অপ্রকাশযোগ্য শোকের মৃত্যুগুলোর জন্য মেকি শোক

ককটেল বিস্ফোরণে নিহত যুবকের বাবা আলী আকবর মজুমদার ঘটনাস্থলে আহাজারি করছেন। গত বুধবার রাতে রাজধানীর নিউ ইস্কাটনেছবি: প্রথম আলো

সব মানুষের রক্ত লাল—এই প্রবচনটার প্রচলন মূলত মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই সেটার প্রকাশ করতে। দুঃখজনক হচ্ছে, রক্ত বা রক্তের রংও আসলে সে ফয়সালা দেয় না। এর জন্য আমাদের দেখতে হয় অনুভূতির প্রকাশও। শুধু রক্তের রং না; সুখ, শান্তি, দুঃখ বা শোকের রং কেমন সেখানেই একজন মানুষ কতটা মানুষ হিসেবে মূল্যায়িত হচ্ছে, সেটি খোলাসা হয়ে যায়। মানে এভাবেই হয়ে আসছে আদিকাল থেকে। যদিও আমরা সাম্যের জয়গান গেয়ে বিষয়টিতে স্বস্তির প্রলেপ লাগাতে চাই।

কোনো কোনো সমাজতাত্ত্বিকের মতে, সমাজ নির্দিষ্ট কিছু জীবনকে ‘শোকযোগ্য’ হিসেবে ফ্রেমিং করে থাকে এবং অন্যদের ‘অ-শোকযোগ্য’ হিসেবে। কার মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া সমাজ কীভাবে প্রকাশ করছে, তাতেই শ্রেণি রাজনীতি বোঝাটা খুবই সহজ বলা যায়। সিয়াম মজুমদারের নামটা এখনো এ দেশের অধিকাংশ মানুষই জানে না। যে কয়জন জানে, তাদেরও এ কয় দিনে ভুলে যাওয়ার কথা বা অল্প কয়েক দিনেই ভুলে যাবে। সিয়াম মগবাজার এলাকায় একটি দোকানের কর্মচারী ছিলেন।

২৪ ডিসেম্বর চা আনতে গিয়ে উড়ালসড়কের ওপর থেকে ছোড়া ককটেলে প্রাণটা হারালেন। তাঁর শরীরের রক্ত-মাংস চায়ের দোকানের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছিল। মানুষের মৃত্যু তো নিশ্চিত একটা ঘটনা। তাই বলে এতটা বীভৎস মৃত্যু, কল্পনা করা যায়! কারা ককটেল ছুড়ল, কারা একটা তরতাজা তরুণের প্রাণ কেড়ে নিল, তা হয়তো আমাদের কখনো জানা হবে না। ঘাতকেরা ঠিকই আরও মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকবে।  

চায়ের দোকানের সামনে মাথায় ককটেল পড়ে নিহত যুবকের স্বজনের আহাজারি। গত বুধবার রাতে রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে
ছবি: প্রথম আলো

খুলনার গ্রাম থেকে সিয়ামের পরিবারটি ঋণগ্রস্ত হয়ে ঢাকায় এসেছিল। তাঁর বাবা রিকশা চালানো শুরু করেন। মা হয়ে যান আমাদের ভাষায় বাসাবাড়ির ‘কাজের বুয়া’।  সিয়াম হয়েছিলেন দোকানের কর্মচারী। পরিবারের সবাই মিলে চেষ্টা করছিলেন ঋণমুক্ত হওয়ার। ছেলেকে হারিয়ে মা সিজু বেগমের বিলাপ, ‘আমি আর ঢাকায় থাকমু না। ঢাকায় আইস্যা সব শেষ হইয়্যা গেল।’ এই ‘জাদুর শহর’ ঢাকায় কেনই–বা তাঁরা আর থাকবেন!

ওমর ফারুকের মতো কত কত মানুষের গণপিটুনি, মব ভায়োলেন্স বা সহিংসতায় বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়ে বীভৎস মৃত্যু ঘটেছে বা ঘটছে—তা ভদ্র শ্রেণির বিবেকের দরজায় সামান্য টোকাও দেয় না। সিয়াম মজুমদার, ওমর ফারুকের মতো আরও অনেকের মৃত্যু—আমাদের শোকের ব্যাকরণে তাঁদের জন্য কোনো অধ্যায় তো দূরের কথা, একটা ছোট অনুচ্ছেদই নেই।
আরও পড়ুন

এবার রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় আরেক হতভাগা ভ্যানচালক ওমর ফারুকের মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা করা যাক। চুরির অভিযোগে তাঁকে নির্যাতন করে মারা হয়েছে। শুনে নিশ্চয় ‘স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া’ কোনো গণপিটুনির মৃত্যুর কথা মনে হতে পারে। কিন্তু এ হত্যার ঘটনা চরম নিষ্ঠুরতাকেও হার মানায়।

ভবানীগঞ্জের সিএনজি মালিক সমিতির সদস্যরা ওমর ফারুককে প্রথমে লোহার রড দিয়ে পেটাতে থাকেন। মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তাঁকে একটি প্রাচীরের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে উভয় হাত ও পায়ে হাতুড়ি দিয়ে কয়েকটি লোহার পেরেক ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তখনো মারধর চলতে থাকে। পানি পান করতে চাইলে নদীতে নিয়ে ওমর ফারুককে বিবস্ত্র করে চুবানো হয়। এরপর তাঁর পায়ুপথে শুকনা মরিচের গুঁড়া ঢেলে দেওয়া হয়।

নির্যাতনের একপর্যায়ে ওমর ফারুকের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। পরে ওমর ফারুকের কাছ থেকে গাঁজা উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ওমর ফারুককে ১০০ টাকা অর্থদণ্ড ও ৭ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।

এরপর ওমর ফারুককে বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রাজশাহী কারাগারে পাঠায় পুলিশ। সেখান থেকে তাঁকে পরদিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ২০ ডিসেম্বর ওমর ফারুকের মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন

ডার্ক কমেডি হিসেবে একটি কৌতুক আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। কৌতুকটি হলো: পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র প্রাণী কী? উত্তর: মানুষ। ওমর ফারুককে যেভাবে ধাপে ধাপে বিবিধ নির্যাতন করে মারা হলো, তাতে ডার্ক কমেডিটা নিশ্চয়ই নিছক কোনো কৌতুক থাকে না, চরম বাস্তব হয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়।

ওমর ফারুকের মতো কত কত মানুষের গণপিটুনি, মব ভায়োলেন্স বা সহিংসতায় বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়ে বীভৎস মৃত্যু ঘটেছে বা ঘটছে—তা ভদ্র শ্রেণির বিবেকের দরজায় সামান্য টোকাও দেয় না।

সিয়াম মজুমদার, ওমর ফারুকের মতো আরও অনেকের মৃত্যু—আমাদের শোকের ব্যাকরণে তাঁদের জন্য কোনো অধ্যায় তো দূরের কথা, একটা ছোট অনুচ্ছেদই নেই। যেহেতু তাঁরা সমাজের সুবিধাভোগী অংশের অন্তর্ভুক্ত নন, ফলে তাঁদের মৃত্যু ‘অশোকযোগ্যই’ থেকে যায় আমাদের কাছে। আর মৃত্যুর সঙ্গে যদি কোনো ‘রাজনীতি’ যুক্ত না থাকে, তাহলে আরও বেশিই ‘অশোকযোগ্য’।

এসব মানুষের জন্য রাষ্ট্র নেই, সরকার নেই, নাগরিক সমাজ নেই, বুদ্ধিজীবী নেই, মানবাধিকারকর্মী নেই, রাজনৈতিক মহল নেই—কেউ নেই। মার্ক্সীয় তত্ত্বের আলাপ থেকে বলতে হয়, একটি কারখানার যন্ত্র নষ্ট হলে যেমন সমাজ শোক প্রকাশ করে না, কেবল সেটি মেরামতের কথা ভাবে, শ্রমিক বা কর্মজীবী এসব মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রেও সমাজ একই আচরণ করে। সিয়াম বা ওমর ফারুকদের মৃত্যুতে এমনটিই তো দেখতে পাই। ‘সব শেষ হইয়্যা গেল’ মানুষগুলোর জন্য ‘প্রকাশযোগ্য শোক’ করতে না পারার ব্যর্থতা আমরা কোথায় লুকাব?

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

    [email protected]

    মতামত লেখকের নিজস্ব