুবিধা প্রদান করতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে রাষ্ট্রের। অন্যান্য খাতের আর্থিক লোপাট নাহয় বাদই দিলাম। কোটি কোটি টাকার আলোকসজ্জা করে নানা দিবস উদ্‌যাপন করা হয়।

এত জমকালো উন্নয়নের ছিটাফোঁটাও কি আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে কোনো প্রভাব ফেলেছে বা পরিবর্তন এনেছে? অথচ জীবনের ঘাটে ঘাটে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, না পাওয়ার বেদনা, হতাশা থাকার পরও বিশেষ করে পুরুষ ফুটবল ও ক্রিকেট দলের তুলনায় নারী দলের বয়সভিত্তিক ও সাফ পর্যায়ে সাফল্য বেশি। কিন্তু তাদের পেছনে রাষ্ট্রের ব্যয় যৎসামান্যই। নারী দলের সদস্যরা একরকম পেটেভাতে খেলে দলকে সাফল্য এনে দিচ্ছেন। বাফুফে নিজেই জানিয়েছে, বিনা পয়সার আবাসন ও খাবারের বিনিময়ে এই নারী দলের সদস্যরা জাতীয় দলের পক্ষে খেলেছেন। এর পাশাপাশি মাসে ৫ থেকে ১২ হাজার টাকা করে হাতখরচ দেওয়া হয়। কার্যত, এই নারীরা ফুটবলশ্রমিক। পোশাক খাতের শ্রম শোষণের সঙ্গে এই শোষণের খুব বেশি পার্থক্য নেই। গ্রামের দরিদ্র নারীরা সস্তা মূল্যে পোশাক খাতে শ্রম বিক্রি করেন। নারী ফুটবলাররাও পল্লি থেকে এসে ফুটবলের মাঠে শ্রম বিক্রি করছেন সস্তায়।

দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তির জন্য তাঁদের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। এই নারী দলের সদস্যরা যদি ফুটবলে মাঠে নিজেদের তুলে ধরতে না পারতেন, তবে তাঁদের বেশির ভাগকেই স্বরলিকা পারভীনের মতো বিবাহিত জীবনের ঘানি টানতে হতো। স্বরলিকা পারভীন বঙ্গমাতা ফুটবলের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু দারিদ্র্যের কাছে হার মেনে এখন ফুটবলের মাঠ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন। যখন বল নিয়ে মাঠে কারিকুরি করার কথা, বক্সে ক্রস বা রক্ষণভেদী সূক্ষ্ম পাস দেওয়া বা গোল করার কথা, তখন তিনি সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের হিসাব মেলাচ্ছেন কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এক পল্লিতে। স্বরলিকা দারিদ্র্যের মধ্যে হারিয়ে গেছেন। এ রকম অনেক স্বরলিকা ফুটবলের মাঠ, স্কুলের ক্লাস থেকে হারিয়ে গেছেন।

আরও পড়ুন

আমাদের নারী ফুটবলাররা একেকজন পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের ‘আসমানী’র একবিংশ শতাব্দীর রূপ। তাঁদের ঘরে খাবার থাকে না। বৃষ্টির দিনে চালের ফুটো চুইয়ে পানি পড়ে। এসব নিছক গল্প নয়। দেশে নারী ফুটবল–বিপ্লবের পাদপীঠ ময়মনসিংহের কলসিন্দুর। এ গ্রামের মেয়ে ফুটবলারদের নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিল প্রথম আলো। তথ্যচিত্র নির্মাণের সময় আজকের সানজিদা, মারিয়া, মার্জিয়া, সামসুন্নাহারদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তথ্যচিত্র নির্মাণে সহযোগিতার বিনিময়ে তাঁরা কী চান? উত্তরে তাঁরা বলেছিলেন, দুপুরের খাবার দিলেই হবে। এরপর তথ্যচিত্রের নির্মাতা জানতে চেয়েছিলেন, তাঁরা আরও কিছু চান কি না। এবার তাঁরা বলেন, বেশি করে খাবার দিতে, যেন বাড়িতে নিয়ে তাঁরা খেতে পারেন। এ গল্প খুব বেশি দিন আগের নয়।

আজকে নারী ফুটবলের সাফল্য নানাজন নানাভাবে চিত্রায়িত করছেন। ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা ও সামাজিক বিধিনিষেধকে তাঁরা জয় করেছেন বলে দিকে দিকে জয়োল্লাস করা হচ্ছে। আমরা সবাই নারী দলের এ সাফল্যে বুঁদ হয়ে আছি। সাফল্যের উত্তেজনা, আবেগ ও আবেশ অতিক্রম করে ঘোর থেকে এখন মনে হয় বাস্তবে ফিরে আসার সময় হয়েছে।

সরকারের ভাষায় চারদিকেই রীতিমতো উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। দেশের মানুষ নাকি এখন চার বেলা খায়। তাহলে রুপনা চাকমা, আঁখি খাতুন, মাসুরা পারভীন, কৃষ্ণা রানী, মারিয়া মান্দা, স্বরলিকা পারভীনদের ঘরবাড়ির বেহাল কেন? ঘরে খাবার থাকে না কেন? কেন একটি খাবারের মুখ কমাতে গিয়ে স্বরলিকাকে বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয়? আমাদের ফুটবলের বীর নারীদের উন্নয়নের ভাগ কোথায়? কারা তাঁদের হিস্যায় ভাগ বসাল?

এই নারী ফুটবল দলের সবাই মফস্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে এসেছেন। তাঁরা সবাই কঠোর লড়াই–সংগ্রাম করে নিজেদের অবস্থান তৈরি করছেন। ফুটবলার সানজিদা আক্তারের ফেসবুক স্ট্যাটাসেই বিষয়গুলো পরিষ্কার করে দিয়েছেন। ফুটবল মাঠে তাঁরা শুধু খেলোয়াড়ই নন, সবাই একেকজন যোদ্ধার চরিত্রে মাঠে নেমেছিলেন। তাঁদের কেউ বাবাকে হারিয়েছেন। কেউ মায়ের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে মাঠে এসেছেন। কেউ বোনের গয়না বিক্রি করে মাঠের খরচ জুগিয়েছেন।

কিন্তু তাঁদের এ সাফল্যের পেছনের রাষ্ট্রের অবদান নিতান্তই নগণ্য। রাষ্ট্র থেকে নাগরিক হিসেবে প্রাপ্যটুকুও তাঁরা পাননি। আজ আমাদের কর্তাব্যক্তিরা এসব মেয়ের সাফল্যে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। দৃষ্টিকটুভাবে মেয়েদের পেছনে দাঁড় করিয়ে নিজেরাই ফুলের মালা গলায় পরে ছবি তুলছেন। সংবাদ সম্মেলন করছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ সাফল্য অর্জনে তাঁদের অবদান নেহাত কম; বরং আছে না দিতে পারার দায়।

এখন মেয়েদের লাখ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। বাড়ি করে দেওয়া হচ্ছে। জমি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আজ যদি মাসুরা পারভীন জাতীয় দলের না খেলতে পারতেন, আঁখি খাতুন রক্ষণের দেয়াল হয়ে না দাঁড়িয়ে যেতেন বা রুপনা চাকমা গ্লাভস হাতে নিয়ে গোলপোস্টে অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে না দাঁড়াতেন, তাহলে কি সরকার তাঁদের বাড়ি করে দিতো, জমি দিতো? দিতো না। এত টাকা উপহার কি পেতেন? না পেতেন না। বরং স্বরলিকা পারভীনের মতো হারিয়ে যেতেন জীবনের হিসাব মেলাতে গিয়ে।

আঁখি খাতুন, সামসুন্নাহার, নিলুফার, মারিয়া মান্দা, রুপনা চাকমা, ঋতুপর্ণা, সোহাগী কিস্কু, ইতি রানী, স্বপ্না রানী বা কৃষ্ণা রানীদের গল্প অনেকটা একই। তাঁদের প্রায় সবাই নতুন দিনের ‘আসমানী’। তাঁদের জীবনের চালে ফুটো আছে। বৃষ্টি হলেই দারিদ্র্যের টুপটাপ পানি তাঁদের ভাসিয়ে দেয়। তাই সাময়িক অর্থ প্রদান বা বাড়ি করে দেওয়া কোনো সমাধান না; বরং তাঁদের দুরবস্থাকেই প্রকাশ করে দেয়। আবার রাষ্ট্র থেকে জমি নিয়ে তাঁরা বিপাকে পড়েছেন। আঁখি খাতুনকে দেওয়া জমির মালিকানা নিয়ে সরকারদলীয় নেতার সঙ্গে বিরোধ আছে। পুলিশ গিয়ে আঁখি খাতুনের বাবার কাছে সাদা কাগজে সইয়ের জন্য জবরদস্তি করেছে। ধরে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে। সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত মাসুরার জমি সড়ক ও জনপদ বিভাগ উচ্ছেদের জন্য লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত করেছে। এমনকি বিমানবন্দরে তাঁদের লাগেজগুলোও চুরির শিকার হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার খবরও আমরা দেখতে পাই।

আরও পড়ুন

নারীদের ফুটবলে সাফল্য উন্নয়নের লুকোচুরির গল্প, দুর্নীতি, স্থানীয় রাজনীতির পেশিশক্তির প্রয়োগ, চুরি—একসঙ্গে অনেক কিছুই আরও একবার সবার সামনে নিয়ে এসেছে। তাঁদের সাফল্যের চিত্রনাট্যে আমাদের রাষ্ট্রের অনাকাঙ্ক্ষিত এমন কোনো বিষয় নেই, যা প্রতিফলিত হয়নি। তাই ফুটবল তাঁদের কাছে জীবন–মরণের লড়াই। কারও জমি রক্ষার লড়াই। কারও বাড়ি রক্ষার লড়াই। এ খেলায় তাঁরা হেরে গেলে তাঁদের জমিজিরাত, জীবন–জীবিকার কী অবস্থা হতো, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এ রকম অবস্থায় দাঁড়ানো কোনো দল হারে না। হারতে পারে না। তারাও হারেনি।

অথচ দেখুন, শিরোপা জয়ের পর নারী ফুটবলারদের চাহিদা খুব বেশি কিছু নয়। তাঁদের কথায় নারী ফুটবলের উন্নয়নের আলাপ খুব কমই এসেছে। বেশির ভাগই জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা চাইছেন। জমি–বাড়ির রক্ষার আবেদন জানিয়েছেন। মাসুরা তাঁর বাবাকে মোটরভ্যান কিনে দেবেন। ঋতুপর্ণা বেশি কিছু চাননি; রাঙামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামের সড়কটি ঠিক করে দিতে বলেছেন। তাঁদের বয়স বেশি নয়। সাবিনা খাতুন বাদে সবারই গড় বয়স কুড়ির আশপাশে। অথচ তাঁরাই পরিবার ও এলাকার উন্নয়নের দাবি নিয়ে সামনে হাজির হয়েছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব তাঁদের চাইতে হবে কেন? উন্নয়ন সূচকের হিসাব অনুসারে আমরা তো অনেক এগিয়েছি। আমাদের দেশ নাকি সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, কানাডা হয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের মেরিন ড্রাইভে গিয়ে অনেকের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরা ইউরোপে চলে গিয়েছেন। নিজের টাকায় নিজের সেতু বলে পদ্মা সেতুতে গিয়ে আমরা সেলফি তুলছি। মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে। দেশে এখন হাজার কোটি টাকার নিচে কোনো দুর্নীতি হয় না। ইভ্যালির মতো অনলাইন শপিং প্রতিষ্ঠানের নাকি ৪৭ হাজার কোটি টাকার হিসাব নেই। কোনো বিদ্যুৎ না দিয়েই বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ৯০ হাজার কোটি টাকা পকেটে পুরেছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল না চাইলেও আট হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচনের জন্য ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনা হচ্ছে।

সরকারের ভাষায় চারদিকেই রীতিমতো উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। দেশের মানুষ নাকি এখন চার বেলা খায়। তাহলে রুপনা চাকমা, আঁখি খাতুন, মাসুরা পারভীন, কৃষ্ণা রানী, মারিয়া মান্দা, স্বরলিকা পারভীনদের ঘরবাড়ির বেহাল কেন? ঘরে খাবার থাকে না কেন? কেন একটি খাবারের মুখ কমাতে গিয়ে স্বরলিকাকে বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয়? আমাদের ফুটবলের বীর নারীদের উন্নয়নের ভাগ কোথায়? কারা তাঁদের হিস্যায় ভাগ বসাল? কেন ফুটবলে সাফল্যের পর বাড়ি–অর্থের জন্য হাত পাততে হয়? এসব তো তাঁদের অধিকার। এই অধিকার থেকে তাঁদের বঞ্চিত করল কারা? অধিকার কেন ভিক্ষা করতে হবে? উন্নয়নের গল্পে এই শুভঙ্করের ফাঁকিটা কি এখানে ধরা পড়ে না? বলতে হয়, আঁখি খাতুন, রুপনা চাকমারাই আমাদের বাস্তব জীবনের রূঢ় প্রতিচ্ছবি।

  • ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক