দেহে মাদক পেলেই মাদকাসক্ত তকমা দিয়ে চাকরিচ্যুতি কি ঠিক

কেবল মাদক পরীক্ষা, যা সচরাচর ‘ডোপ টেস্ট’ নামে পরিচিত, সেটার মাধ্যমে একজনকে মাদক ব্যবহারকারী বলাই যখন নিশ্চিত নয়, তখন কেবল একটি পরীক্ষার মাধ্যমে কাউকে ‘মাদকাসক্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করা অবৈজ্ঞানিক
ছবি: প্রথম আলো

২৬ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, গত তিন বছরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ১১৬ জন্য সদস্য মাদকাসক্ত হিসেবে শনাক্ত হওয়ার কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। খবরে বলা হয়েছে, ওই সদস্যদের মাদকাসক্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে কেবল মাদক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মাদক পরীক্ষায় কারও প্রস্রাবে (আমাদের দেশে প্রস্রাব থেকেই মূলত মাদক পরীক্ষা করা হয়।

এ ছাড়া চুল, লালা, রক্তও পরীক্ষা করা যায়) মাদকের উপস্থিতির অর্থ হচ্ছে নমুনা নেওয়ার বিগত কিছু সময়ের বা দিনের মধ্যে তিনি মাদক গ্রহণ করেছেন। মাদক গ্রহণ মানেই কিন্তু ‘মাদকাসক্তি’ নয়। মাদক যিনি গ্রহণ করেছেন, তিনি ব্যবহারকারী বা ইউজার, যিনি নিয়মিত গ্রহণ করেন, তিনি নিয়মিত ব্যবহারকারী বা হ্যাবিচুয়াল, আর যিনি মাদক গ্রহণের কারণে মাদকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন, মাদক গ্রহণ না করলে তাঁর প্রত্যাহারজনিত উপসর্গ হচ্ছে, প্রতিনিয়ত মাদক গ্রহণের পরিমাণ বাড়াচ্ছেন, তিনি হচ্ছেন মাদকনির্ভরশীল বা ‘মাদকাসক্ত’।

আরও পড়ুন

তার মানে, কারও দেহে মাদকের অস্তিত্ব পাওয়া মানেই তিনি মাদকাসক্ত নন। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের মাদক পরীক্ষায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ ফলস পজিটিভ রেজাল্ট আসতে পারে; অর্থাৎ, মাদক গ্রহণ না করেও তিনি চিহ্নিত হতে পারেন মাদক গ্রহণকারী হিসেবে। আর একই গবেষণায় দেখা যায়, ১০ থেকে ১৫ শতাংশের ক্ষেত্রে ফলস নেগেটিভ আসতে পারে; অর্থাৎ, মাদক গ্রহণ করার পরও নমুনায় মাদকের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া মাদক সেবনের কত সময় পর নমুনা দিয়েছেন, সেটি এবং নমুনা দেওয়ার সময়ে নানান ফাঁকিজুকি করার বিষয়ে পরীক্ষার ফলকে প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে।

কেবল মাদক পরীক্ষা, যা সচরাচর ‘ডোপ টেস্ট’ নামে পরিচিত, সেটার মাধ্যমে একজনকে মাদক ব্যবহারকারী বলাই যখন নিশ্চিত নয়, তখন কেবল একটি পরীক্ষার মাধ্যমে কাউকে ‘মাদকাসক্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করা অবৈজ্ঞানিক।
এবার আসা যাক মাদকাসক্তি কী, সেটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ড্রাগ অ্যাবিউজের সংজ্ঞা কী বলছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মাদকাসক্তি হচ্ছে ক্রমাগত ও অতিরিক্ত সাইকোঅ্যাকটিভ রাসায়নিক বস্তু গ্রহণ করার কারণে বারবার হতে পারে, এমন একটি দীর্ঘমেয়াদি মস্তিষ্কের রোগ।’ প্রিন্সিপাল অব ড্রাগ অ্যাডিকশন পুস্তকে বলা হয়েছে, ‘মাদকাসক্তি একটি জটিল অথচ নিরাময়যোগ্য রোগ, যা আমাদের মস্তিষ্কের কাজকে প্রভাবিত করে এবং আচরণকে অস্বাভাবিক করে তোলে।’

আরও পড়ুন

এ কথা নিশ্চিত যে মাদকাসক্তি একটি রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব রোগের তালিকা ইন্টারন্যাশনাল ক্ল্যাসিফিকেশন অব ডিজিজে (আইসিডি) মাদকাসক্তিকে রোগ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমাদের সাধারণ বিশ্বাস আর ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তি একজন অপরাধী। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি অপরাধী নন; বরং তিনি অপরাধের শিকার, তিনি একজন রোগী। তিনি একটি গর্তে পড়ে গেছেন, গর্ত থেকে তাঁকে তুলে আনা আমাদের সবার দায়িত্ব, কিন্তু তাঁকে গর্ত থেকে না তুলে ‘কেন তুমি গর্তের কাছে গেলে?’ বলে তিরস্কার করা, শাস্তি দেওয়া যৌক্তিক নয়।

মাদকাসক্তি শনাক্ত কীভাবে হবে? প্রথম উত্তর হচ্ছে, মাদকাসক্তি শনাক্তে মাদক পরীক্ষা বা ডোপ টেস্ট কেবল সহায়ক পরীক্ষামাত্র, নিশ্চিত আসক্তি এর দ্বারা প্রমাণিত হয় না। মাদকাসক্তি সম্পূর্ণভাবে একটি ‘ক্লিনিক্যাল’ ডায়াগনসিস। অর্থাৎ, বিশেষজ্ঞ মনোচিকিৎসক বা সাইকিয়াট্রিস্ট কোনো ব্যক্তির পুরো ইতিহাস, তার চিন্তা-আবেগ-আচরণের নিরীক্ষণ (যাকে বলে ‘মেন্টাল স্টেট এক্সামিনেশন’) এবং তাঁর ও তাঁর পরিবারের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে নির্ণয় করবেন সেই ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে মাদকাসক্ত কিনা। মাদক গ্রহণ করা মানেই মাদকাসক্ত নয়, আসক্ত হতে হলে মাদক–নির্ভরতার বৈশিষ্ট্য (প্রত্যাহারজনিত উপসর্গ, মাদক গ্রহণের পরিমাণ বাড়তে থাকা এবং মাদক তাঁর একমাত্র আনন্দের উৎস) থাকতে হবে।

এগুলো না থাকলে এবং আচরণজনিত পরিবর্তন না হলে তিনি বড়জোর মাদক গ্রহণকারী, আসক্ত নন। তাই মাদকাসক্ত না হয়েও কেবল মাদক গ্রহণকারী হিসেবে মাদকাসক্তির তকমা পাওয়াটা সঠিক নয়। শুধু একবার বা দুবার মাদক পরীক্ষা করেই কাউকে মাদকাসক্ত বলা যাবে না। এমনকি মাদকাসক্তি যেহেতু একটি রোগ, তাই রোগের ভোগার কারণে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। ধরা যাক, আইন ও বিধির কারণে একজন মাদক ব্যবহারকারী বা আসক্ত সদস্যকে কোনো সংস্থা থেকে চাকরিচ্যুত করা হলো। যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চাকরিচ্যুতির কাজটিকে বাস্তবায়িত করলেন, তাঁদের সন্তানদের মধ্যে কেউ মাদক গ্রহণ করলে বা আসক্ত হলে, সেই সন্তানকে কি তিনি চিকিৎসা দেওয়ার বদলে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন?


যদিও প্রতিটি সংস্থার চাকরিবিধি ভিন্ন; কিন্তু যেহেতু ‘মাদকাসক্তি’ একটি স্বীকৃত রোগ, তাই বিষয়টিকে স্বাস্থ্যসেবার দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া উচিত তা হচ্ছে:

শুধু মাদক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে কখনোই কাউকে মাদকাসক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না, বিশেষজ্ঞের মতামত ও ক্লিনিক্যাল নিরীক্ষণ প্রয়োজন। মাদক পরীক্ষায় নমুনায় মাদকের উপস্থিতি মানেই মাদকাসক্ত নয়। বর্তমানে প্রচলিত মাদক পরীক্ষাকে আরও নির্ভুল আর বিজ্ঞানভিত্তিক করা জরুরি।

ঔপনিবেশিক সময়ের পুলিশ ফোর্স কালের বিবর্তনে আজকে পুলিশ সার্ভিসে রূপান্তরিত হয়েছে। কলেবর, দায়িত্ব আর মহিমা সবই বেড়েছে। করোনাকালে বাংলাদেশ পুলিশ মানবিক পুলিশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মাদক গ্রহণকারী ‘রোগী’র চিকিৎসা আর পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়ে নিজ বাহিনীতেও মানবিকতার চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা

বিশেষজ্ঞের ক্লিনিক্যাল নিরীক্ষণ, মাদক পরীক্ষা এবং বিস্তারিত ইতিহাসের ভিত্তিতে কোনো সংস্থায় কর্মরত কোনো ব্যক্তি মাদক গ্রহণকারী বা মাদকাসক্ত যা–ই হন না কেন, তাঁকে সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোলজিস্ট এবং সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির সামনে হাজির করতে হবে। কমিটির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ওই ব্যক্তিকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে বা চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের সেবা গ্রহণ করে মাদকমুক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

পরিপূর্ণ চিকিৎসার পর বিশেষজ্ঞ কমিটি আবার নিরীক্ষণ করে বলবেন, তিনি তাঁর দায়িত্ব পালনে সক্ষম কি না। দায়িত্ব পালনে সক্ষম হলে কী ধরনের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, সেটার সুপারিশ করা হবে। আর দায়িত্ব পালনে সক্ষম না হলে মাদক গ্রহণের কারণে আচরণের বড় ধরনের অস্বাভাবিকতা থাকলে বা অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে পরিস্থিতি অনুযায়ী তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসরে দেওয়া বা চাকরিচ্যুত করা যেতে পারে।

অর্থাৎ, মাদক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার আগে চাকরিচ্যুতি করতে হলে একটি ‘মেডিকেল’ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।

সবার আগে আমাদের মাইন্ডসেট পরিবর্তন করা জরুরি। মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা করা বা তাকে অপরাধী ভাবা চলবে না। সে একজন রোগী, এটা ভেবে শাস্তির বদলে তার চিকিৎসার দিকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। ঔপনিবেশিক সময়ের পুলিশ ফোর্স কালের বিবর্তনে আজকে পুলিশ সার্ভিসে রূপান্তরিত হয়েছে। কলেবর, দায়িত্ব আর মহিমা সবই বেড়েছে। করোনাকালে বাংলাদেশ পুলিশ মানবিক পুলিশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মাদক গ্রহণকারী ‘রোগী’র চিকিৎসা আর পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়ে নিজ বাহিনীতেও মানবিকতার চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা।

  • ডা. আহমেদ হেলাল সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা। [email protected]