আসামে টমেটো যেভাবে বিজেপির অস্ত্র হয়ে উঠল

ভারতজুড়ে বেড়েছে টমেটোর দাম। সবজির বাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা।
ছবি: রয়টার্স

যারা এখন সবজির দাম বাড়িয়েছে তারা কারা? এ বক্তব্য ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার। রাজ্যটির রাজধানী গুয়াহাটিতে শাকসবজির দামের বিশেষ করে টমেটোর ঊর্ধ্বগতি ক্রমবর্ধমান দাম নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার এমন বাগাড়ম্বরপূর্ণ প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি। যদিও শুধু গুয়াহাটিতে নয়, ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও শাকসবজির দাম বেড়েছে।

শর্মা নিজেই উত্তর দিচ্ছেন, ‘মিঞা বিক্রেতারাই উচ্চ হারে সবজি বিক্রি করছে’। মিঞা মানে আসামের বাংলাভাষী মুসলিমদেরই তিনি এর জন্য দায়ী করেন। এসব বাংলাভাষীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাজ্যটিতে বসবাস করছেন। কিন্তু শর্মার দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং দলটির হিন্দু মতাদর্শিক সহযোগীরা সম্প্রদায়টিকে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী বলে অভিযুক্ত করে আসছে।

শর্মা অসমিয়াদের (যারা মূলত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ) বলছেন, মিঞা মুসলমানরা (যারা রাজ্যটির জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ) শুধুমাত্র তাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে না, রাজ্যটিকেও ধ্বংস করছে। ফলে অসমিয়া জনগণকে কিছু পেতে হলে এই সব মিঞা মুসলিমদের রাজ্য থেকে তাড়াতে হবে। আর শর্মাই হচ্ছেন এ সমস্যা থেকে অসমিয়াদের জন্য মুক্তিদাতা।

টমেটোসহ শাকসবজির দাম বাড়ার পেছনে আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিস্থিতিকেই দায়ী করছেন বিজ্ঞানীরা। কোনো এলাকায় খরা এবং কোনো এলাকায় জায়গায় বন্যা সৃষ্টির ফলে ভারতজুড়ে খাদ্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে। অবশ্যই মিঞা মুসলমানদের বা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের কৃত্রিমভাবে সবজির দাম বাড়ানোর কোনো প্রমাণ নেই।

তবুও শর্মার দাবি যতটা না বিচিত্র ছিল, তার চেয়েও ছিল উদ্ভট। অপ্রমাণিত কিন্তু ষড়যন্ত্রমূলক এবং ক্রমবর্ধমান বিপজ্জনক অভিযোগের মাধ্যমে যেভাবে একটি সম্প্রদায়কে আসামে দীর্ঘদিন ধরে ‘অপর’ করে রাখা হয়েছে, সেটির সঙ্গেই তাল মিলিয়েছেন তিনি। এটি ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে ভারতজুড়ে মুসলমানদের ভিলেন বা খলনায়ক করে তোলার একটি বিস্তৃত প্যাটার্নের অংশ। যদিও আসামে এই গোঁড়ামির শিকড় আরও গভীরে।

আরও পড়ুন

এই ধরনের কথাবার্তা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে তা বোঝার জন্য ঠিক এক শ বছর আগে কীভাবে জার্মানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির জন্য ইহুদিদের দায়ী করা হয়েছিল, তা মনে করা যায়। শর্মার মতে, ইহুদিরা নাৎসিদের চোখে ‘জার্মান’ না হয়ে থাকলে মিঞা মুসলিমরাও ‘অসমিয়া’ নয়। সাংবাদিকদের সাথে একই আলাপে মুখ্যমন্ত্রী মুদ্রাস্ফীতির জন্যও অভিযুক্ত করেছেন মিঞা মুসলমানদের, যারা গুয়াহাটির উড়ালসড়কগুলোর নিচে সবজি বাজার চালায়। অসমিয়াদের কর্মসংস্থান কেড়ে নেওয়ার জন্যও তাদের দায়ী করা হয়। তিনি সেসব বাজার পরিষ্কার করে সেখানে অসমিয়া ছেলেদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি রাসায়নিক সার ব্যবহার করে আসামের মাটি ধ্বংস করার জন্য মিঞা মুসলিমদেরই দায়ী করেছেন। তিনি এটিকে বলছেন, ‘সার জিহাদ’।

শর্মা অসমিয়াদের (যারা মূলত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ) বলছেন, মিঞা মুসলমানরা (যারা রাজ্যটির জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ) শুধুমাত্র তাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে না, রাজ্যটিকেও ধ্বংস করছে। ফলে অসমিয়া জনগণকে কিছু পেতে হলে এই সব মিঞা মুসলিমদের রাজ্য থেকে তাড়াতে হবে। আর শর্মাই হচ্ছেন এ সমস্যা থেকে অসমিয়াদের জন্য মুক্তিদাতা।

মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় প্রচারণার অংশ হিসেবে আসামে বুলডোজার ব্যবহার করে অনেক মিঞার বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং অনেককে উচ্ছেদ করা হয়েছে। মিঞা পরিবারগুলোকে শিশুদের নিয়ে গৃহহীন করা হয়েছে। শিশুদের খেলনাগুলো দৈত্যকার মেশিনের চাকার নিচে নির্মমভাবে পিষ্ট করা হয়েছে।

আসামের সংস্কৃতি বা ইতিহাসের দাবি থেকে মিয়াদের অস্বীকার করা হচ্ছে। মিঞা গোষ্ঠীরা গত বছর একটি জাদুঘর স্থাপন করলে সেটি বন্ধ করে দেন শর্মা। আসামের মাদ্রাসাগুলোকে বন্ধের মুখে ফেলা থেকে শুরু করে মুসলমানদের জন্য বিশেষ জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতির জন্য শর্মা বিজেপিতে উত্থান হওয়া নতুন নেতাদের মুসলিমবিদ্বেষের দৌড়ে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন

সাম্প্রতিক দশকগুলোতে মিঞা মুসলিমদের ‘বাংলাদেশি’, ‘অভিবাসী’, ‘বহিরাগত’ আখ্যা দিয়ে তাদেরকে সামাজিকভাবে ঘৃণ্য করে তোলা হয়েছে। শর্মা এখন রাজ্যের এই মেরুকরণকে আরও গভীরতায় নিয়ে যাচ্ছেন।

বিশ্ববাসী ও ভারতের বিস্তৃত জনসাধারণ আসামের এই মেরুকরণ সম্পর্কে অনেকাংশে অজ্ঞ। তাদের ধারণা এখন বদলানো দরকার। শর্মা ইতিমধ্যেই আসামের এই বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে ‘অ-মানুষে’ পরিণত করেছেন। সেখানে সবজিও হয়ে উঠেছে তাঁর গোঁড়ামির অস্ত্র।

  • অপূর্বানন্দ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

  • সুরাজ গোগী সমাজবিজ্ঞানী, আরভি বিশ্ববিদ্যালয়, বেঙ্গালুরু

আলজাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনুবাদ: রাফসান গালিব