সাহিত্য ও রাজনীতি উভয়ের বিকাশের পূর্বশর্ত জবাবদিহির সংস্কৃতি

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জিয়া হায়দার রহমান। ২০১৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো উপন্যাস সমালোচক মহলে বেশ প্রশংসিত হয়। বইটি বহু ভাষায় অনূদিত হয় এবং ব্রিটেনের ‘জেমস টেইট ব্ল্যাক মেমোরিয়াল পুরস্কার’–এর মতো সম্মাননাও পান তিনি। সম্প্রতি বাংলা একাডেমিতে ‘দ্য পলিটিকস অব লিটারেচার’ শিরোনামে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তৃতা করেন তিনি। তাঁর ওই বক্তৃতানির্ভর একটি লেখা প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করে দুই পর্বে প্রকাশ করা হলো। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব।

বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত ‘পলিটিকস অব লিটারেচার’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন জিয়া হায়দার রহমান। ১১ নভেম্বর ২০২৫ছবি: দীপু মালাকার

দ্য থার্ড ম্যান চলচ্চিত্রে হ্যারি লাইম চরিত্রে অভিনয় করেছেন অরসন ওয়েলস। ওই চলচ্চিত্রে তাঁর একটি সংলাপ ছিল এমন—‘ইতালিতে বোর্জিয়া পরিবারের শাসনের ৩০ বছরে যুদ্ধ, আতঙ্ক, হত্যা আর রক্তপাত চলেছিল, কিন্তু তারা তৈরি করেছিল মাইকেলেঞ্জেলো ও লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মতো শিল্পী আর রেনেসাঁ। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডে ছিল ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ভালোবাসা, ৫০০ বছরের গণতন্ত্র ও শান্তি, অথচ তারা কী সৃষ্টি করল? কুকু ক্লক বা কোকিল ঘড়ি।’

ঔপন্যাসিক গ্রাহাম গ্রিন এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের সহলেখক ছিলেন। তাঁর ভাষায়, এটি এই চলচ্চিত্রের সেরা সংলাপ। আর তিনি দাবি করেন, সংলাপটি ওয়েলস নিজেই লিখেছিলেন।

এই লাইন আজ এমন একটি ধারণার প্রতীক হয়ে উঠেছে যে দুঃখ, কষ্ট ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্য থেকেই জন্ম নেয় শিল্প–সাহিত্য। আমি অবশ্য স্বীকার করব, আমিও একসময় একই মনোভাব নিয়েই এই উক্তি ব্যবহার করেছি।

যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার (ব্রেক্সিট) গণভোটের পরপরই নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক সাক্ষাৎকারে ফিলিপ পুলম্যান, এলিফ শাফাকসহ পাঁচজন লেখক ও শিল্পীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল—ব্রেক্সিট শিল্প-সাহিত্যের ওপর কোন ধরনের প্রভাব ফেলবে। পাঁচজনের মধ্যে চারজনেরই মত ছিল, এটি তাঁদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আমি তখন দ্য থার্ড ম্যান-এর সেই উক্তিটি উদ্ধৃত করে বলেছিলাম, ব্রেক্সিট ঘিরে এই ক্রান্তিকাল হয়তো ইংরেজি সাহিত্যে এক নতুন স্বর্ণযুগ আনতে পারে। এটি লেখকদের আত্মতুষ্টি ও সম্মতি উৎপাদনের ধারা থেকে বের করে আনবে, যেটা একুশ শতকের ব্রিটিশ সাহিত্যের একটি বড় অংশজুড়ে দেখা যায়।

কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। সাহিত্যের বিকাশের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ প্রয়োজন। একটি সুস্থ সাহিত্যচর্চার পরিবেশ সর্বতোভাবেই একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। অবশ্য এমন অনেক সাহিত্যিকের উদাহরণ আমরা দেখতে পাই, যাঁরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও লিখেছেন। কিন্তু সেগুলো ব্যতিক্রম, সাধারণ নিয়ম নয়।

আরও পড়ুন

সেগুলো সামগ্রিক চিত্রকে ক্ষুণ্ন করে না, সেই সামগ্রিক চিত্রটি হলো সাহিত্যের জন্য প্রয়োজন কল্পনার স্বাধীনতার একটি পরিবেশ, এমনকি সেই স্বাধীনতার সীমা বিশেষ কোনো লেখার মাধ্যমে নির্ধারিত না হলেও। আমি এখানে সেই রাজনৈতিক পরিবেশ খতিয়ে দেখতে চাই; কারণ, স্পষ্ট করে বললে সাহিত্যের রাজনৈতিক পরিবেশই হলো একটি মুক্ত সমাজের রাজনৈতিক পরিবেশ।

অবশ্য তার আগে বলে রাখা ভালো—যদি আপনি ইতিমধ্যে ভুলটা ধরতে না পারেন, তাহলে জেনে রাখুন—অরসন ওয়েলস বা তাঁর চরিত্র হ্যারি লাইম বাস্তব তথ্যের দিক থেকে ভুল বলেছিলেন। কোকিল ঘড়ি আসলে সুইজারল্যান্ডে নয়, তৈরি হয়েছিল জার্মানির বাভারিয়া অঞ্চলে।

তা ছাড়া গত ৫০০ বছরে ইউরোপের অস্থিরতার ইতিহাসের মধ্যে সুইজারল্যান্ড কখনোই পুরোপুরি শান্তির দ্বীপ ছিল না। তবু স্বীকার করতেই হবে—এই সংলাপগুলো দারুণ, বিশেষত যখন সেগুলো উচ্চারণ করেন অরসন ওয়েলসের মতো একজন অভিনেতা।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জিয়া হায়দার রহমান। ২০১৪ সালে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো’।
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

২.

সম্প্রতি ঢাকায় খোলা স্থানে আমার একটি বক্তৃতা ছিল। হঠাৎ বৃষ্টি নামায় সবাই ঘরের মধ্যে চলে যান প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য। আর সেই সুযোগে প্রশ্নোত্তর পর্বটি আরও ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতায় রূপ নেয়।

একপর্যায়ে আমি শ্রোতাদের একটি প্রশ্ন করেছিলাম। আমার উপলব্ধি ছিল, বাংলাদেশ একনায়ককে উৎখাত করেছে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে, যার বেশির ভাগ সদস্যই ঢাকার উদারনৈতিক এনজিও ঘরানার মানুষ।

আমি শ্রোতাদের জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁরা কি এখন সত্যিই স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছেন এবং তাঁদের মতপ্রকাশ করতে পারছেন? অবশ্যই ‘না’। সবাই মাথা নেড়ে সায় দিলেন এবং সেই ঘনিষ্ঠ পরিবেশে একটি সুরই প্রতিধ্বনিত হলো। তাঁরা মুক্তভাবে কথা বলতে পারছিলেন না।

যখন ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তখন স্বভাবতই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োগের কথাটি ঘুরেফিরে আসে। এটা স্পষ্ট, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে একটি স্বৈরাচারী সরকার এ ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগের ওপরই জোর দিয়েছে।

শেখ হাসিনার সরকার কোনো রাখঢাক না করেই এবং নির্লজ্জভাবে নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কঠোরভাবে সীমিত করেছে—কখনো কঠোর আইন প্রণয়ন করে, কখনো গুন্ডা বাহিনী ও অনুগত পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে।

৩.

২০১৪ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনাকীর্ণ মিলনায়তনে একটি বক্তৃতা দিই। বক্তৃতার শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ: ল্যান্ড অব ডেড আইডিয়াস’। সেখানে আমি মূলত আওয়ামী লাগ সরকার এবং বিশেষ করে তাদের সাজানো আদালতগুলোর সমালোচনা করি।

তবে আমার আলোচনার মূল অংশটি কেন্দ্রীভূত ছিল, আমার মতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর রাজনৈতিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট জটের ওপর, যা নতুন চিন্তা জন্ম নেওয়ার আগেই কীভাবে তাকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে। আর তাই, তেমনটিই আমি তখন ওই শিরোনামে ইঙ্গিত করেছিলাম।

ওই বক্তৃতার পরদিন ভোরে আমি যুক্তরাজ্যে ফিরে যাই। দুই দিন পর আমার বাবা মারা যান। পরবর্তী ১০ দিন আমার বক্তৃতা নিয়ে দেশে যে শোরগোল শুরু হয়ে গিয়েছিল, সে সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না।

দুই সপ্তাহ পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণকৃত বক্তৃতার ভিডিওটি আমার হাতে আসে। বিশ্ববিদ্যালয় তখনো সেটি প্রকাশ করেনি। সেটি প্রকাশিত হলে বোঝা যেত যে এ নিয়ে সমালোচনা ছিল একেবারেই ভিত্তিহীন।

পরে আমি জানতে পারি, সংবাদমাধ্যমে আমার বক্তব্যকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা ভিডিও দেখলেই সহজেই যাচাই করা যেত; ভিডিওটি আমার ফেসবুক পেজেও আছে। ওই সময় সরকারের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের ওঠাবসা ছিল। ততক্ষণে অবশ্য অনেক দেরি হয়ে গেছে।

এরপরও এটি উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে আমার আলোচনার সময় উপস্থিত ছিলেন বা পরে ভিডিওটি দেখেছেন এমন একজন ব্যক্তিও—কেউই আমার উত্থাপিত কোনো বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেননি, যুক্তিসংগত খণ্ডন তো দূরের কথা। বরং হয়েছে ঠিক এর উল্টোটা।

বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্বে আসা অনেকটাই দুর্বল ও অকার্যকর অন্তর্বর্তী সরকার দেখিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে বাক্‌স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের চেয়েও অনেক, অনেক গভীরে প্রোথিত। সত্যি বলতে, মতপ্রকাশের ও কল্পনাশক্তির ওপর সেই সামাজিক ও আর্থরাজনৈতিক বাধাগুলো এখন উন্মোচিত হয়েছে।

৪.

বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্বে আসা অনেকটাই দুর্বল ও অকার্যকর অন্তর্বর্তী সরকার দেখিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে বাক্‌স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের চেয়েও অনেক, অনেক গভীরে প্রোথিত। সত্যি বলতে, মতপ্রকাশের ও কল্পনাশক্তির ওপর সেই সামাজিক ও আর্থরাজনৈতিক বাধাগুলো এখন উন্মোচিত হয়েছে।

কেউ কেউ হয়তো বলবেন, নতুন এ ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লাগে। কেউ কেউ আবার অকার্যকর শাসনের সঙ্গে এতটাই অভ্যস্ত যে তাঁরা মনে করেন, অস্থায়ী এই সরকারের সমালোচনা করাটা সময় নষ্ট, কারণ এরা ‘অস্থায়ী’।

কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা প্রকাশ্যে কেন বলতে পারি না যে ‘আলী রীয়াজ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন’ কিংবা ‘অধ্যাপক ইউনূস বিশাল হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন’। সর্বোপরি, এঁরা তো নির্বাচিত রাজনীতিক নন, আর তাঁদের মেয়াদও প্রায় শেষের পথে।

কেউ কেউ বলছেন, আলী রীয়াজ ইতিমধ্যেই পাততাড়ি গুটিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছেন; আমি নিশ্চিত নই। তদুপরি এসব ভাষ্য দেশের অভিজাত ও পেশাজীবী শ্রেণির মধ্যে বেশ প্রচলিত, অন্দরমহলে নিয়মিত এসব আলাপ হয়। এমনকি আমি নিজে এই কথাগুলো শুনেছি অন্তর্বর্তী সরকারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের মুখেও!

মূল বিষয় হলো, যাঁরা এসব বলেন, তাঁরাও এমনভাবে বলেন যেন সবাই একমত—যেন এগুলোই সমাজের গরিষ্ঠ অংশের মত। কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে তেমন অর্থবহভাবে দায়বদ্ধ করতে পারেনি।

জিয়া হায়দার রহমান
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

৫.

গত বছরের আগস্টে যখন স্বৈরাচার পালিয়ে গিয়েছিলেন, তখন আমি এক বন্ধুকে বলেছিলাম, প্রথম কয়েক দিনে অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে তাদের প্রেস অফিস (জনসংযোগ বিভাগ) সাজায় এবং লোকবল নিয়োগ দেয়, সেটার দিকে নজর রাখা উচিত।

আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম, যেহেতু সংসদ স্থগিত আছে এবং দলীয় রাজনীতি পিছুটান দিয়েছে, তাই সরকারের দৈনন্দিন কাজের জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম ছাড়া আর কোনো উৎস নেই।

মজার বিষয় হলো, বিভিন্ন উপদেষ্টা ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস অফিসগুলো জনবল নিয়োগে অত্যন্ত দীর্ঘ সময় নিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তা যথাযথভাবে পূরণ করা হয়নি। এর পাশাপাশি দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে গেল যে প্রধান উপদেষ্টা সংবাদমাধ্যমের সামনে দাঁড়াতে এবং প্রশ্ন নেওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছুক।

গত বছরের অক্টোবর মাসে ভয়েস অব আমেরিকাকে প্রধান উপদেষ্টার এক অগোছালো সাক্ষাৎকারের পর বাংলাদেশে শোরগোল পড়ে যায়। তখন আমি ডেইলি স্টার পত্রিকায় ‘সরকারকে অবশ্যই সংবাদমাধ্যমের প্রশ্ন নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে’ শিরোনামে একটি পুরো পৃষ্ঠার সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছিলাম।

আরও পড়ুন

এ জন্য পুরো এক পৃষ্ঠা লেগেছিল। কারণ, সেখানে আমি সরকারের সংবাদ বা তথ্য প্রচারব্যবস্থার বিস্তারিত সমালোচনা করেছিলাম। আমি ব্যাখ্যা করেছিলাম যে অন্তর্বর্তী সরকারকে অর্থহীন গোলটেবিল বৈঠকের চক্কর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ঘোষণা কেবল অভিজাতদের আসরে দেওয়া হচ্ছিল। বলেছিলাম, এসব ঘোষণা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সরাসরি জনগণকে জানাতে হবে, যাতে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংবাদমাধ্যম নিয়মিত ও সরাসরি প্রশ্ন করতে পারে।

আমি সরাসরি প্রধান উপদেষ্টাকে সমালোচনা করা থেকে বিরত ছিলাম, বরং আমি আমার ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলাম প্রেস অফিসের প্রতি। তারা প্রধান উপদেষ্টাকে যথাযথ পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে, যাতে তিনি সাক্ষাৎকারগুলো দক্ষভাবে সামলাতে পারেন। সে ধরনের একটি সাক্ষাৎকার ভয়েস অব আমেরিকাকে তিনি দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

বহু দিক থেকেই প্রধান উপদেষ্টা এ বছর তাঁর নিজের আচরণের মাধ্যমে একটি মানদণ্ড স্থাপন করতে পারতেন। তিনি নতুন নিয়ম বা রীতি তৈরি করে দিতে পারতেন, যাতে পরবর্তী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী যদি সেই নিয়ম থেকে সরে যান, তবে সেটি সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হতো এবং সবচেয়ে বড় কথা, জনগণ ও সংবাদমাধ্যম সেই বিচ্যুতির সমালোচনার একটি ভিত্তি পেত। সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে একজন নেতার প্রশ্ন নেওয়ার অভ্যাস একটি মৌলিক নতুন রীতি হতে পারত।

কিন্তু এর পরিবর্তে অত্যন্ত নিচু মানের উদাহরণ স্থাপন করেছেন একজন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি এই পুরো সময়ের মধ্যে বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমকে মাত্র চার-পাঁচটির মতো সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। আর কখনোই একটি পূর্ণাঙ্গ সংবাদ সম্মেলন করেননি, যেখানে সাংবাদিকেরা বিস্তারিতভাবে প্রশ্ন করতে পারতেন। এটি ছিল সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আচরণের ঠিক উল্টো।

তবে এটা স্বীকার করতে হবে, প্রধান উপদেষ্টা কিছু সাক্ষাৎকার অবশ্যই দিয়েছেন। যেমন কথায় আছে, ভ্রমণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে। যদি সেটি সত্য হয়, তবে অধ্যাপক ইউনূস সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মনের মানুষ। কারণ, তিনি সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং মাঝেমধ্যে যেন বাংলাদেশে এসে থেকেছেন।

তিনি বিদেশি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন; সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের কাছ থেকে দুর্বল প্রশ্ন প্রত্যাশা করতেন ও পেতেন, যাঁদের কাছে বাংলাদেশ গৌণ বিষয়। তা সত্ত্বেও ভয়েস অব আমেরিকা থেকে আসা ন্যূনতম চ্যালেঞ্জের মুখে প্রধান উপদেষ্টা খেই হারিয়ে ফেলেন।

তারপর আবার সম্প্রতি তিনি আরেকটি বিপর্যয়কর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সচরাচর ভালো প্রস্তুতি নিয়ে থাকা সাংবাদিক মেহেদি হাসানকে। সেই সাক্ষাৎকার দেখা ছিল অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক এক অভিজ্ঞতা। সেই সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশের দুর্বল সংবাদমাধ্যমে প্রায় কোনো প্রভাবই ফেলেনি। সম্ভবত এমন একটি পারফরম্যান্সই সবাই তাঁর কাছ থেকে আশা করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

এটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ জবাবদিহি বা দায়বদ্ধতা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বিষয়টি বোঝার জন্য আসুন পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকাই, যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জবাবদিহি কঠিন চাপে পড়েছে।

আগামীকাল শুক্রবার লেখাটির দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হবে।

  • জিয়া হায়দার রহমান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক

    * মতামত লেখকের নিজস্ব