জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে সম্প্রতি যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, সে বিষয়ে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল চোখে পড়ার মতো। আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হামলায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের প্রায় সবাই ভারতীয়। সংখ্যায় ২৬ জন।
তালেবান বলেছে, এমন হামলা গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। এই মন্তব্যের মাধ্যমে তারা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকেই দোষারোপ করেছে। কারণ, হামলাকারীদের মদদদাতা যে পাকিস্তান, তা অজানা নয়। এটি প্রথম নয়, তালেবান ও তাদের একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব বাড়ার আরও আগের বহু ইঙ্গিত রয়েছে।
গত বছরের শেষ নাগাদ এই সম্পর্ক এতটাই খারাপ পর্যায়ে গিয়েছিল যে দুই পক্ষের উত্তেজনা কমাতে পাকিস্তানের আফগানিস্তান–বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি মোহাম্মদ সাদিক খানকে তালেবান নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য কাবুলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু সে সময়, ২৪ ডিসেম্বর, পাকিস্তানের বিমানবাহিনী আফগানিস্তানের পাক্তিকা প্রদেশে বোমা হামলা চালিয়েছিল। তারা পাকিস্তানি তালেবানের (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপি) ঘাঁটিগুলো লক্ষ্য করে আঘাত হানে। এতে ৪৬ জন নিহত হন। হামলাটি ছিল ২১ ডিসেম্বর টিটিপির একটি হামলার জবাব, যেখানে ১৬ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হন।
তিন দিন পর পাকিস্তানের আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী একটি করুণ পরিসংখ্যান দেন। তিনি বলেন, গত এক বছরে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে পাকিস্তানের ৩৮৩ জন কর্মকর্তা ও সৈন্য নিহত হয়েছেন। তিনি দাবি করেন, এ সময়ে প্রায় ৯২৫ জন জঙ্গিকে হত্যা করা হয়েছে, যাঁদের অনেকে টিটিপির সদস্য। তিনি জানান, টিটিপি সরাসরি পাকিস্তান ও পাকিস্তানের নাগরিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে এবং তারা আফগানিস্তানে আশ্রয় পাচ্ছে।
এ বক্তব্যে প্রচণ্ড দ্বৈততা ফুটে ওঠে। কারণ, অতীতে পাকিস্তানই মার্কিন বাহিনী ও আগের আফগান সরকারকে উৎখাত করতে আফগান তালেবান ও হাক্কানি নেটওয়ার্ককে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে এসেছে। এসবেরই ফলে ২০২১ সালে তালেবান আফগানিস্তানে আবার ক্ষমতায় আসে। কয়েক বছরের ব্যবধানে এখন দৃশ্যপট বদলে গেছে।
২৮ ডিসেম্বর এই দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়, যখন আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় একাধিক স্থানে পাকিস্তানের ভেতরে হামলার ঘোষণা দেয় এবং এর দায় স্বীকার করে। তারা জানায়, এটি ছিল পাকিস্তানের আগের বিমান হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়া। যদিও আফগান সরকার সরাসরি পাকিস্তানের ভূখণ্ডে হামলার কথা স্বীকার করেনি, তারা বলেছে ‘কাল্পনিক রেখার’ ওপারে হামলা চালানো হয়েছে। এখানে ‘কাল্পনিক রেখা’ বলতে বোঝানো হয়েছে ঔপনিবেশিক যুগের সেই সীমান্তরেখাকে (ডুরান্ড লাইন নামে পরিচিত), যেটিকে আজ পর্যন্ত কোনো আফগান সরকারই স্বীকৃতি দেয়নি।
তার পর থেকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে, পাকিস্তান তাদের পুরোনো মিত্র তালেবানের ওপর আর আগের মতো নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বহু বছর ধরে তালেবানকে গড়ে তুলেছে—তাদের আশ্রয় দিয়েছে, অস্ত্র ও অর্থ দিয়েছে, প্রশিক্ষণ দিয়েছে। পাকিস্তান আফগানিস্তানে নিজের প্রভাব বজায় রাখতে এবং ভারতের বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা অর্জনের জন্য এদের ব্যবহার করত।
২০২১ সালের আগস্টে তালেবান কাবুল দখল করলে পাকিস্তান প্রকাশ্যেই উচ্ছ্বাস দেখিয়েছিল। কিন্তু এ ঘটনা এখন তাদের জন্য উল্টো বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্পের মতো নিজের বানানো দানবকে সব সময় নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। পাকিস্তান এখন বুঝতে পারছে, চাপ সৃষ্টি করে বা কূটনীতির মাধ্যমে কথা বলে—কোনোভাবেই তারা আর তালেবানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
আফগানিস্তান-পাকিস্তান সম্পর্ক এখন দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে পুরোনো ক্ষোভ, ভুল কূটনীতি আর আদর্শগত দ্বন্দ্ব। একসময় আফগানিস্তানকে পাকিস্তান কৌশলগত সম্পদ মনে করত। এখন সেটাই হয়ে উঠেছে ভয়াবহ বোঝা।
সমস্যা হচ্ছে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে তালেবানপন্থী অনেকে এখন যথার্থ ‘ইসলামপন্থী’ মনে করে না। ফলে পাকিস্তানি তালেবান বা টিটিপি এখন পাকিস্তানে সেই একই কাজ করতে চায়, যা একসময় তালেবান আফগানিস্তানে করেছিল। অর্থাৎ টিটিপি ক্ষমতা দখল করে দেশকে কট্টর ইসলামি শাসনের আওতায় নিয়ে আসতে চায়। আর তালেবান ও টিটিপির মধ্যে যে আদর্শগত মিল আছে, তাতে অনেকেই মনে করছেন, আফগান তালেবানও হয়তো এই কাজে টিটিপিকে সহায়তা করছে।
ফলে আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক এখন একধরনের কৌশলগত বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে দেশের অভ্যন্তরে বাড়তে থাকা চাপের মুখে পাকিস্তান সরকারের কিছু অংশ এখন এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাওয়ার কথাও ভাবছে।
এমনকি আফগানিস্তানে জঙ্গিদের লক্ষ্য করে হামলা চালাতে যুক্তরাষ্ট্রকে ড্রোনঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাবও আলোচনায় এসেছে। এটা একধরনের পরিহাস। যে জঙ্গিবাদ মূলত পাকিস্তানের নিজস্ব যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী নীতির ফল, এখন সেই জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন ও উন্নত অস্ত্রের সাহায্য চায়। এই চিন্তা একসময় অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু এখন আর তা অসম্ভব কিছু নয়।
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির যেন নিজেই তাঁর দেশের দোটানায় পড়া অবস্থার প্রতিচ্ছবি। তিনি নিজে একজন ধর্মভিত্তিক চিন্তাধারার মানুষ, যিনি আফগান সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তারা টিটিপিকে বেশি গুরুত্ব না দেয়, বরং পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের পুরোনো বন্ধুত্বের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু তিনি আবার একসময় এমন কথাও বলেছিলেন, পাকিস্তানের একজন মানুষের নিরাপত্তার জন্য দরকার হলে পুরো আফগানিস্তান ধ্বংস হয়ে যাক, তাতেও কিছু আসে–যায় না।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে এই উত্তেজনা শুধু সীমান্ত পার হওয়া জঙ্গি হামলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর গভীরে রয়েছে জমি নিয়ে বিরোধ আর জাতীয় পরিচয় ঘিরে সংঘাত।
আফগান তালেবান যদি টিটিপিকে সমর্থন দিয়ে চলে, আর ডুরান্ড লাইন নিয়ে বিরোধ অব্যাহত থাকে, তাহলে পাকিস্তানে এমন ভয় থেকেই যায়—আফগানিস্তান একসময় পাকিস্তানের ভূখণ্ড দাবি করে বসবে।
এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তান এখনো তালেবান নেতৃত্বাধীন কাবুল সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি; বরং তারা টিটিপির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ চাইছে। কারণ, এই গোষ্ঠী পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও সামরিক কর্তৃত্বের জন্য এক বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আফগানিস্তান-পাকিস্তান সম্পর্ক এখন দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে পুরোনো ক্ষোভ, ভুল কূটনীতি আর আদর্শগত দ্বন্দ্ব। একসময় আফগানিস্তানকে পাকিস্তান কৌশলগত সম্পদ মনে করত। এখন সেটাই হয়ে উঠেছে ভয়াবহ বোঝা।
ভারতের এখন অপেক্ষা করে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। তাদের পশ্চিম সীমান্তে এই সংঘাত কীভাবে শেষ হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
শশী থারুর ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির নির্বাচিত এমপি
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ