খালেদা জিয়া: তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ায় সাহসের প্রতীক

সাজানো নির্বাচনে না যাওয়ার খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্ত অকল্পনীয় দৃঢ়তার নজির হয়ে আছেফাইল ছবি

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চূড়ান্ত এক দুর্দশার মধ্যে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে যুক্ত হন। আর গণতন্ত্রের নতুন উষালগ্নে তিনি শারীরিকভাবে বিদায় নিলেন। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার মুহূর্তে তিনি ছিলেন সাহসের প্রতীক, বিদায় নিলেন দৃঢ়তার ইমেজে।

প্রায় চার দশকের বেশি সময়ের রাজনৈতিক জীবন তাঁর। দল ও দেশের ডাকে তিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন। ব্যক্তিগত বিবেচনায় যা বেশ সাহসী পদক্ষেপ ছিল। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন তখন দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের টুঁটি চেপে ধরে রেখেছিল। পাশাপাশি বিএনপিকে ধ্বংস করতেও সচেষ্ট ছিলেন তখনকার ওই অবৈধ শাসক।

মূলত দল রক্ষা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম করতে করতে খালেদা জিয়া রাজনীতিবিদে পরিণত হন। তাঁর হাতেই বিএনপির বিশেষ মেঠো বিস্তৃতি। তাঁর ছায়ায় বিএনপিতে যুক্ত হওয়া সেদিনের ওই তরুণসমাজই আজ দেশজুড়ে দলটির মেরুদণ্ডতুল্য কাঠামো।

আরও পড়ুন

১৯৮২ থেকে ১৯৯০–এর সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রামে বাম-ডান-মধ্যপন্থীসহ অনেক দল, নেতা ও ছাত্র-শ্রমিক সংগঠন যুক্ত ছিল। বিএনপি তখন শুরুতে বেশ অগোছালো অবস্থায় ছিল। এমনকি এরশাদের পতনের পরও খুব কম রাজনৈতিক ভাষ্যকার ভাবতেন, বিএনপি ১৫–দলীয় জোটের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিজয়ী হবে। অবিশ্বাস্য, সেটাই ঘটে খালেদার একক ভাবমূর্তির জোরে।

অবৈধ শাসকের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার অঙ্গীকারই দেশজুড়ে খালেদা জিয়ার সৎ ও সাহসী ভাবমূর্তি তৈরি করে তখন। নিজের বক্তব্যের প্রতি একরোখা এ রকম নীতিগত দায়বদ্ধতায় খালেদা জিয়া এ দেশের ইতিহাসে বিশেষভাবে অনন্য। তাঁর ওই সোজাসাপটা দৃঢ়তা সেদিন ফৌজি শাসনের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসগুলোর প্রতিরোধে বিশেষ শক্তি জুগিয়েছে। গত দুই দশকেও আমরা দেখেছি, তিনি কোনো অবস্থায় দেশ না ছাড়ার অঙ্গীকার করে জেলজুলুম মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু তাতে শেষবিচারে তিনিই বিজয়ী হয়েছেন, জুলুমকারীদের পালাতে হয়েছে।

রাজনীতিতে অনেক সময় ‘শোককে শক্তিতে পরিণত করা’র স্লোগান শোনা যায়। খালেদা জিয়ার জীবন সম্ভবত এর সুতীব্র এক উদাহরণ।

২০০১ সালে পল্টন ময়দানে কৃষক দলের এক সমাবেশে খালেদা জিয়া
ফাইল ছবি

স্বামী ও সন্তানকে হারিয়ে নিশ্চিতভাবে তিনি বিপুল বেদনা নিয়ে বেঁচেছিলেন। একান্ত সেই বেদনাবোধকে তিনি সামান্যই প্রকাশ করতেন। ব্যক্তিগত যেকোনো আঘাতের মুখে ও আক্রান্ত অবস্থাতেও রাজনৈতিক লক্ষ্যে এবং নীতিগত প্রশ্নে তাঁর দৃঢ়তা ছিল মহাকাব্যিক।

বিগত সরকারের শাসনামলে তাঁর নির্মম জেলজীবনের কথা আমরা জানি। সে সময় তাঁর স্বাস্থ্য বিশেষভাবে ভেঙে পড়ে। নিকটজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও তখন শাসকদের সাজানো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি যে অবস্থান নিয়েছিলেন, সেটা অকল্পনীয় দৃঢ়তার নজির হয়ে আছে।

বিশ্বজুড়ে এমন কথা চালু রয়েছে, রাজনীতি হলো আপসের শিল্পকলা। খালেদা জিয়া তাঁর জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন, দৃঢ়তাও রাজনীতির বিকল্প শিল্পকলা হতে পারে। তিনি যে রাজনৈতিক জীবনে কখনো কোনো সংসদীয় আসনে পরাজিত হননি, সেটা সম্ভবত ওই ইমেজের জোরে। বাংলার মানুষ তাঁর এই একরোখা ধরন পছন্দ করেছিলেন। সেটা নীতিগত সততায় মোড়ানো ছিল বলে হয়তো।

খালেদা বলতেন, বাংলাদেশের বাইরে তাঁর কোনো ঠিকানা নেই। এই উক্তির ভেতর যে রাজনৈতিক আদর্শ, সাহস ও শক্তির প্রকাশ রয়েছে, কার্যত সেটাই বাংলাদেশ। তিনি বাংলাদেশের মতোই দক্ষিণ এশিয়ায় সাহসের প্রতীক ছিলেন। এ রকম সাহসই বাংলাদেশের অস্তিত্বের শর্ত।

নীতিগত প্রশ্নে একরোখা হলেও সাংস্কৃতিকভাবে এবং ব্যবহারে খালেদা জিয়া ছিলেন অন্তর্ভুক্তিমূলক। পারস্পরিক ঘরোয়া আলাপচারিতায় তিনি বলার চেয়ে শুনতে পছন্দ করতেন। এটাও ছিল আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কম দেখা পাওয়া বৈশিষ্ট্য। শেষোক্ত এই গুণের কারণে বিএনপির রাজনীতির একদম বিপরীত ঘরানার রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, লেখকেরাও অনেকে তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। রাজনীতির বাইরে বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক পরিসরকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন। প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করার সংস্কৃতি পছন্দ করতেন না।

তাঁর নেতৃত্বে থাকাকালে বিএনপি দল হিসেবে দেশের মধ্য ডান ঘরানায় উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে গেছে। ক্ষমতায় থাকতে ডানপন্থীদের জোটে জায়গা দিয়েছে। মধ্যপন্থী ও বামপন্থীদের দিক থেকে এসব বিষয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা ছিল এবং আছে। কিন্তু এ–ও সত্য, তিনি বিএনপির ভেতরে ডানপন্থার প্রসার ঘটাননি। আধুনিকতার দিকেই ছিল তাঁর পক্ষপাত। দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রধান নেতা বাছাইয়ে তিনি মধ্য বাম ঘরানার ওপর আস্থা রাখতেন।

২০০৭ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঢাকার আদালতে খালেদা জিয়া
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

তাঁর বিখ্যাত একটা উক্তি ছিল: ‘বিএনপির অবস্থান ডানের বামে এবং বামের ডানে।’ মধ্যপন্থার প্রতি এই আস্থার মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বিশেষ পরিচয় মেলে। বাংলাদেশের সামাজিক মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। আবার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রাতিষ্ঠানিকতা ছাড়া যে এই দেশে নৈরাজ্য দেখা দেবে, সেই বিবেচনাবোধও হারাননি।

বিশ্বজুড়ে লোকরঞ্জনবাদ ও দক্ষিণপন্থার উত্থানের মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের ভারসাম্যমূলক মিশেলে সফলভাবে দীর্ঘকাল সরকার ও দেশ পরিচালনা সহজ নয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার শাসনামলও দোষত্রুটি-সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিল না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে গিয়ে এবং বিরোধী রাজনীতিবিদদের ওপর হামলার ঘটনায় সঠিক তদন্তে ব্যর্থ হয়ে তাঁর সরকার বিস্তর সমালোচনার শিকার হয়েছে। দেশজুড়ে আজকের দক্ষিণপন্থার উত্থানেও রাজনৈতিক সমালোচকেরা বিএনপির অনেক অতীত দায় দেখেন। তবে বিএনপির আদর্শিক বিরোধী পক্ষ এসব ভুলকে ব্যবহার করতে গিয়ে রাজনীতিকে গোত্রবাদী শত্রু শত্রু খেলায় পর্যবসিত করে নিজ বাসভবন থেকে তাঁকে উৎখাতের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছিল।

আরও পড়ুন

রাজনীতিতে যেকোনো ভুলের সঠিক চিকিৎসা সম্ভব কেবল ভোটের আদালতে। জীবনের শেষলগ্নে খালেদা জিয়া দেখে গেলেন, বাংলাদেশ আবার গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত হিসেবে নির্বাচনী পথে ফিরে এসেছে। আসন্ন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যদি প্রকৃতেই গণতন্ত্রের পথে এক ধাপ এগোয়, সেই কৃতিত্বের বড় একাংশ দিতে হবে খালেদা জিয়াকেও।

গণতন্ত্র ও নির্বাচনের প্রতি অনমনীয় অঙ্গীকারের বাইরে বাংলাদেশের জন্য সম্ভবত তাঁর রেখে যাওয়া আরেকটা বার্তা হলো দক্ষিণ এশিয়ায় এই দেশের যে বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান, তাতে এখানে শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে তিনি হেলে পড়া কূটনৈতিক মডেলের বিপক্ষে ছিলেন। এটাও দেশের মানুষের তাঁকে পছন্দ করার বড় এক কারণ ছিল। বাংলাদেশকে যারাই বন্ধু হিসেবে দেখতে চাইবে, তাদের এই বাংলাদেশকে বোঝা দরকার।

খালেদা বলতেন, বাংলাদেশের বাইরে তাঁর কোনো ঠিকানা নেই। এই উক্তির ভেতর যে রাজনৈতিক আদর্শ, সাহস ও শক্তির প্রকাশ রয়েছে, কার্যত সেটাই বাংলাদেশ। তিনি বাংলাদেশের মতোই দক্ষিণ এশিয়ায় সাহসের প্রতীক ছিলেন। এ রকম সাহসই বাংলাদেশের অস্তিত্বের শর্ত।

  • আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক

    মতামত লেখকের নিজস্ব

[৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে এ লেখা নীতিতে দৃঢ় খালেদা জিয়া ছিলেন অন্তর্ভুক্তিমূলক–এ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।]