জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর প্রতিবাদ কতটুকু আশা জাগায়

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর অনিয়ম ও অরাজকতার বিরুদ্ধে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে সামিউলের উত্থাপিত দাবিগুলো অত্যন্ত যৌক্তিক, ন্যায্য ও প্রশংসনীয়
ছবি: প্রখম আলো

‘এম এইচ হলের সামনের মাঠে হলের সাধারণ ছাত্রদের অধিকার নিয়ে অনশনে বসলাম’—জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক ছাত্র সামিউল ইসলাম প্রত্যয় গত ৩১ মে সন্ধ্যায় তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে এই পোস্ট লিখে অনশনে বসেন।

সামিউল তিনটি দাবির কথা উল্লেখ করেন—

এক. অবৈধভাবে সিট দখল করে রাখা অছাত্রদের হল থেকে বহিষ্কার করতে হবে।

দুই. গণরুম ও মিনি গণরুমের শিক্ষার্থীদের হলের বরাদ্দ করা নির্দিষ্ট সিট বুঝিয়ে দিতে হবে।

তিন. গণরুম বন্ধ করতে হবে।

সামিউল বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই অন্যায়ের অবসান চান এবং সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি জানান, তাঁর এই অনশন সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের লড়াই। সবার উচিত নিজ নিজ হলের অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং চাপ সৃষ্টি করা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর অনিয়ম ও অরাজকতার বিরুদ্ধে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে সামিউলের উত্থাপিত দাবিগুলো অত্যন্ত যৌক্তিক, ন্যায্য ও প্রশংসনীয়।

আরও পড়ুন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর ধরে হলগুলোতে চলছে সিট দখল, সিট-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি এবং নিপীড়নের ঘটনা।

এসব অরাজকতার সঙ্গে প্রায় সব ক্ষেত্রেই জড়িত সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। দিনের পর দিন অভিযোগ আসছে, হল প্রশাসন কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলছে, বড়জোর ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে আবার হলে তুলে দিচ্ছে বা মিটমাট করে দিচ্ছে।

ইদানীং প্রায়ই প্রশ্ন উঠছে, হল প্রশাসন কে চালায়? হল প্রশাসনের পাশাপাশি বর্তমানে ছাত্রলীগ ছায়া প্রশাসন হিসেবে কাজ করছে। একধরনের অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে হলগুলোতে প্রশাসন ও ছাত্রসংগঠনের মধ্যে আসন ভাগাভাগি হচ্ছে। আবার প্রশাসনের বরাদ্দ দেওয়া সিটগুলো অনেক সময় ছাত্রলীগ দখলে নিচ্ছে। সেখানে টাকা না দিয়ে বৈধ হলেও হলে উঠতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। প্রশাসনের কাছে ধরনা দিয়েও কাজ হয় না।

আরও পড়ুন

এসব ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন হরহামেশাই ঘটছে। এখানে লজ্জার ও দুঃখের ব্যাপার হলো হল প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রেই অন্যায় এবং অনিয়মের সঙ্গে আপস করে দায়িত্বপালনে বাধ্য হচ্ছে।

সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না, যা শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার ও দুঃখের। এসব নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ আছে, অসন্তোষ আছে। কিন্তু তাঁরা যেন জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করতে সাহস পান না। তবে শিক্ষাঙ্গনে যখন একধরনের ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়েছে, সেখানে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে একজন শিক্ষার্থীর একা দাঁড়ানো অনেক হতাশার মধ্যেও আশা জাগায়।

বৈধ শিক্ষার্থীরা মাসের পর মাস হলের আবাসিক ফি দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু হলে উঠতে পারছেন না। গভীর রাতে বিছানাপত্র ছুড়ে ফেলে নিজের কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে, শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে, চাঁদা না পেয়ে কক্ষে ডেকে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে—কোনো ব্যবস্থা নেই, প্রতিকার নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। যাঁরা জোরজবরদস্তি করে হল দখল করে আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো নৈতিক মনোবল কিংবা সদিচ্ছা প্রশাসনের নেই।

আরও পড়ুন

চলতি মাসেই আমরা দেখেছি, হলে বরাদ্দ করা আবাসিক সিট বুঝিয়ে দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈধ আবাসিক শিক্ষার্থীকে গভীর রাতে হল থেকে বের করে দেওয়ার প্রতিবাদে বিছানাপত্র নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি গ্রহণ করেন ওই শিক্ষার্থী।

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলপরীর ওপর নির্মম নির্যাতনের ঘটনা আমাদের হতবাক করেছে। বুয়েটের আবরার ফাহাদের নির্মম মৃত্যু সমগ্র জাতিকে গভীর হতাশায় ফেলেছে। ছাত্রলীগ কতটা ভয়ংকর, হিংস্র, আর বর্বর হতে পারে, এসব তারই দৃষ্টান্ত। একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। এসবের কোনো প্রতিকার হয়নি। কেউ কেউ সাহস নিয়ে অভিযোগ করছেন, কিন্তু প্রতিকার না পেয়ে হতাশ হয়ে পিছিয়ে যাচ্ছেন।

অভিযুক্ত ব্যক্তিরা রাজনৈতিক বিবেচনায় থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এর মধ্যে সামিউলের এই প্রতিবাদ আশা জাগায়। তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়। তাঁর প্রতিবাদের উপায় এবং দৃঢ়তা। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র’ কবিতার মতো, ‘…খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত/ উত্তোলিত, উদ্ভাসিত/ কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।’

উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কারও কাছে সামিউল নতি স্বীকার করেননি। তাঁর দাবিতে অবিচল থেকে অনশন চালিয়ে গেছেন। এমনকি রাতের আঁধারে তাঁর এবং উপস্থিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হলেও হাল ছাড়েননি তিনি।

অভিযোগ ওঠে, গভীর রাতে অনশনরত সামিউল ও তাঁর সঙ্গে থাকা কয়েকজনের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী পরিকল্পিতভাবে হামলা চালান, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত।

সামিউলের সাহসের এই স্ফুলিঙ্গ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ুক সব শিক্ষাঙ্গনে। দূর হোক সব প্রকার নৈরাজ্য, অরাজকতা ও নিপীড়ন। প্রতিটি শিক্ষাঙ্গন হোক জ্ঞান অর্জন, জ্ঞানচর্চা এবং জ্ঞান সৃষ্টির পবিত্র ভূমি। সামিউলরা যুগে যুগে সেই আশাই বাঁচিয়ে রাখুক।

ভয়ভীতি, হামলা, মানসিক চাপ উপেক্ষা করেন সামিউল। অবশেষে অনশনের অষ্টম দিনে ৮ জুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে লিখিত চুক্তির মাধ্যমে সমঝোতায় এলে তিনি অনশন ভাঙেন।

সংশ্লিষ্ট হল প্রশাসনের আন্দোলনকারী কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে চুক্তি একটি নজির সৃষ্টি করেছে, একটি ইতিহাস হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এই চুক্তির অঙ্গীকার কতটুকু কার্যকর করতে পারবে, সেটি এখন দেখার বিষয়।

প্রশাসনের সঙ্গে এই চুক্তি নিঃসন্দেহে একটি প্রাথমিক বিজয়। আট দিন না খেয়ে, রোদে পুড়ে, গরমে সেদ্ধ হয়ে, ছাত্রলীগের মার খেয়ে সামিউলের সবচেয়ে বড় অর্জন এই চুক্তি নয়, বরং বড় অর্জন হলো সাহস—যা সব সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংক্রমিত হলেই কেবল অর্জিত হবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের বিজয়।

সামিউলের সাহসের এই স্ফুলিঙ্গ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ুক সব শিক্ষাঙ্গনে। দূর হোক সব প্রকার নৈরাজ্য, অরাজকতা ও নিপীড়ন। প্রতিটি শিক্ষাঙ্গন হোক জ্ঞান অর্জন, জ্ঞানচর্চা এবং জ্ঞান সৃষ্টির পবিত্র ভূমি। সামিউলরা যুগে যুগে সেই আশাই বাঁচিয়ে রাখুক।

  • ড. ফরিদ খান, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
    ই–মেইলঃ [email protected]  মোবাইলঃ 01712208970