গত বছরের ‘বর্ষাবিপ্লবের’ পর থেকেই ভারতের পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পারিষদবর্গ দেশটির আতিথ্যে রয়েছেন। ঠিক কোন আইনগত মর্যাদায় তাঁরা আছেন, রাজনৈতিক আশ্রয়ে, না অন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থাধীন, এ কথা হাসিনা অথবা ভারত—কেউই খোলাসা করেনি। তবে আছেন, বেশ বহাল তবিয়তেই।
কেমন আছেন, তার একটি বেশ জমকালো বিবরণ দিয়েছে ভারতের অনলাইন পোর্টাল দ্য প্রিন্ট। তার একটি সারসংক্ষেপ প্রথম আলোতেও মুদ্রিত হয়েছে। এতে বিগত সরকারের একজন বাক্চতুর সহকারী মন্ত্রী, মোহাম্মদ আরাফাত বলেছেন, তাঁরা রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, কী করে শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় বসানো যায়।
মোহাম্মদ আরাফাত একা নন, আরও হাজার দুয়েক আওয়ামী নেতা-কর্মী রয়েছেন, যাঁরা বেশ আরামেই ভারতীয় আতিথ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ জিমে যাচ্ছেন, কেউ মাথায় নকল চুল বসাচ্ছেন, কেউ অনলাইন বৈঠকে যুক্ত হচ্ছেন। অবশ্য তিনি, অর্থাৎ আরাফাত, অন্য সব আরাম-আয়েশ বাদ দিয়ে দিনরাত খেটে যাচ্ছেন, কীভাবে ইউনূস সরকারকে হটিয়ে হাসিনাকে আবার মসনদে বসানো যায়, সেই কাজে।
তাঁরা যে ভারতে আছেন, সেটা কোনো ‘হাইলি ক্ল্যাসিফায়েড’ তথ্য নয়। খোদ হাসিনা প্রায় প্রতিদিন এক–দুটি করে টেলিফোন-নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন—কখন, কোথায় কী করতে হবে। তিনি শিগগিরই দেশে ফিরে আসছেন—এমন আশ্বাসও মাঝেমধ্যে জানাচ্ছেন।
বিগত সরকারপ্রধানের এমন প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতায় উদ্বিগ্ন হয়ে তা বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে ভারতের কাছে একটি পত্র পাঠিয়েছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যত দূর মনে পড়ে, স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস তিন মাস আগে ব্যাংককে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁদের একমাত্র মুখোমুখি আলাপচারিতায় সেই একই অনুরোধ রেখেছিলেন।
সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক আনুষ্ঠানিক প্রেস বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সে অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে। এতে সাফ সাফ বলা হয়েছে, ‘না, আমরা আওয়ামী লীগের কোনো সদস্যের বাংলাদেশবিরোধী কার্যকলাপের ব্যাপারে অবহিত নই। ভারত সরকার এমন কোনো রাজনৈতিক কার্যকলাপ বরদাশত করে না। অন্য কথায়, অন্তর্বর্তী সরকার যে অভিযোগ করেছে, তা ভিত্তিহীন।’
ভারতের এই সরকারি বিবৃতিটি যে ডাহা মিথ্যা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দ্য প্রিন্ট পোর্টালের সাংবাদিক যে খবর টেলিফোন তুলে সরাসরি ঘোড়ার মুখ থেকে জেনে নিতে পারেন, ভারত সরকার নিজের তাবৎ গোয়েন্দা অ্যাপারেটাস ব্যবহার করেও তার সন্ধান পায়নি, সে কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
দ্য প্রিন্টের প্রতিবেদনে এসব আওয়ামী কর্তা কলকাতার কোন পাড়ায়, কোন অ্যাপার্টমেন্টে একা বা রুমমেট সঙ্গে নিয়ে দিন গুজরান করছেন, তার সবিস্তার বিবরণ রয়েছে। ইউটিউবেও একাধিক সচিত্র বিবরণীতে এসব রাজনীতিকের ব্যাপারে বেশ রসালো কাহিনি রয়েছে।
তার মানে ভারত সরকার সবই জানে এবং জেনেশুনেই হাসিনা ও তাঁর অনুগামীদের ভারতে অবস্থান এবং কার্যকলাপে অনুমতি দিয়েছে। যত দূর জানি, হাসিনা রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আশ্রয় পেয়েছেন। তার মানে খানাপিনা, টেলিফোন বিল ও নিরাপত্তার জন্য খাইখরচা সবই ভারত সরকারের। কোনো কোনো ভারতীয় রাজনীতিক প্রশ্ন তোলা শুরু করেছেন, এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা জেনেও ভারত ঠিক কোন কারণে হাসিনাকে ‘জামাই আদরে’ থাকতে দিচ্ছে।
কোনো ষড়যন্ত্র তুলে ধরার জন্য আপনাদের আমি এই গল্প শোনাচ্ছি না। আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, শুধু সে ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়ার জন্যই এই নিরীক্ষার অবতারণা।
সর্বভারতীয় মজলিশ-এ-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের প্রধান আসাবুদ্দিন ওয়াইসি জানতে চেয়েছেন, ভারত সরকার যেখানে শুধু বাংলা বলার জন্য লোকজনকে ধরেবেঁধে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে, সেখানে হাসিনাকে এত খাতির কেন। বাংলাদেশ থেকে আগত বহিরাগতদের যদি বহিষ্কার করতে হয়, তো সেই কাজ হাসিনাকে দিয়েই শুরু করা দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
এ কথা অনেকেই বলেছেন, ক্ষমতা থেকে হাসিনার পতন ভারতের জন্য একটা বড় ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয়। প্রধানমন্ত্রী মোদি শেখ হাসিনাকে নিজের লোক মনে করে তাঁর পেছনে বিস্তর বিনিয়োগ করেছেন। সে বিনিয়োগের সুফলও পেয়েছেন। ‘ভারতের নিজের স্বার্থেই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে হবে’—এ কথা একজন আওয়ামী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে গিয়ে মামাকে মাসির গল্প শোনানোর মতো শুনিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু একই ঝুড়িতে সব ডিম রাখার ফল কী হতে পারে, সে শিক্ষাটা ভারত মনে রাখেনি। ফলে বর্ষাবিপ্লবে হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভারত, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর আম-ছালা দুটোই হারালেন (তার সঙ্গে ঝুড়িভর্তি ডিমও)। অনেকেই বলেছেন, এ বিনিয়োগটাই যদি শুধু হাসিনা ও আওয়ামী লীগের ওপর না হয়ে বাংলাদেশ ও তার জনগণের পেছনে হতো, তাহলে আজকের এই বিপন্ন অবস্থায় ভারতকে পড়তে হতো না।
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, এই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নেওয়ার বদলে ভারত এখনো হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে তার বুকপকেটে রেখে দিয়েছে কেন? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর, পরে কোনো এক সময় কাজে লাগবে, এই বিবেচনা থেকে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একে স্ট্র্যাটেজিক লেভারেজ বা কৌশলগত সুবিধা নামে অভিহিত করে থাকেন। একে আপনারা দর-কষাকষির হাতিয়ার বা বার্গেনিং চিপ হিসেবেও ভাবতে পারেন। ভারতের হিসাবে, হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে যদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে টিকিয়ে রাখা যায়, তাহলে পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বাণিজ্য থেকে কূটনীতি, যেকোনো প্রশ্নেই দিল্লি সেই তাসকে দর-কষাকষির জন্য ব্যবহার করতে পারবে।
এই দুই দেশ একে অপরের প্রতিবেশী, চাইলেই ছুমন্তর করে তাকে ‘ভ্যানিশ’ করা যাবে না। আজ হোক বা কাল, সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে উদ্যোগ নিতেই হবে। তেমন পরিস্থিতিতে ভারত একদম মোক্ষম সময়ে এই ‘হাসিনা তাস’কে টেবিলে ছুড়ে দেবে। এ রকম কৌশলগত ‘লেভারেজের’ অনেক অভিজ্ঞতাই আমাদের জানা। যেমন কোনো না কোনো ফায়দা হবে, এই আশায় পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। অথবা এখন ভারত যে কারণে বালুচ বিদ্রোহীদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে আগলে রেখেছে।
এর চেয়েও ভয়াবহ আরেকটি আশঙ্কা রয়েছে। এমন হতে পারে যে ভারত সত্যি সত্যি আঁক করে বসে আছে যে আজ হোক বা কাল, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ক্ষমতায় ফিরবেন। হাসিনা নিজে সে কথা বলেছেন, ইউটিউব তার সাক্ষী। মোহাম্মদ আরাফাতসহ তাঁর আরও কয়েক হাজার অনুগামী ভারতে বসে ভারতের মদদে সে লক্ষ্য পূরণে দিন–রাত কাজ করে চলেছেন, ভারতীয় পত্রিকা দ্য প্রিন্ট সে কথা জানিয়েছে। ভারতের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া এর কোনোটাই সম্ভব নয়।
হাসিনা ক্ষমতায় ফিরবেন—এটা কেবল থিওরি নয়, প্র্যাকটিসও বটে। উর্বর মস্তিষ্কের কেউ কেউ অনায়াসেই ভাবতে পারেন, বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে সবুজসংকেত ছাড়া খোদ রাজধানীতে এমন দুঃসাহসী কর্মযজ্ঞে তাঁরা নামবেন, তা ভাবার কোনো কারণ নেই।
আওয়ামী লীগ যে এখনো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার আশা করে, তার আরও একটি আলামত আমরা সপ্তাহ দুয়েক আগে সামরিক বাহিনীর বরাত দিয়ে জেনেছি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন কর্মরত অফিসারের নেতৃত্বে শ চারেক আওয়ামী কর্মী নাশকতামূলক কাজের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন বলে তাঁরা জানিয়েছেন।
অন্য কথায়, হাসিনা ক্ষমতায় ফিরবেন—এটা কেবল থিওরি নয়, প্র্যাকটিসও বটে। উর্বর মস্তিষ্কের কেউ কেউ অনায়াসেই ভাবতে পারেন, বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে সবুজসংকেত ছাড়া খোদ রাজধানীতে এমন দুঃসাহসী কর্মযজ্ঞে তাঁরা নামবেন, তা ভাবার কোনো কারণ নেই।
কোনো ষড়যন্ত্র তুলে ধরার জন্য আপনাদের আমি এই গল্প শোনাচ্ছি না। আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, শুধু সে ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়ার জন্যই এই নিরীক্ষার অবতারণা।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে আগামী নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করেছে। আওয়ামী সমর্থকেরা এই যুক্তি দিয়ে থাকেন, অন্তর্বর্তী ইউনূস সরকার অবৈধ। ফলে তাঁকে হটানোর দাবিটা তাঁদের চোখে মোটেই অগণতান্ত্রিক নয়। কিন্তু সরকার গঠনের লক্ষ্যে পরবর্তী নির্বাচন যদি একবার নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়, হাসিনার বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে। সেই বিবেচনায় স্বাভাবিকভাবেই হাসিনা বা আরাফাতদের লক্ষ্য হবে এই নির্বাচন ঠেকানো।
অনুমান করি, বাংলাদেশ সরকার এই বিপদ সম্পর্কে অবগত। অন্যথায় তাঁরা ভারতের কাছে আওয়ামী তৎপরতার প্রতিবাদ জানাতেন না। কিন্তু তাঁদের দায়িত্ব শুধু এই প্রতিবাদ জানানোর মধ্যে শেষ করলে চলবে না। বিষয়টা পৃথিবীর সামনে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে, দেশের ভেতরে, দেশের বাইরে বাংলাদেশকে নিয়ে এক ষড়যন্ত্রের ছক পাতা হচ্ছে।
হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
