হার্ভার্ডের সাংস্কৃতিক লড়াই

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী প্রেসিডেন্ট ক্লডিন গে–কে পদত্যাগ করতে হয়েছে

কয়েক সপ্তাহজুড়ে চলা প্রচণ্ড চাপের মুখে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী প্রেসিডেন্ট ক্লডিন গে-কে পদত্যাগ করতে হলো। কিন্তু যাঁরা তাঁকে নিয়ে বিতর্কের পালে হাওয়া দিয়েছেন, তাঁরাও ধোয়া তুলসীপাতা নন।

আপাতদৃষ্টে ক্লডিন গের পদত্যাগের কারণ তাঁর গবেষণা। সেটি মানসম্মত নয় বলে কেউ কেউ উল্লেখ করছেন। মূল অভিযোগটি হলো তিনি তাঁর লেখায় অন্য লেখকদের লেখার বিভিন্ন অংশ সঠিকভাবে উদ্ধৃত না করে প্রকাশ করেছেন।

তবে লেখার দুর্বলতা নিয়ে আলোচনার মধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে ইহুদিবিদ্বেষ ও দ্বিচারিতার অভিযোগ তোলা হয়। রিপাবলিকান কংগ্রেস ওম্যান এলিস স্টেফানিক তাঁকে প্রশ্ন করেন, আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা যদি ইহুদিদের গণহত্যার ডাক দেন, তাহলে তা হার্ভার্ডের আচরণবিধি লঙ্ঘন করে কি না। এ প্রশ্নের জবাবে গে বলেন, ‘এটি প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করবে।’

এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই, যদি কৃষ্ণাঙ্গদের গণহত্যার প্রসঙ্গে এই একই প্রশ্ন করা হতো, তাহলে তিনি প্রেক্ষাপট বিবেচনার কথা বলতেন না।

আরও পড়ুন

আসলে গে একটা নোংরা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছিলেন। স্টেফানিকের প্রশ্নটি ছিল উদ্দেশ্যমূলক। ইচ্ছা করেই তিনি গণহত্যার আহ্বান ও ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদার (সশস্ত্র বিদ্রোহ) মধ্যে যে পার্থক্য আছে, সে বিষয় চেপে গেছেন। ইন্তিফাদায় সহিংসতা সংশ্লেষ আছে, তবে এর সঙ্গে গণহত্যার কোনো সম্পর্ক নেই।

যেসব দক্ষিণপন্থী গে-কে পদত্যাগে বাধ্য করলেন, তাঁরাও খুব সজ্জন-সুশীল নন। ম্যানহাটান ইনস্টিটিউটের ক্রিস্টোফার রুফোর দাবি, গে কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় তাঁর ক্যারিয়ারে অন্যায্য সুবিধা ভোগ করেছেন।

গে আবার তাঁদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ এনেছেন। যদি তাঁরা বর্ণবাদী না-ও হয়ে থাকেন, তাঁরা একটি তথাকথিত প্রাগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন। ওই গোষ্ঠীর কাজই হলো তাদের মতাদর্শগত অবস্থানের সঙ্গে কারও অমিল হলেই তাকে খারিজ করে দেওয়া।

সবশেষ, ইহুদি ধনকুবের ও হার্ভার্ডের শীর্ষস্থানীয় দাতা বিল আকম্যানও যথেষ্ট নিন্দিত হয়েছেন। এই বিল নিরলস প্রচারণা চালিয়ে গেছেন গের বিরুদ্ধে। অনুদান দিলেও কারও শিক্ষা কর্মসূচিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ করার অধিকার জন্মানো উচিত নয়। আকম্যানও হার্ভার্ডের বিরুদ্ধে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ এনেছেন।

ইহুদিবিদ্বেষীরা ইহুদিদের যুক্তরাষ্ট্রের সমার্থক মনে করে। আর ইউরোপের জাতীয়তাবাদীরা ইহুদি ও মার্কিন—দুই পক্ষকেই শিকড়বিহীন বিশ্বনাগরিক বলে। এখন ফিলিস্তিনের পক্ষে আন্দোলনরতরা ইসরায়েল আর যুক্তরাষ্ট্রকে সমার্থক মনে করে।

বর্ণ নিয়ে মার্কিনদের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগের নোংরা বিতর্ককে খুঁচিয়ে তুলেছে। যদিও গে এবং ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার প্রেসিডেন্ট লিজ ম্যাগিলের বক্তব্যে ইহুদিদের নিয়ে ধারণা যে বদলে গেছে, তার প্রকাশ ঘটেছে। বলাই বাহুল্য, স্টেফানিকের পাতা ফাঁদে সেদিন লিজ ম্যাগিলও পা দিয়েছিলেন।

গে, ম্যাগিল অথবা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা ইহুদিবিদ্বেষী—এ অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই। (হামাসের পক্ষে যাঁরা গলা ফাটাচ্ছেন, তাঁদের কথা আলাদা)। কিন্তু ফিলিস্তিন ইস্যুর চরম সমর্থক এবং ‘বৈচিত্র্য, সমতা এবং অন্তর্ভুক্তি’বাদের চরম বিরোধী—এ দুই দলই অনড় অবস্থানে আছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে যাঁরা জোরদার আন্দোলন করছেন, তাঁরা গাজায় ইসরায়েলি দখলদারিকে শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন বলে উল্লেখ করছেন।

তাঁরা মনে করছেন, ইসরায়েলিরা শ্বেতাঙ্গ এবং বর্বরভাবে অশ্বেতাঙ্গদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। আর সে জন্যই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে যাঁরা রাস্তায় নেমেছেন, তাঁরা স্লোগান দিচ্ছেন, ‘আইডিএফ, কেকেকে সব এক!’ যেন ইসরায়েলি সৈন্যরা (যুক্তরাষ্ট্রের) দক্ষিণের বর্ণবাদী লোকেদের মতো। কারণ, তাঁরা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করতেন।

অতীতে ইহুদিবিদ্বেষের যে ধরন ছিল, তা বদলে গেছে। উনিশ শতকের আগে, খ্রিষ্টানরা ইহুদিদের ওপর নির্যাতন করত যিশুখ্রিষ্টকে হত্যার অপরাধে। যখন নতুন জাতি-রাষ্ট্রের উত্থান হলো এবং ইহুদিরা ধর্মের আচার-আচরণ থেকে বেরিয়ে এসে সামাজিক মুক্তির পথে হাঁটল, তখন পুরোনো ঘৃণাকে উসকে দিতে নতুন নতুন যুক্তি হাজির হলো। ইহুদিদের শ্বেতাঙ্গ হিসেবে বিবেচনার বদলে ইউরোপীয় ও মার্কিন ধর্মান্ধরা তাদের বিচ্ছিন্ন এক জাতি হিসেবে গণ্য করল।

যেকোনো রাজনৈতিক দলের ইহুদিবিদ্বেষীরাই ইহুদিদের নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র ও সন্দেহের কথা বলেন। তাঁরা সন্দেহ করেন, পর্দার আড়াল থেকে সারা বিশ্বের কলকাঠি নাড়ছে অসীম ক্ষমতাধর ইহুদিদের একটি চক্র।

দক্ষিণপন্থী ইহুদিবিদ্বেষীরা মনে করেন, ইহুদিরা বলশেভিক ষড়যন্ত্রকারী এবং জাতিগোষ্ঠীর শুদ্ধতাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কমিউনিস্টরা তাদের পুঁজি ও ধনবাদী মনে করে, যাদের কাজ শ্রমিক শোষণ করা। ইহুদিদের অনেকেই জায়নবাদের পক্ষে অবস্থান নেন। কারণ, তাঁরা ভাবেন, নিজেদের একটি রাষ্ট্র গড়তে পারলে তাঁরা আর বহিরাগত বা স্তালিন যেমনটি বলেছিলেন, সেই শিকড়বিহীন জাতি বলে গণ্য করবে না। ইসরায়েলে তাঁরা থিতু হতে পারবেন।

আরও পড়ুন

কিন্তু শুরুতেই ইসরায়েলের কিছু সমালোচনাকারী অনুধাবন করেছিলেন, যে দেশগুলো একসময় ইহুদিদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, ইসরায়েলও ক্রমে সেই দেশগুলোর বৈশিষ্ট্য অর্জন করবে।

এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলো, নিজ জাতিগোষ্ঠীর বাইরে থেকে কাউকে গ্রহণ না করা, নিজ জাতিগোষ্ঠী-সম্পর্কিত ইস্যুতে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা এবং সামরিক শক্তিমত্তার প্রদর্শন।

১৯৪০ সালে হান্নাহ আরেন্ত জায়নবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হন। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি এই মতাদর্শের সমালোচক হয়ে ওঠেন। কারণ, তিনি দেখেছিলেন, ইহুদিদের জন্য গঠিত রাষ্ট্র ক্রমে ইহুদি হয়ে উঠেছে। সেখানে নির্যাতিত শরণার্থীদের কোনো স্থান নেই। দেশটি ক্রমে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র হয়ে উঠছে। একসময় নির্যাতিত হয়েছিল, এই অজুহাতে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে।

ইসরায়েলের এই পরিবর্তন হয়েছে ক্রমে। যাঁরা দেশটির প্রথম দিককার বাসিন্দা, তাঁদের বড় অংশই বামপন্থী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছিল। কিন্তু ইসরায়েলের বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায় নির্লজ্জ বর্ণবাদীরা জায়গা পেয়েছেন।

জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতমার বেন-গিভির অন্তত ছয়বার বিদ্বেষ উসকে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। শুধু এই কারণেই ইসরায়েল এখন ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণপন্থীদের কাছে এত প্রিয়।

১৯৩০-এর দশকে ‘আমেরিকা ফার্স্টার্স’ যাদের মধ্যে চার্লস লিন্ডবার্গের মতো সাহসী পাইলটরা আছেন, তাঁরা ছিলেন ইহুদিবিদ্বেষী। তাঁরা নাৎসি জার্মানির প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ আরও যাঁরা ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান দেন, তাঁরা ইহুদি রাষ্ট্রের কঠোর সমর্থক। কেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোয় আইডিএফকে কেকেকের সঙ্গে তুলনা করা হয়, এর অন্যতম কারণ এটাই।

ইহুদিবিদ্বেষীরা ইহুদিদের যুক্তরাষ্ট্রের সমার্থক মনে করে। আর ইউরোপের জাতীয়তাবাদীরা ইহুদি ও মার্কিন—দুই পক্ষকেই শিকড়বিহীন বিশ্বনাগরিক বলে। এখন ফিলিস্তিনের পক্ষে আন্দোলনরতরা ইসরায়েল আর যুক্তরাষ্ট্রকে সমার্থক মনে করে।

তাদের যুক্তি হলো, দুই পক্ষই অশ্বেতাঙ্গদের টুঁটি চেপে ধরেছে। হয়তো স্টেফানিকের কুটিল প্রশ্নের জবাবে গে এই প্রেক্ষাপটের কথাই বলতে চেয়েছিলেন। অনেকেই আশা করেছিলেন, গে আরও পরিষ্কারভাবে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করবেন। অনেকেরই প্রত্যাশা, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ‘বর্ণ’ ইস্যুতে যে মাতামাতি, তা কমে আসবে। কিন্তু এ মুহূর্তে আশা বা প্রত্যাশা সুদূরপরাহত।

  • ইয়ান বুরুমা সম্প্রতি ‘দ্য কোলাবরেটরস: থ্রি স্টোরিজ অব ডিসেপশন অ্যান্ড সারভাইভাল ইন ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু’ নামে তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত