শব্দদূষণ নীরব নয়, সরব ঘাতক

শব্দদূষণ বন্ধের দাবি নিয়ে প্ল্যাকার্ডসহ একাই আন্দোলন করছেন সুজন বড়ুয়া নামের এই ব্যক্তি। ২০২২ সালের অক্টোবর।
ছবি: সৌরভ দাশ

২৬ এপ্রিল ২০২৩। অসুস্থ থাকায় অফিসে যেতে পারিনি; তাই বাসাতেই ছিলাম। দুপুরে যখন সামান্য ঘুমের প্রতীক্ষায়, ঠিক তখনই নড়েচড়ে উঠলাম মুঠোফোনে মেসেজ বা বার্তা আসার শব্দে। মুঠোফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল, ‘আজ আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস। শব্দদূষণ একটি নীরব ঘাতক। আসুন, শব্দদূষণ বন্ধে আমরা সকলে সচেতন ভূমিকা রাখি।’ বার্তাটি এসেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে।

‘আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস’ বলে আলাদা কোনো দিবসের অস্তিত্ব আছে বলে আমার আগে জানা ছিল না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে প্রতিটি দিনই কোনো না কোনো দিবস। তাই এসব দিবস আজকাল আর আমাদের মনের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না; জীবনচর্চায় প্রভাব ফেলা তো দূরের কথা। ২৭ এপ্রিল প্রথম আলো শব্দ সচেতনতা দিবস নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে ঢাকা নগরের শব্দদূষণের ভয়াবহতা নির্মমভাবে ফুটে উঠেছে। প্রশ্ন হলো, সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা, এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত যে দূষণ সশব্দে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে, সেই দূষণ নীরব ঘাতক হয় কী করে?

ঢাকা শহরের শব্দদূষণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। নগরের রাস্তায় শব্দদূষণের ভয়াবহতা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। গাড়ির হর্ন, অ্যাম্বুলেন্সের মাত্রাতিরিক্ত শব্দ, গণপরিবহন এবং রাস্তার খিস্তি আর হকারের উপদ্রবে রাস্তায় বের হলেই মাথা ঝিনঝিন করে। এসব শব্দের ঘনত্ব এতটাই বেশি যে গাড়ির কাচ বন্ধ রেখেও কিছুমাত্র রেহাই পাওয়া যায় না। পথচারী আর গণপরিবহন ব্যবহারকারীর কথা নাইবা বললাম। আগে শব্দদূষণের অস্তিত্ব টের পেতাম রাস্তায়, গণপরিবহনে কিংবা বাড়ির বাইরে। কিন্তু আজকাল বাড়িতে বসেও রেহাই মেলে না এসব যন্ত্রণা থেকে। দিন দিন বেড়েই চলেছে এই অত্যাচার। এই যে সপ্তাহান্তে বাসায় বসে এই লেখা লিখছি, আমার চারপাশ থেকে কেবলই ভেসে আসছে বিভিন্ন শব্দ।

মাটি, পানি কিংবা বায়ুদূষণ উপলব্ধি করতে কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু শব্দদূষণ সরাসরি আঘাত হানে আমাদের কানে, হৃদয়ে আর মগজে। তাই শব্দদূষণকে নীরব ঘাতক বলার আর কোনো সুযোগ নেই। শব্দদূষণকে নীরব ঘাতক বলার মাধ্যমে বিষয়টির গুরুত্বকে হালকা করে দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়। শব্দদূষণ বিধিমালা ২০০৬-এর সংশোধন এখন সময়ের দাবি। তবে শব্দদূষণ প্রতিরোধে অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারে জনসচেতনতা। এই জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রয়োজন ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা। তবে এই প্রচার-প্রচারণা যেন আবার শব্দদূষণের উৎপত্তিস্থল না হয়ে ওঠে সেদিকেও লক্ষ রাখা চাই।

ভিক্ষুকেরা আজকাল আর খালি গলায় কেঁদেকেটে ভিক্ষা করে না। তারা ভিক্ষা করে উচ্চ শব্দে রেকর্ড বাজিয়ে। ছুটির দিনে একটু বেশি ঘুমাবেন, তার উপায় নেই। আদা, রসুন, পেঁয়াজ, আলু, মাছ আর শাকসবজির গাড়ি নিয়ে বিক্রেতারা নগরের অলিগলিতে বিচরণ করছেন। শুধু মুখে হাঁকডাক করার দিন এখন শেষ। তাঁরা এখন হাঁকডাক করেন হাতমাইক বাজিয়ে। আপনি ২০ তলার ওপরেই থাকুন কিংবা এক কিলোমিটার দূরে, তাদের ডাক এড়াতে পারবেন না কিছুতেই। নগরের অলিগলিতে সশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পুরোনো পেপার সংগ্রহকারী, ভাঙারি ব্যবসায়ী, ইঁদুর-উইপোকা-ছারপোকা-তেলাপোকা নিধনকারী, শিলপাটা ধারকাটাওয়ালা, লেপ-তোশক-বালিশওয়ালা কিংবা গ্যাসের চুলা ঠিক করার মিস্ত্রি। মোরগ-মুরগি বিক্রেতাদের বিরক্তিকর ডাক শুধু কানে নয়, মগজে অস্থিরতা তৈরি করে।

নগরে লাগালাগি ফ্ল্যাটে আছে পারিবারিক কোন্দলের কর্কশ শব্দ, নারী ও শিশুর কান্না। এই নগরে কোনো দিন বন্ধ হয় না বিভিন্ন স্থাপনার নির্মাণকাজ। পাইলিং, ড্রিল মেশিনের শব্দ, রড আর টাইলস কাটার শব্দে অস্থির নগরজীবন। শব্দদূষণ বিধিমালা ২০০৬-এ নির্মাণকাজের ব্যাপ্তি ও সময় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও এর বাস্তবায়ন কোথাও চোখে পড়ে না। এসব আইনকানুন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জানাশোনাও খুব কম। এই তো কিছুদিন আগে রাত ১২টায় জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করে থামাতে হয়েছে বাসার পার্শ্ববর্তী স্থানে গৃহনির্মাণের কর্মযজ্ঞ। গায়েহলুদ, জন্মদিন কিংবা বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে গানবাজনা রাত ১০টার মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা শেষ হয় কোথায়?

মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ ধর্মীয় উপাসনালয়কে বিধিমালার বাইরে রাখা হয়েছে। একইভাবে ওয়াজ মাহফিল, নামকীর্তন, সাহ্‌রি-ইফতারের সময়ের প্রচারণাকেও বিধিমুক্ত রাখা হয়েছে। প্রাজ্ঞ ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ ব্যাপারে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে এবং বিষয়গুলো বিধিমালার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

বিভিন্ন ধরনের শব্দ বিপর্যস্ত করে তুলছে আমাদের নগরজীবন। যেন কোনো প্রতিকার নেই এই দূষণের! শব্দদূষণের অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে কখনো কারও শাস্তি পাওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করিনি। অথচ এ-সংক্রান্ত আইন আছে, আছে শাস্তির ব্যবস্থা। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০১৭ সালে যেখানে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ থাকত দিনের ১২ ঘণ্টা, এখন সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ ঘণ্টা। শব্দদূষণ বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, ঢাকার জন্য দিনের বেলায় শব্দের আদর্শ মান ৬০ ডেসিবেল। অথচ স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা ৭৬ দশমিক ৮০ ডেসিবেল এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা ৮০ দশমিক ৫৬ ডেসিবেল। শব্দদূষণের কারণে আমাদের শ্রবণশক্তি কমে যাচ্ছে, বধিরতা বাড়ছে, মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে, হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ছে, শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

আরও পড়ুন

মাটি, পানি কিংবা বায়ুদূষণ উপলব্ধি করতে কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু শব্দদূষণ সরাসরি আঘাত হানে আমাদের কানে, হৃদয়ে আর মগজে। তাই শব্দদূষণকে নীরব ঘাতক বলার আর কোনো সুযোগ নেই। শব্দদূষণকে নীরব ঘাতক বলার মাধ্যমে বিষয়টির গুরুত্বকে হালকা করে দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়। শব্দদূষণ বিধিমালা ২০০৬-এর সংশোধন এখন সময়ের দাবি। তবে শব্দদূষণ প্রতিরোধে অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারে জনসচেতনতা। এই জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রয়োজন ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা। তবে এই প্রচার-প্রচারণা যেন আবার শব্দদূষণের উৎপত্তিস্থল না হয়ে ওঠে সেদিকেও লক্ষ রাখা চাই।

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
    [email protected]