গাজা, যেখানে আশার রং কালো

গাজায় দুর্ভিক্ষ ধেয়ে আসছে, যুদ্ধে যত লোক মারা গেছে, তার বহুগুণ মারা যাবে ক্ষুধায় ও রোগভোগেছবি: রয়টার্স

আমি ১০ বছর বয়সের ইয়াজান কাফারনেহর ছবিটি দেখছি। দক্ষিণ গাজার এক অস্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্রে তোলা ছবিটি, নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। মানুষ নয়, মনে হয় কোনো কঙ্কাল অথবা কঙ্কালের মুখোশ পরে আছে কেউ। এই কঙ্কালের নিচেই একটি জীবন্ত শিশু যে প্রতিটি মুহূর্ত অনিবার্য মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে। টাইমস জানাচ্ছে, এই ছবি প্রকাশের অব্যবহিত পরেই মৃত্যু হয়েছে ইয়াজানের।

শুধু ইয়াজান নয়, এভাবে ক্রমেই মৃত্যুর মুখে বাস্তুচ্যুত, আশ্রয়হীন ১২ লাখ গাজাবাসী। দুর্ভিক্ষ ধেয়ে আসছে, যুদ্ধে যত লোক মারা গেছে, তার বহুগুণ মারা যাবে ক্ষুধায় ও রোগভোগে। যেসব শিশু টিকে যাবে, তাদের অনেকেই অকালবৃদ্ধ হবে, শারীরিক পূর্ণতা পাবে না।

গাজায় ইয়াজানের মতো আর কত শিশু, নারী ও পুরুষের মৃত্যু হলে পৃথিবীর মানুষ ও তার ক্ষমতাধর নেতারা জেগে উঠবে?

আরও পড়ুন

সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো আরব দেশগুলোর প্রতিক্রিয়ায়। আমি মনোযোগ দিয়ে চলতি সময়ের একাধিক আরব পত্রপত্রিকা পড়ার চেষ্টা করেছি। সেসব পড়ে মনে হবে, গাজার এই অভাবিত দুর্যোগ স্বাভাবিক একটি ঘটনা, আরও পাঁচটি ঘটনার মতোই একটি। আল-আহরামের প্রধান খবর, সরকার টুকটুক বা বেবিট্যাক্সির বিদ্যুতায়ন প্রকল্প অনুমোদন করেছে। গালফ নিউজ জানাচ্ছে, দুবাই এয়ারপোর্টের রানওয়েতে প্রথমবারের মতো ইফতারের ব্যবস্থা হয়েছে। সৌদি পত্রিকার শীর্ষ সংবাদ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রসারে ৪০ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

মানুষ মরছে গাজায়, আরও মরবে। যত দিন যাচ্ছে, ব্যাপারটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠছে। খাচ্ছিদাচ্ছি, কোথাও কোনো কিছুর কমতি নেই।

এদিকে যুদ্ধোত্তর গাজাকে নিয়ে কী করা যায়, তা নিয়ে ইসরায়েলি ও আমেরিকানদের ঘুম হারামের উপক্রম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বৃদ্ধ মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে একটি নতুন সরকার গঠন করতে, যেখানে এমন সব ‘টেকনোক্রেটিক’ লোকজন থাকবে, যাদের সঙ্গে ফিলিস্তিনি জনগণের সামান্য যোগাযোগটুকুও নেই।

বোঝাই যাচ্ছে, এই সরকারের কাজ হবে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ রক্ষা নয়, ইসরায়েল ও আমেরিকার মন জুগিয়ে চলা।

অন্যদিকে ইসরায়েলের নেতানিয়াহু সরকারের একাধিক মন্ত্রী প্রস্তাব করেছেন, উত্তর গাজার বহিষ্কৃত ফিলিস্তিনিদের পরিত্যক্ত আবাসিক এলাকায় নতুন করে ইহুদি বসতি গড়ে তোলা হোক। যেসব ইসরায়েলি সৈন্য এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তাদের পুরস্কার হিসেবে এখানে বিনা মূল্যে জমি বিতরণ করা হবে। অনুমান করি, যে যত বেশি ফিলিস্তিনি হত্যা করেছে, তার জন্য দেওয়া হবে তত বড় বসতবাড়ির স্থান।

এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার প্রস্তাব করেছেন, গাজার সমুদ্রতীরবর্তী এলাকাকে বিদেশি পর্যটকদের জন্য পুনর্নির্মাণ করা হোক। ‘সমুদ্রের পাশে এই জায়গা খুবই মূল্যবান সম্পদ, একে কাজে লাগানো গেলে তা খুবই লাভবান প্রমাণিত হতে পারে,’ তিনি বলেছেন।

প্রায় একই প্রস্তাব দিয়েছেন নিউইয়র্ক টাইমস-এর কলাম লেখক ব্রেট স্টিফেন্স। তিনি বলছেন, কোনো স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের কথা না ভেবে বরং গাজায় ও অবশিষ্ট ফিলিস্তিনে কীভাবে দুবাইয়ের ধাঁচে আধুনিক বিলাস নগরী হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া হোক। ভদ্রলোক এই প্রস্তাবকে ‘আরব ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন’ নাম দিয়েছেন।

নেতানিয়াহুর এই ত্যাড়া ঘাড় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য বড় রকমের ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। তিনি এখন পর্যন্ত ইসরায়েলকে কার্যত কোনো শর্ত ছাড়াই গাজায় ফিলিস্তিনি জাতি হত্যায় সমর্থন দিয়ে গেছেন। ইসরায়েলে ও আমেরিকায় ইহুদিরা সে কারণে বাইডেনের কাছে কৃতজ্ঞ।

প্রায় একই প্রস্তাব দিয়েছেন নিউইয়র্ক টাইমস-এর কলাম লেখক ব্রেট স্টিফেন্স। তিনি বলছেন, কোনো স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের কথা না ভেবে বরং গাজায় ও অবশিষ্ট ফিলিস্তিনে কীভাবে দুবাইয়ের ধাঁচে আধুনিক বিলাস নগরী হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া হোক। ভদ্রলোক এই প্রস্তাবকে ‘আরব ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন’ নাম দিয়েছেন। একসময় ফিলিস্তিন ছিল ব্রিটিশ ম্যান্ডেট, অর্থাৎ তার শাসনভার ছিল ব্রিটিশ রাজের। সে ম্যান্ডেট শেষ হওয়ার ৭৫ বছর পর আরেক ম্যান্ডেটের এই প্রস্তাব যে একটি নব ঔপনিবেশিক পরিকল্পনা, তা বুঝতে কারও তেমন বেগ পাওয়ার কথা নয়।

এই মুহূর্তে সবার আগে প্রয়োজন গাজায় যুদ্ধবিরতি। সবাই এই ব্যাপারে একমত, শুধু একমত নন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তার কারণটাও স্পষ্ট। বর্তমানে ইসরায়েলে তাঁর প্রতি জনসমর্থন ১০ শতাংশের কম। নতুন নির্বাচন হলে তাঁর পরাজয় অনিবার্য। এ কথা সবাই মানে, তিনি ক্ষমতায় টিকে আছেন শুধু চলমান যুদ্ধের কারণে। যুদ্ধ থামামাত্রই তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে। ফলে আমেরিকান ধমক ও সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি যেকোনো মূল্যে যত দিন সম্ভব যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।

নেতানিয়াহুর এই ত্যাড়া ঘাড় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য বড় রকমের ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। তিনি এখন পর্যন্ত ইসরায়েলকে কার্যত কোনো শর্ত ছাড়াই গাজায় ফিলিস্তিনি জাতি হত্যায় সমর্থন দিয়ে গেছেন। ইসরায়েলে ও আমেরিকায় ইহুদিরা সে কারণে বাইডেনের কাছে কৃতজ্ঞ।

কিন্তু জাতি হত্যার খবর যত প্রচার পেয়েছে, আমেরিকার ভেতর মুসলিম ও প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাট ভোটারদের মধ্যে বাইডেনের ইসরায়েল-তোষণ নীতি তত সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এ বছরের নভেম্বরে তাঁকে নির্বাচনে দাঁড়াতে হবে। এই নির্বাচনে তথাকথিত ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটস’গুলোতে আরব ও মুসলমান ভোটাররা যদি বেঁকে বসেন, যার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে— নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়া বাইডেনের জন্য কঠিন হবে।

সে কারণেই তোড়জোড় শুরু হয়েছে নেতানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে সাবেক যুদ্ধমন্ত্রী বেনি গানজকে তাঁর জায়গায় বসানো। মার্কিন সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের নেতা সিনেটর চাক শুমার স্পষ্টভাবেই বলেছেন, শান্তির খাতিরে নেতানিয়াহুকে সরে যেতে হবে। বাইডেনের অনুমতি ছাড়া এ কথা তিনি বলেছেন মনে হয় না। সম্ভবত, যে কথা বাইডেন নিজে বলতে পারেননি, সে কথাই তিনি শুমারকে দিয়ে বলিয়েছেন। দুই সপ্তাহ আগে বেনি গানজ নেতানিয়াহুর নিষেধ অমান্য করে হোয়াইট হাউসে এসে বৈঠক করে গেছেন। অনুমান করি, পরবর্তী ইসরায়েলি সরকার নিয়েই তাঁরা কথা বলেছেন।

অন্যদিকে কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় হামাস যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে ইসরায়েলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা গোঁ ধরে আছে, শুধু ছয় সপ্তাহের নয়, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে হবে এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সামরিক উপস্থিতি সরিয়ে নিতে হবে। পায়ের নিচে শেষ মাটিটুকু ধরে রাখতে এটি হামাসের শেষ চেষ্টা। বলা বাহুল্য, ইসরায়েল বা আমেরিকা কেউই হামাসের সে শর্ত মানতে প্রস্তুত নয়।

ঠিক কত দিন যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে হামাস ও ইসরায়েলের এই দড়ি-টানাটানি চলবে, তা বলা মুশকিল। তবে গাজার ব্যাপারে ‘টোকেন’ একটা কিছু বাইডেন প্রশাসনকে করতেই হবে, এ কথায় কোনো ভুল নেই। সে কারণেই ত্রাণের নামে সমুদ্রসেতু বানানো হয়েছে, যার মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের চেষ্টা চলছে। ইসরায়েলি তল্লাশি ও তদারকি শেষে সে ত্রাণের খুব সামান্যই যথাসময়ে গাজাবাসীর হাতে পৌঁছাচ্ছে।

বিমান থেকে ত্রাণ বিতরণের একটি কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হয়েছে। কত মানুষের হাতে পৌঁছেছে জানি না, তবে সে ত্রাণ কুড়াতে গিয়ে কয়েক ডজন গাজাবাসী হতাহত হয়েছে। একদিকে এই ত্রাণ তৎপরতা, অন্যদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রেরণ, বাইডেন প্রশাসন দুটোই অব্যাহত রেখেছে।

জাতিসংঘ বলেছে, গাজা এখন মৃত্যুপুরী। আমাদের চোখের সামনে, যার যার বসার ঘরে টিভির পর্দায় পৃথিবীর মানুষের চোখের সামনেই কীভাবে এই মৃত্যুপুরী গড়ে উঠল, তা দেখেছে। ঠিক যেমন দেখেছে ইয়াজিন কাফারনেহর মৃত্যু। আরও অসংখ্য কাফারনেহ মৃত্যুর অপেক্ষায় রয়েছে।

রুশ কবি ইরিনা রাতুশিন্সকাইয়া রুশ কারাগারের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখেছিলেন, এখানে আশার রং ধূসর। গাজায় আশার রং ধূসর নয়, ঘন তমসাময় কালো।

● হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক