নেপালের রাজনীতিতে তোলপাড় ফেলা কে এই নতুন ‘নায়ক’

দুর্গা প্রসাই

নেপালে রাজনীতি খুব শক্তিশালী জনমাধ্যম। সেই সূত্রে সেখানে সক্রিয় রাজনৈতিক দল এবং খ্যাতনামা রাজনীতিবিদের কমতি নেই। নতুনভাবে অনেক তরুণ রাজনীতিতে এসেও বেশ সাড়া ফেলেছেন। এর মধ্যেই হঠাৎ মাঠ কাঁপিয়ে আবির্ভাব দুর্গা প্রসাইয়ের।

নেপালে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চান তিনি; দেশকে বানাতে চান হিন্দুরাষ্ট্র। তাঁর ডাকে জনতা সাড়াও দিচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়।

পুরোনো রাজনীতিবিদেরা তো বটেই, বহির্বিশ্বের অনেকেও নেপালের এই হুলুস্থুলে নড়েচড়ে বসেছেন। কেউ কেউ আবার মনে করছেন, এতে দেশের বাইরের ইন্ধন আছে।

কে এই দুর্গা প্রসাই, কী চাইছেন তিনি

গত নভেম্বরে রাজনীতিতে ঝড় তোলার আগপর্যন্ত দুর্গা প্রসাইকে বলা হতো ‘উদ্যোক্তা’। সোজা বাংলায় ব্যবসায়ী। স্বাস্থ্য খাতে বেশ বিনিয়োগ আছে তাঁর।

ঝাপা জেলা থেকে দুর্গা প্রসাইয়ের উত্থান। একসময় এ অঞ্চল মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। জীবনের শুরুতে মহিষ প্রজনন ব্যবসার মাধ্যমে ঝাপার কৃষিসমাজে পরিচিতি পান তিনি। পরে আরও বহু ব্যবসার ভেতর দিয়ে তিনি এখন নেপালের একজন বড়সড় ধনীও বটে।

দুর্গা প্রসাই মনে করেন, তাঁর দেশ দুরবস্থায় আছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে, যদি দেশে আবার রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হয়। বোনাস হিসেবে দেশের ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ পরিচিতিও ফিরিয়ে আনতে হবে। আরও সহজ করে বললে, অতীতের রাজপরিবার শাহ বংশকে তিনি দেশের আনুষ্ঠানিক প্রধানের জায়গায় দেখতে চান। সেটা সর্বশেষ রাজা জ্ঞানেন্দ্র হোক বা তাঁর পুত্র পরশ শাহকে হোক। এই আন্দোলনের নাম দিয়েছেন তিনি ‘নাগরিক বাঁচাও মহাভিযান’।

আরও পড়ুন

দুর্গা প্রসাইয়ের মতে, কংগ্রেস ও বামপন্থীরা নেপালের ওপর ধর্মনিরপেক্ষতা চাপিয়ে দিয়েছে। নেপালের জনগণ কখনো এ রকম রাষ্ট্রীয় পরিচয় চায়নি। এ অবস্থা থেকে ‘জাতি, জাতীয়তা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও নাগরিকদের বাঁচাতে’ নেমেছেন তিনি। আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর অনুসারীরা নেপালকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করবে বলেও জানিয়ে রেখেছেন তিনি।

রাজনীতির আসরগুলোয় দুর্গা প্রসাই ঝাঁজালো ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করেন। তাঁর ভঙ্গি ও ভাষা—দুটিই আক্রমণাত্মক। মনে হচ্ছে তিনি সংঘাতবাদী। কিন্তু প্রসাইয়ের কথায় অনেক নেপালি সম্মতি জানাচ্ছেন। নেপালে বহু মানুষ হঠাৎ পুরোনো রাজপরিবারের মধ্যে ত্রাতাসুলভ আশ্রয় খুঁজছেন।

দুর্গা প্রসাই অর্থনীতিতে স্বরাজের কথাও বলছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আধিপত্য চান না তিনি। আবার এ-ও বলছেন, রাজনীতির রশি হাতে পেলে কয়েক লাখ তরুণকে কাজ দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া কীভাবে রাতারাতি এত কাজের সুযোগ তৈরি হবে, সেটা স্পষ্ট করে বলছেন না এখনো প্রসাই। তবে তাঁর লোকরঞ্জনবাদী কথাবার্তা শহর ছাড়িয়ে শহরতলিতেও আলাপ-আলোচনার পরিসর দখলে নিচ্ছে।

দুর্গা প্রসাই বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষুদ্রঋণ নেওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ঋণ মওকুফের দাবিও যুক্ত করেছেন তাঁর মিছিল-মিটিংয়ের আওয়াজে। নেপালে গত কয়েক বছরে বহু আর্থিক সংস্থা মানুষের বিপুল ডিপোজিট নিয়ে পালিয়ে গেছে। প্রসাই এ সমস্যার সমাধানের কথা বলছেন জোরেশোরে। প্রান্তিক সমাজে বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এসব। আবার প্রসাই নিজেও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণগ্রহীতা।

আরও পড়ুন

কেন সাধারণ মানুষ প্রসাইকে পছন্দ করছেন

দুর্গা প্রসাইয়ের দাবিদাওয়ায় শোরগোল ওঠার মূল কারণ নেপালের সমাজের বহু ধরনের বিভক্তি। সাধারণভাবে বহু জাতির দেশ এটা। সবার স্বার্থ একরকম নয়। আবার বিভিন্ন আদর্শবাদী রাজনীতিও এখানে সমাজকে তিক্তভাবে ভাগ করে রেখেছে। নেপালে প্রভাব বিস্তারে ভারত-চীনের টানাপোড়েনও রাজনীতিতে বাড়তি উত্তাপ জারি রেখেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে কাজ করলেও দেশটিতে সরকার গঠনে জনরায়ের প্রতিফলন থাকে কমই।

গত নির্বাচনে যে দুটি দল প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছে তারা নয়—সরকার গড়েছেন তৃতীয় প্রধান দলের নেতা পুষ্পকমল দহল প্রচণ্ড। প্রথম ও দ্বিতীয় দল পরস্পরকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে যার যার বিদেশি বন্ধুর ইচ্ছেমতো মরণপণ করায় তৃতীয় পক্ষ এ রকম সুযোগ পেল। তবে জনগণ যখন সরকার পরিচালনায় তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখে না, তখন স্বাভাবিকভাবে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়। দীর্ঘদিন এ রকম দেখতে দেখতে তারা বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়েই সন্দিহান হয়ে পড়েছে।

পুরোনো দল নেপালি কংগ্রেসের পাশাপাশি মানুষ ‘মাওবাদী’দের নিয়েও হতাশ। শেষোক্তরা বহুধারায় বিভক্তও এখন। কংগ্রেস ও মাওবাদীদের মাঝের অপর শক্তি জাতীয়তাবাদী-বামপন্থী কে পি শর্মা অলিও সরকার পরিচালনায় নাগরিকদের সন্তুষ্ট করতে পারেননি।

দুর্গা প্রসাইয়ের আয়োজন নেপালে রাজনীতির চেহারা কতটা বদলাবে, তা স্পষ্ট নয় এখনো। কিন্তু এর সঙ্গে যদি রাজপরিবারের প্রকাশ্য আবির্ভাব ঘটে যায়, তাহলে ব্যাপক একটা জোয়ার যে উঠবে, সে রকম শঙ্কা আছে। প্রসাই ইতিমধ্যে দাবি করে রেখেছেন, ১৭ ফেব্রুয়ারি নেপালকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণার দিন রাজা পুরোনো দরবার ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন এবং জনতার উদ্দেশে কথা বলবেন।

সামগ্রিক এই হতাশা ও অসন্তুষ্টির একটা প্রতিফলন ছিল বিগত সময়ে কাঠমান্ডুর মেয়র পদে সব রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে একজন গায়ক বালেন শাহর মেয়র হয়ে যাওয়া। মূলত তরুণ সমাজের প্রত্যাখ্যানের শক্তিতে সেই নির্বাচনী যুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীরা ধরাশায়ী হন। একই তরুণদের আরেক বড় প্রবণতা বিদেশমুখিতা। বাংলাদেশের মতোই নেপালের উচ্চশিক্ষিত সমাজ দেশ ছাড়তে উন্মুখ। তারা দেশের ভেতর আর কোনো সম্ভাবনা দেখছে না। ঠিক এই বাস্তবতার সুযোগ নিচ্ছেন দুর্গা প্রসাই।

তাঁর আবির্ভাব অত্যন্ত ‘সঠিক সময়ে’ ঘটেছে বলেই দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক পদক্ষেপ ফেলায় তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। যদিও এই আয়োজন দেশটিকে ইতিহাসের পেছনের দিকে নিতে চাইছে, কিন্তু প্রকৃতই নেপালে দুর্গা প্রসাইয়ের নেতৃত্বে নতুন একটা সামাজিক শক্তির আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে। তবে দুর্গা প্রসাইয়ের রাজনীতি এখনো অস্পষ্টতায় মোড়ানো আছে।

দেশটির প্রভাবশালী দৈনিক কাঠমান্ডু পোস্ট ৩ ডিসেম্বর সম্পাদকীয়তে বলেছে, ‘দুর্গা প্রসাই দেশকে আবার হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে চেয়ে আসলে একটা অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে চাইছেন।’ পত্রিকাটির ভাষায়, ‘আশি শতাংশ হিন্দুর দেশকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করতে চাওয়ার বাড়তি কোনো তাৎপর্য নেই। এটা এমনিতেই হিন্দুদের দেশ হয়ে আছে। নতুন প্রস্তাবের লক্ষ্য একটাই—ধর্ম দিয়ে রাজনীতিকে নাড়াচাড়া করা।’

মূলধারার রাজনীতিবিদেরা প্রসাইকে নিয়ে মুশকিলে পড়েছেন

কংগ্রেস ও বামপন্থী হেভিওয়েটরা দুর্গা প্রসাইয়ের নাটকীয় উত্থানে প্রথম থেকেই নার্ভাস। এমনকি তরুণ প্রজন্মের যে রাজনীতিবিদেরা নেপালে আশার সঞ্চার করেছিলেন, সেই রবি লামিচানের দলও পরিস্থিতিতে হকচকিত। দুর্গা প্রসাইয়ের মিটিং-মিছিলের মধ্যেই কংগ্রেসের শেরবাহাদুর দেওবা বলেছেন, নেপালের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় চরিত্র নিয়ে আবারও আলোচনা হতে পারে। একই সময়ে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী দহল এবং বিরোধী দলের কে পি শর্মা অলিও হিন্দুধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসা-যাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছেন।

এ রকম সবার জন্য একটা মুশকিলের দিক হলো দুর্গা প্রসাইয়ের উদ্যোগ এখনো কোনো রাজনৈতিক দলের চেহারা নেয়নি। ফলে তাঁর সমর্থকদের মোকাবিলা করতে যাওয়া মানে জনতার ওপর চড়াও হওয়া। প্রসাই হয়তো সেভাবেই খেলার ছক এঁকেছেন। কিন্তু বিরোধীপক্ষ কেউ সেই ঝুঁকি নিচ্ছে না আপাতত। সবাই বুঝতে পারছেন, রাজনীতি ও ধর্মের মিশেলে দুর্গা প্রসাই একটা মেয়াদি বোমা হাজির করেছেন। ঠিক কখন এটা ফেটে পড়বে, সেটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না, বুঝতেও পারছেন না।

আরও পড়ুন

প্রসাইয়ের পেছনে কে আছে

দুর্গা প্রসাই অর্থবিত্তে বড়লোক। নেপালের রাজনীতির ওপরমহলে সবার সঙ্গে অতীতে তাঁর যোগাযোগ ছিল। ইউএমএলের (ইউনাইটেড মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট দল) সঙ্গেই ছিল তাঁর বেশি ঘনিষ্ঠতা। প্রথম জীবনে মাওবাদীদের সঙ্গেও মেলামেশা ছিল। সেই সূত্রে একবার সেনাবাহিনীর হাতে আটকও হন। তখন আবার নেপালি কংগ্রেসের বন্ধুদের সহায়তায় নিজেকে মুক্ত করেন। অর্থাৎ প্রধান তিন দলের অনেককে প্রসাই চেনেন এবং তাঁকেও চেনেন বহু নেতা।

তবে এখন প্রসাই এসব যোগাযোগ ছাপিয়ে সবাইকে অতিক্রম করে যেতে চাইছেন। আপাতত সরাসরি কোনো যোগসূত্র পাওয়া না গেলেও রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের ধারণা, প্রসাইয়ের উদ্যোগে পুরোনো রাজাপরিবারের ইন্ধন আছে। দুর্গা প্রসাইকে সামনে রেখে শাহ বংশ জনমতকে নেড়েচেড়ে দেখছে। অবস্থা সুবিধাজনক মনে হলে সর্বশেষ রাজা নিজেই রাজনীতির ময়দানে নামবেন কিংবা পুত্রকে নামাবেন।

স্থানীয় রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের বড় একাংশ মনে করেন, দুর্গা প্রসাইয়ের উদ্যোগের পেছনে দেশের বাইরেরও মদদ আছে। বিশেষ করে নেপাল আবার হিন্দুরাষ্ট্র হোক—এ দাবির পক্ষে অনেক দিন থেকে এমন কিছু সংগঠন সক্রিয়, যাদের কাজের পরিসর দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে।

প্রসাইয়ের রাজনীতির পরিণতি কী হতে পারে

রাজতন্ত্রকে আবার রাজনীতির মাঠে নিয়ে আসার জন্য নেপালে অনেক আগে থেকে আরও কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দল চেষ্টা করছে। এর মধ্যে আছে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র দল ও এর নেতা রাজেন্দ্র লিঙ্গডেন। পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে রাজেন্দ্র ও তাঁর দল কিছুটা প্রভাবশালী হলেও রাজতন্ত্র ও হিন্দুতন্ত্রের পক্ষে জনজোয়ার তৈরি করতে পারেননি—দুর্গা প্রসাই যে রকম ইঙ্গিত দিচ্ছেন। নিজ সমর্থকদের কিছু অনুষ্ঠানে বর্তমান জাতীয় সংগীতের বদলে ২০০৭ সালে বাতিল হওয়া রাজতন্ত্রের আমলের জাতীয় সংগীত বাজিয়ে দুর্গা প্রসাই সরাসরি একটা মেরুকরণ উসকে দিচ্ছেন।

দুর্গা প্রসাইয়ের আয়োজন নেপালে রাজনীতির চেহারা কতটা বদলাবে, তা স্পষ্ট নয় এখনো। কিন্তু এর সঙ্গে যদি রাজপরিবারের প্রকাশ্য আবির্ভাব ঘটে যায়, তাহলে ব্যাপক একটা জোয়ার যে উঠবে, সে রকম শঙ্কা আছে। প্রসাই ইতিমধ্যে দাবি করে রেখেছেন, ১৭ ফেব্রুয়ারি নেপালকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণার দিন রাজা পুরোনো দরবার ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন এবং জনতার উদ্দেশে কথা বলবেন।

বলা বাহুল্য, এ রকম কিছু কাঠমান্ডুতে বেশ বড় আবেদন তৈরি করবে এবং এর প্রথম রাজনৈতিক শিকার হবে নেপালি কংগ্রেস। দ্বিতীয় শিকার হবে কে পি শর্মা অলির জাতীয়তাবাদী ধাঁচের ইউএমএল দল। মাওবাদীরা হয়তো শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলে জোয়ারের মুখে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চাইবে কিছুদিন। তবে কাঠমান্ডুতে ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে মাওবাদীদের অফিসের পাশেই প্রসাইয়ের দপ্তরে জনসমাগম কেবল বাড়ছেই।

  • আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক