বঙ্গবাজারে আগুন লাগার ব্যবস্থা তো করাই ছিল!

চোখের সামনে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পুড়ছে দেখে ব্যবসায়ীরা বিকট আর্তনাদ করছিলেন
ছবি: প্রথম আলো

ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘কৌরবদের আমি মারিয়াই রাখিয়াছি। অর্জুন নিমিত্তমাত্র।’

বঙ্গবাজার যখন দাউ দাউ করে পুড়ছিল; যখন দেখা যাচ্ছিল ‘পুড়ছে দোকানপাট, কাঠ, লোহালক্কড়ের স্তূপ...পুড়ছে টিয়ার খাঁচা, রবীন্দ্র রচনাবলি, মিষ্টান্ন ভান্ডার, মানচিত্র, পুরোনো দলিল’; তখন মনে হচ্ছিল শ্রীকৃষ্ণের সেই কথাটি আমাদের সিটি করপোরেশন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তারা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে বসে আছেন।

‘মৌচাকে আগুন দিলে যেমন সশব্দে সাধের আশ্রয়ত্যাগী হয় মৌমাছির ঝাঁক’ তেমনি কাপড়ের ব্যবসায়ীরা যখন কাপড়ের বস্তা, মালামালের ব্যাগ নিয়ে ছোটাছুটি করছিলেন দিগ্‌বিদিক; যখন উদ্ধারকর্মীদের গাড়ি ঠিকমতো ঢুকতে পারছিল না, ঘটনাস্থলেও গিয়ে যখন অগ্নিনির্বাপণকর্মীরা হাতের কাছে পানি পাচ্ছিলেন না; যখন চোখের সামনে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পুড়ছে দেখে ব্যবসায়ীরা বিকট আর্তনাদ করছিলেন; তখন মনে হচ্ছিল এ রকমই তো হওয়ার কথা ছিল।

আরও পড়ুন

যখন ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছিল মার্কেটটিকে ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করার পর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ১০ বার নোটিশ দিলেও কেউ রা করেনি; তখন মনে হচ্ছিল, দুর্ঘটনার যাবতীয় ব্যবস্থা করাই ছিল, আগুন ‘নিমিত্ত মাত্র’।  

মনে হচ্ছিল, নাগরিক সুরক্ষার মৌলিক বিষয়গুলোকে কী ভয়ংকরভাবে অবজ্ঞা করে মানুষকে মৃত্যুমুখে আগে থেকেই ফেলে রাখা হয়েছে। তাদের শুরু করে রাখা সেই কাজ মাঝেমধ্যে কোনো না কোনো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ শেষ করছে মাত্র। সেই বিবেচনায় এটি ‘দুর্ঘটনা’ নয়। এটি মনুষ্যকৃত বিপর্যয়।

এই বিপর্যয় নতুন নয়। শুধু এই বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেটেই এর আগে কমপক্ষে তিনবার আগুন ধরেছিল। ১৯৯৫ সালে দুইবার আর ২০১৮ সালে একবার। এরপর ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আগুন লাগার ঝুঁকির কথা লেখা ব্যানার টানিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, কিন্তু তাতে হুঁশ হয়নি কারও।

যাঁরা উৎসুক জনতা হিসেবে ঘটনাস্থলে ছিলেন, তাঁদের চোখও ভিজে আসছিল
ছবি: প্রথম আ্রলো

নজরুল ইসলাম নামের একজন বলছিলেন, ‘৪০ জন কর্মচারী আমার দোকানে কাজ করত, আর আজ আমি পথের ফকির’; রাসেল নামের একজন বলছিলেন, ‘২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ঈদের বাজারের লিগ্যা মাল উঠাইছিলাম, অখখন সব শ্যাষ, আমার চোক্ষে আন্ধার ছাড়া কিচ্ছু নাই।’

এই রকমের কয়েক হাজার ব্যবসায়ীর হাহাকার ধোঁয়ায় ভরা বাতাসে ভাসছিল। যাঁরা উৎসুক জনতা হিসেবে ঘটনাস্থলে ছিলেন, তাঁদের চোখও ভিজে আসছিল। পাশাপাশি আগুন আরও ছড়িয়ে পাশের মার্কেটগুলোতে লাগতে পারে—এমন আশঙ্কায় তাঁরাও জড়সড় হয়ে আসছিলেন।

আশপাশের রাস্তার দুই পাশে সারি সারি বস্তা ফেলে রাখা ছিল। কোনো কোনো বস্তা মাড়িয়ে পথচারী চলে যাচ্ছিল, সেই দৃশ্য তামাশা দেখতে যাওয়া লোকের কাছে যতটা সহজ ও নিরুদ্বেগের; সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর কাছে ততটা মর্মান্তিক।

আরও পড়ুন

দেশের সাধারণ মানুষ জামাকাপড় কেনেন মূলত দুটি ঈদ উৎসবে। কোরবানির ঈদে মানুষ কোরবানির পশু নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সে কারণে রোজার ঈদের কোরবানির ঈদের চেয়ে পোশাক বিক্রি হয় বেশি। এই দুই ঈদ আর দুর্গাপূজার সময়ের বেচাকেনার ওপর ভিত্তি করেই চলে পোশাকের ব্যবসা।

বছরের অন্য সময়ে টুকটাক যা কেনাবেচা হয়, তা দিয়ে দোকানভাড়া, কর্মচারীর বেতন ও সামান্য কিছু আয় হলেই ব্যবসায়ীরা খুশি থাকেন। এই ‘ডাল সিজন’-এর ক্ষতি ঈদের বাজার পুষিয়ে দেয়। সারা বাংলাদেশের মফস্বলের ব্যবসায়ীরা বঙ্গবাজার থেকে পাইকারি মার্কেট করতে আসেন।

প্রতিটি সর্বনাশই কারও না কারও জন্য ‘পৌষ মাস’ হয়ে থাকে। এ ধরনের বিপর্যয় কারও কারও জন্য লাভজনক হয়ে ওঠে। শত শত দোকান যেখানে ছাই হয়ে মাটিতে মিশে গেছে, সেখানে নতুন মার্কেট গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। নতুন নতুন ব্যবসায়ীকে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হবে। সেই সব বরাদ্দ দেওয়া নেওয়া নিয়ে নিশ্চয়ই কোটি কোটি টাকার লেনদেন হবে

রোজা শুরুর পর থেকেই বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা তুমুল ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আগামী এক বছরের কামাই নিশ্চিত করতে অনেক ব্যবসায়ী প্রয়োজনে ঋণ করে দোকানে মাল ওঠান। ঈদ সামনে রেখে এ বছরও ব্যবসায়ীদের সেই আয়োজন ছিল। কিন্তু পাঁচ-ছয় ঘণ্টার নরককুণ্ডে সব ছারখার হয়ে গেল।

এখন দায়বদ্ধতার প্রশ্ন উঠবে। কর্মকর্তারা যথারীতি অধস্তন কিছু কর্মীর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবেন। যাঁদের ওপর দোষ চাপানো হবে, তাঁরাও যে নিশ্চিতভাবে শাস্তি পাবেন, তা বলা যাবে না। সাধারণত এ ধরনের ঘটনায় ‘বিভাগীয় তদন্ত’ নামের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং যত দিন না বিপর্যয়টি বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়, তত দিন পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে। বঙ্গবাজারের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে তা আশা করা কঠিন।

আরও পড়ুন

আরেকটি বিষয় হলো, প্রতিটি সর্বনাশই কারও না কারও জন্য ‘পৌষ মাস’ হয়ে থাকে। এ ধরনের বিপর্যয় কারও কারও জন্য লাভজনক হয়ে ওঠে। শত শত দোকান যেখানে ছাই হয়ে মাটিতে মিশে গেছে, সেখানে নতুন মার্কেট গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। নতুন নতুন ব্যবসায়ীকে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হবে। সেই সব বরাদ্দ দেওয়া নেওয়া নিয়ে নিশ্চয়ই কোটি কোটি টাকার লেনদেন হবে।

অনেক নেতা ও কর্মকর্তা সেই স্বপ্ন হয়তো ইতিমধ্যে দেখা শুরু করেও দিয়েছেন। আলুর গুদামে আগুন লাগলে আলুখোরের যে ধরনের আনন্দ হয়, সেই আনন্দে তাঁরা হয়তো বঙ্গবাজারের ভস্মীভূত আগুনে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পোড়া আলু মনে মনে খেতেও শুরু করেছেন।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    [email protected]