সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচন: ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান পর্ব হয়ে বর্তমান চিত্র

২০২৪ সালের যে সাধারণ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সংরক্ষিত আসনে নারী সদস্যদের নির্বাচিত ঘোষণা করে সেটির আপাতত সমাপ্ত হলো। দুঃখজনক হচ্ছে, পাঁচ দশক ধরেও নারী সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি বদলাল না।

অনেকের হয়তো মনে আছে, আশির দশকে এরশাদের আমলে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন ‘৩০ সেট অলংকার’ শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ কাহিনি ছাপিয়েছিল। অর্থাৎ সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে যে ৩০ জনকে এরশাদ মনোনয়ন দিয়েছেন, তাঁরা আসলে সংসদে অলংকার হিসেবেই থাকেন। সংসদে তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই, সমাজেও তেমন অবস্থান নেই। সেই প্রচ্ছদ কাহিনির জন্য এরশাদের গুন্ডাবাহিনী হামলা চালিয়ে যায়যায়দিন অফিস তছনছ করেছিল।

জাতীয় সংসদ হচ্ছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আইনসভা। সেখানে থাকেন সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত ৩০০ জন প্রতিনিধি। এরপর ৫০ জন উড়ে এসে জুড়ে বসেন। কারণ, আমাদের প্রক্রিয়াটিই এমন এবং আমরা বলছি এটি সংবিধানসম্মত; যেহেতু সংবিধানে এ বিষয়টি লেখা আছে।

আরও পড়ুন

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৩৭ এবং ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে এ ধরনের ব্যবস্থা ছিল না। সেখানে সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য নির্বাচন করতে হতো। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত নারী আসন ছিল ৫টি। সেসব আসনেও সরাসরি ভোট হয়েছিল।

তখনকার আওয়ামী লীগ দলীয় একজন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য বেগম তোহফাতুন্নেসা আজিম, যাঁর বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। তিনি ১৯৫৪ সালে আইনসভার সদস্য হলেন চট্টগ্রাম-নোয়াখালী-কুমিল্লা এ তিন জেলা নিয়ে সংরক্ষিত আসন থেকে। তখন ভোটাররা দুটি ভোট দিতেন। প্রাদেশিক পরিষদে যাঁরা সরাসরি নির্বাচন করছেন, তঁাদের জন্য একটি ভোট এবং সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য আরেকটি।

১৯৬২ সালে আইয়ুব খান এসে নতুন একটি সংবিধান জারি করলেন। সেখানে এ ব্যবস্থাটি তুলে দেওয়া হয়। তোহফাতুন্নেসা আবার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হলেন, তবে তাঁকে নির্বাচন করলেন তাঁর ইলেক্টোরাল কলেজ মানে ওই তিন জেলা থেকে নির্বাচিত সদস্যরা। কেন্দ্র থেকে এটি করা হয়নি। আমরা এখন যে ব্যবস্থাতে আছি, এটি চালু করেন ইয়াহিয়া খান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল ১৫টি আসন।

কিছু নারী সংসদ সদস্য হন, সংসদ সদস্যের মর্যাদা পান। বেতন-ভাতাও কম না, থোক বরাদ্দসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পান। এ ছাড়া নামমাত্র মূল্যে সরকারি প্লট বা শুল্কমুক্ত গাড়ির ব্যাপারেও তাদের অনেকের আগ্রহ থাকতে পারে। এ সবকিছুই কিন্তু জনগণের টাকায় হচ্ছে। কিন্তু জনগণ তাঁদের সংসদে পাঠায়নি।

এরপর অনেক রক্তক্ষয় ও ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে আমরা দেশ স্বাধীন করলাম। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র গঠনের পরে আমরা ইয়াহিয়া খানের মডেলটিকেই আত্মস্থ করে নিলাম। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে নারীদের জন্য ১৫টি সংরক্ষিত আসন রাখা হলো এবং সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই তাদের বেছে নিল। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সেই সংখ্যাটি বাড়িয়ে করেন ৩০।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই সংখ্যা হয় ৫০। প্রক্রিয়াটি একই। সংখ্যাগরিষ্ঠরাই এ ৫০ জন বাছাই করেন। এবার তো সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, সবাই এ দায়িত্বটি অর্পণ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর হাতে। ফলে এই ৫০ জনকে স্পষ্টই বাছাই করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এখন এভাবে ‘হ্যান্ড পিক’ হয়ে সংসদ সদস্য হওয়া নারীরা কীভাবে দাবি করবেন, তাঁরা জনগণের প্রতিনিধি। তাঁরা তো বরং দলীয় সভাপতির প্রতিনিধি এবং তাঁর কাছেই তাঁরা দায়বদ্ধ। গণতন্ত্রের সাধারণ চেতনার সঙ্গেই বিষয়টি যায় না। পাকিস্তান আমলে তো আমরা আরও বেশি গণতন্ত্রের চর্চা করেছিলাম। পরে ইয়াহিয়া এসে তা পাল্টে দিলেন, সেটি কেন পাঁচ দশক ধরে এখনো আমরা অনুসরণ করছি? কেন আমরা পাকিস্তানি চিন্তাধারার ফসলটি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি, এভাবে নারী সংরক্ষিত আসনে কিছু নারীকে নির্বাচিত ঘোষণার মধ্য দিয়ে।

আরও পড়ুন

কিছু নারী সংসদ সদস্য হন, সংসদ সদস্যের মর্যাদা পান। বেতন-ভাতাও কম না, থোক বরাদ্দসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পান। এ ছাড়া নামমাত্র মূল্যে সরকারি প্লট বা শুল্কমুক্ত গাড়ির ব্যাপারেও তাদের অনেকের আগ্রহ থাকতে পারে। এ সবকিছুই কিন্তু জনগণের টাকায় হচ্ছে। কিন্তু জনগণ তাঁদের সংসদে পাঠায়নি।

আমাদের দেশে কিন্তু সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থাটা আছে, তা হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে। উপজেলা পরিষদে একজন চেয়ারম্যান ও দুজন ভাইস চেয়ারম্যান আছেন। ভাইস চেয়ারম্যানের একটি পদ নারীর জন্য সংরক্ষিত। তবে এ তিনটি পদেই নারীরা সরাসরি নির্বাচন করতে পারেন। তারপরেও একটি সংরক্ষিত পদ রাখা হয়েছে।

আর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিনজন নারী সংরক্ষিত আসনে ভোটারদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্যও একই ব্যবস্থা। সেখানেও তিনটি ভোট দিতে হয়। একটি মেয়র, একটি কাউন্সিলর এবং আরেকটি নারী প্রতিনিধির জন্য।

যে ব্যবস্থাটি আমরা স্থানীয় সরকারে প্রয়োগ করতে পারি, জাতীয় ক্ষেত্রে কেন আমরা সেটি পারি না। জাতীয় ক্ষেত্রে তো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও বেশি স্বচ্ছ ও সম্প্রসারিত হওয়ার কথা।

সমস্যাটা বোধ হয়, যদি সেখানে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা হয়, তাহলে দলের পছন্দের প্রার্থী না–ও আসতে পারেন সংসদে, অন্য প্রার্থী চলে আসতে পারেন। বিরোধী দলের প্রার্থী না হলেও তিনি হতে পারেন স্বতন্ত্র বা মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষিত কোনো নারী, যিনি গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে ভূমিকা রাখতে চান। কিন্তু তিনি হয়তো অতটা অনুগত হবেন না। এটি হচ্ছে মূলত মনস্তত্ত্বের বিষয়। তা না হলে পাঁচ দশক ধরে ইয়াহিয়া মডেলের অনুসরণ করার কোনো যুক্তি দেখি না।

আরেকটি কথা না বলে পারছি না, নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা যাচাই করার একটি সুযোগ তৈরি হয়। এর বাইরে বিকল্প কোনো পথ আছে বলে আমি জানি না।

সংসদ সদস্য হতে আগ্রহী অনেকে নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন বলে আলোচনা আছে। রাজনীতিতে তেমন অংশগ্রহণ নেই, মিডিয়ার এমন কাউকে কাউকেও আমরা সেই দৌড়ঝাঁপে দেখেছি। সংসদে জনপ্রতিনিধিত্ব করতে চাইলে তো আমি বরং জনগণের কাছেই যাব।

আমরা জানি, পুরুষদের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে আছেন। রাজনৈতিক দলগুলো নারীদের যথেষ্ট জায়গা ছেড়ে দেয় না। এক–এগারোর সরকারের সময় নির্বাচন কমিশন বিধিমালা করেছিল, প্রত্যেক পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য থাকতে হবে। সব রাজনৈতিক দলও তখন সেটি মানতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সেই সরকার চলে যাওয়ার পর ওই বিধিমালা তারা আর মেনে চলেনি, যেহেতু তাদের ভাষায়, সরকারটি ছিল অনির্বাচিত।

নারীদের সুযোগ না দেওয়া এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীদের উচ্চপর্যায়ে দেখানোর চেষ্টা হয়। নারীর অগ্রগতির ক্ষেত্রে এর তেমন ভূমিকা নেই। কেননা সব দিকে নারীদের অংশগ্রহণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যে রাজনৈতিক বিধিব্যবস্থা দরকার সেটি এখানে অনুপস্থিত।

আমরা গর্ব করে বলি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারসহ আরও অনেক পদেই এখন নারী। কিন্তু সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন প্রক্রিয়াটি যদি গণতান্ত্রিক না হয়, তাহলে তাদের আর যাই হোক জনপ্রতিনিধি বলা কঠিন।

আমাদের সংবিধানে সংরক্ষিত আসন কত দিন থাকবে তার একটি মেয়াদ আছে। সেই মেয়াদ পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হচ্ছে। প্রথমে ছিল ১০ বছর, এরপর আরও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সরাসরি নির্বাচনের জন্যও একটি সময় বেঁধে দেওয়া দরকার যে এর পরে এভাবে আর হবে না।

আমি মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর এ ব্যাপারে অঙ্গীকার থাকা উচিত। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে দাবি ওঠা উচিত।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক