পাকিস্তানি বাহিনী কেন ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশিদের মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হলো মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে না করে কেন ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল? যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রকাশনা ফরেন রিলেশনস (১৯৬৯-১৯৭৬) গ্রন্থ
থেকে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন নাদিম মাহমুদ। দুই পর্বের এই লেখায় আজ ছাপা হলো প্রথম পর্ব

দীর্ঘ ৯ মাস নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকার রমনা রেসকোর্স মাঠে জড়ো হয় পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী, ভারতের সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা। জনাকীর্ণ সাংবাদিকদের ক্যামেরার মুখে আত্মসমর্পণের সেই ঐতিহাসিক দলিলে পাকিস্তানের পক্ষে স্বাক্ষর করেন দেশটির জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আর মিত্রবাহিনীর পক্ষে স্বাক্ষর করেন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।

ঐতিহাসিক এই ছবি আমাদের রাষ্ট্রের বিজয়ের চূড়ান্ত মুহূর্তের হলেও এই আত্মসমর্পণ নিয়ে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর অনেকের মনে প্রশ্ন আছে। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আপামর জনতা ৯ মাস যুদ্ধ করলেও, ভারত মাত্র ১২ দিন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে কেন ভারতের কাছে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছে? এই প্রশ্নের উত্তর নানাভাবে উঠে এসেছে। তবে ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসের মধ্যে এই বিষয় ঠিক কী ধরনের আলোচনা সেই দেশের ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব ও গোয়েন্দা দলিলপত্রে উল্লেখ করেছেন, তা প্রথম আলোর পাঠকদের জানাতেই লেখাটির অবতারণা।

হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ৪ নভেম্বর ১৯৭১
ছবি : সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও কূটনৈতিকে পরিচালনা নীতি অনুযায়ী প্রতিটি সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় হোয়াইট হাউসে যেসব আলোচনা হয়, গোয়েন্দা তথ্যের আদান-প্রদান হয় সেই সব দালিলিক প্রমাণপত্র নিয়ে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ‘হিস্টোরিয়ান’ দপ্তর ১৯২৫ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ফরেন রিসেলশনস সিরিজ নামে গ্রন্থ প্রকাশ করো শুরু করে, যা দেশটির সরকারি প্রিন্টিং অফিস থেকে প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি এই সংক্রান্ত একটি কপি (ফরেন রিলেশনস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস, ১৯৬৯-১৯৭৬, ভলিউম এগারো, ১৯৭১ সালে এশিয়ার সংকট) দেখার সুযোগ মেলে, যা আমেরিকার অনেক পাবলিক গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। এই গ্রন্থে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে বিজয় পর্যন্ত যেসব ঘটনাপ্রবাহ মার্কিন সরকার করেছে, তা লিপিবদ্ধ আছে।

তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জারকে এই বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব দেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে নানা বিষয়ে যোগাযোগ স্থাপন করেন। আমেরিকা এ ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে যে সেতুবন্ধের কাজ করে, তা এই বইয়ের নানা আলোচনায় উঠে আসে। আমরা এই আলোচনায় কেবল ডিসেম্বর মাসের ঘটনার পরিক্রমা নিয়ে আলোচনা করব।

আরও পড়ুন

ভারত কেন যুদ্ধে জড়াল

একাত্তরের ১ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন ভারতে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিনেথ বানার্ড কিয়েটিং। এরপর তিনি ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জারকে একটি বার্তা পাঠান। সেই বার্তায় তিনি লেখেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে জানান যে পাকিস্তান তাঁদের সৈন্যদের সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। কিন্তু কেউ তাঁদের (পাকিস্তানের) সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য বলেননি। ভারত যুদ্ধের দিকে যেতে চায় না কিন্তু ইয়াহিয়াই সমস্যা তৈরি করেছেন। ফলে এখন ভারত এমন কিছু করবে না, যা ভারতকে দুর্বল করে তোলে।

কিন্তু ভারতের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ঠেকাতে এই বার্তা পাওয়ার পরপরই মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ওই দিনই ভারতে মার্কিন দূতাবাসের কাছে পাল্টা বার্তা পাঠানো হয়। যেখানে বলা হয়, ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের ভূখণ্ডে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সামরিক জিনিসপত্রের বিক্রয়নীতির পরিবর্তন আনবে, বিশেষ করে ২ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহের যে চুক্তি হয়েছিল, তা ১ ডিসেম্বর থেকে স্থগিত থাকবে। একই বার্তায় আরও বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে যখন পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করেছিল, তাদের ক্ষেত্রেও একই নীতি মার্কিন প্রশাসন অনুসরণ করেছে। মার্কিন এই সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে ভারত ও বাংলাদেশের গেরিলারা পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধ লড়াই চালু রাখে।

৩ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে বলছেন, ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে পাকিস্তানের বিমানবাহিনী কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের ছয়টি ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়েছে। এখন এ অবস্থায় আমাদের যুদ্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে ইন্দিরা গান্ধী জানিয়েছেন, তা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর্যবেক্ষণ দল তাদের প্রতিবেদন নম্বর ১৮–তে উল্লেখ করেছে। তবে ইসলামাবাদে মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো আরেক বার্তায় হোয়াইট হাউসকে সেদিন জানানো হয়, ৩ ডিসেম্বর ভারত বেলা সাড়ে ৩টা থেকে ৪টার ভেতর পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় আক্রমণ চালিয়েছে। (পৃষ্ঠা ৫৯৩)

ভারত কেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, তা ব্যাখ্যার জন্য একাত্তরের ৫ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে একটি চিঠি লিখে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, গত ২৫ মার্চের পর থেকে পূর্ব বাংলা কিংবা ভারতের ভেতরে ঘটে যাওয়া নানা বিষয়ে অসহনীয় পরিস্থিতির ব্যাপারে আমরা আপনাকে আমাদের বিভিন্ন কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে অবহিত করে আসছি। পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলায় ২৫ মার্চ থেকে জঘন্য গণহত্যা ও ব্যাপক সহিংসতা চালিয়ে আসছে। সেখান থেকে আমরা এরই মধ্যে এক কোটি মানুষকে ভারতে আশ্রয় দিয়েছি, যা এখনো বাড়ছে। পাকিস্তানের ধারাবাহিক উসকানির মুখেও আমরা অত্যন্ত সংযমের সঙ্গে আচরণ করে আসছি, যা আমরা ইতিমধ্যে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলকে অবহিত করেছি।

তিনি সেই চিঠিতে আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিজয়ের জন্য লড়াইকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার বাধ্যবাধকতা যুদ্ধাবস্থার প্রস্তুতিতে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। (পৃষ্ঠা ৬৩০-৩১)

১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা
ছবি : আনন্দবাজার

পাকিস্তানের যুদ্ধ রসদ সংকট ও পরাজয়ের বার্তা

২ ডিসেম্বর একটি মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসে জমা পড়ে। সেই ডকুমেন্টে দেখা যায়, পাকিস্তানের সৈন্যদের যুদ্ধ রসদ ও লোকবল কমে যাওয়ায় তারা অনেক জায়গায় চাপে পড়ে পালাচ্ছে। ঢাকার ১৭ মাইল নিকটবর্তী এলাকায় গেরিলারা বাংলাদেশের পতাকা ওড়াচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে যাতে কোনো কিছু ঢুকতে না পারে, সেই জন্য ভারতীয়রা ‘মুক্তিবাহিনী নেভি’ গড়ে তুলেছে। (পৃষ্ঠা ৫৯১)

ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে চিঠি লিখে তিনটি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানান। এক. সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা ও প্ররোচনায় ভারত যে আগ্রাসন চালাচ্ছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট বিবৃতি দিয়ে উভয় পক্ষের বাহিনীকে নিজ নিজ সীমান্তের পেছনে নিরাপদ দূরত্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো, দুই. সোভিয়েত ইউনিয়নকে কঠোরভাবে বার্তা দেওয়া, যাতে করে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের আগ্রাসনে সামরিক সহায়তা প্রদান থেকে বিরত থাকে এবং তিন. ৫ মার্চ ১৯৫৯-এ স্বাক্ষরিত পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা চুক্তির আওতায় আমাদের সামরিক সহায়তা চালু রাখা। (পৃষ্ঠা ৬০৫-৬০৬)

পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডকে ঠিক একই ধরনের বার্তা প্রেরণ করেন। বিষয়টি নিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইয়াহিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে তাঁকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এদিকে পাকিস্তান ও ভারতের এই যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই দেশটির নিরাপত্তা কাউন্সিলে বৈঠক করেছেন হেনরি কিসিঞ্জার। ৬ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় বৈঠকে কিসিঞ্জার তৎকালীন জেসিএস কর্মকর্তা জেনারেল উইলিয়াম ওয়েস্টমরল্যান্ডের কাছে জানতে চান, পাকিস্তান আর কত দিন পূর্ব (পাকিস্তান) কে ধরে রাখতে পারে? জবাবে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, বড়জোর তিন সপ্তাহের মতো।

আরও পড়ুন

পাকিস্তান যখন যুদ্ধের রসদ ফুরিয়ে নাস্তানাবুদ, ওদিকে ভারত ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ভারতের এই স্বীকৃতির পর হেনরি কিসিঞ্জার নিরাপত্তা কাউন্সিলের কাছে আরও জানতে চান, ভারত বাংলাদেশকে নিয়ে কী করতে চায়? জবাবে বৈঠকে উপস্থিত সিআইএ প্রধান রিচার্ড হেলমস বলেন, (বাংলাদেশকে) স্বাধীন করতে চায়। (পৃষ্ঠা ৬৫৭)

প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি লেয়ার্ডের নেতৃত্বে সমরাস্ত্র পলিসি কাউন্সিলের ৬ ডিসেম্বর আরও একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে মার্কিন কর্মকর্তারা মোটামুটি  নিশ্চিত হন, যদি ভারত পূর্ণমাত্রার আক্রমণ চালায়, তাহলে মুক্তিবাহিনী ও গেরিলারা ১০ দিনের ভেতর পূর্ব পাকিস্তানের অনেক জায়গা দখল করে বিদ্রোহী সরকার প্রতিষ্ঠা গঠন করে ফেলবে। পাকিস্তানের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় কোনো দেশের (ইরান) মাধ্যমে পাকিস্তানে রসদের সংগ্রহের কথা মার্কিন নেতৃত্বের আলোচনায় আসে।

৭ ডিসেম্বর ইসলামাবাদ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে লিখেছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। আমাদের সৈন্যরা পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহায়তা পাচ্ছে না। তারা (পাকিস্তানি সৈন্যরা) অনেক অসুবিধার মধ্যে রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা কাউন্সিলে ভেটো দিয়ে ভারতকে রাজনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। যদি ভারত যুদ্ধে জয়ী হয়, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি মানুষকে রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করলে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হিসেবে দাঁড়াবে। সীমান্তের (পাকিস্তান-ভারত) চাপ কমাতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি চাপ দিতে নিক্সনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতার চান ইয়াহিয়া (পৃষ্ঠা ৬৭৯)

সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপ

অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের সঙ্গে চুক্তি করার পর পাকিস্তানের ওপর চাপ আরও বাড়তে থাকে। ফলে ইয়াহিয়ার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৬ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ব্রেজনেভকে চিঠি লিখে বলেন, ভারতীয় সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের মতো একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রকে ভেঙে ফেলতে রাজনৈতিক দাবিগুলো চাপিয়ে দিচ্ছে। এই অবস্থায় আপনি জনসমক্ষে বলেছেন যে উপমহাদেশের ভৌগোলিক অস্থিরতা ও সংঘাতের কারণে আপনাদের নিরাপত্তা-স্বার্থ জড়িত। কিন্তু আপনারা পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ভারত সরকারের প্রকাশ্য শক্তি প্রয়োগকে সমর্থন দিচ্ছেন তা ইতিমধ্যে সংকটময় পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা হবে অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

জবাবে ওই দিনই সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের পক্ষে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে চিঠি লিখে জানানো হয়, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে, কিন্তু পাকিস্তান সরকার জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। পাকিস্তান ও ভারত সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়েছে, তা বন্ধ করার জন্য আমরা একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অনুরোধ প্রেসিডেন্টকে করেছিলাম। কিন্তু আমেরিকার পক্ষ থেকে কোনো সুস্পষ্ট অবস্থানের বিষয়ে আমরা জানতে পারিনি।

এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ৫ ডিসেম্বর বিবৃতি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আইনসংগত অধিকার ও স্বার্থের প্রতি সম্মানের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের মধ্যে দিয়ে রক্তপাত বন্ধের আহ্বান জানায়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে তাঁরা বলেন, ভবিষ্যতে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দেওয়া দুই প্রস্তাব; এক. পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে দ্রুত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব, দুই. পাকিস্তান সরকারকে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি পক্ষে অবস্থান নেন। (পৃষ্ঠা ৬৭৭-৭৮)

এরপর মার্কিন কূটনীতিক ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা হয়। কিন্তু সর্বশেষ ১১ ডিসেম্বর হেনরি কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে লেখেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কয়েকটি জাহাজ গতকাল (১০ ডিসেম্বর) জাপানের তাসুশিমা প্রণালি হয়ে জাপান সাগর ত্যাগ করেছে এবং ধারণা করা হচ্ছে যে এগুলো ভারত মহাসাগরের উদ্দেশে যাচ্ছে। জাহাজগুলোতে কী কী আছে, তা–ও জানানো হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সোভিয়েতের জাহাজবহরে সারফেস-টু-সারফেস ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, একটি গাইডেড মিসাইল ক্রুজার, একটি ডিজেলচালিত ক্রুজ মিসাইল সাবমেরিন, সব মিলিয়ে মোট ২০টি এসএস-এন শ্রেণির ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বহন করছে।

এ ছাড়াও আগে থেকে ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত নৌবাহিনীর ১৬টি ইউনিট রয়েছে, যার অর্ধেকই যুদ্ধজাহাজ নয়। তবে সোভিয়েতের এই যুদ্ধবহর জাহাজের কারণে পাকিস্তান ও তাদের মিত্ররা কিছুটা চাপে পড়ে যায়। (পৃষ্ঠা ৭৬৬)

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

    ইমেইল: nadim. ru@gmail. com

    মতামত লেখকের নিজস্ব