রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় সবার মনে দুটি প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। প্রথম প্রশ্নটি হলো, শোইগুর উত্তরসূরি হিসেবে কেন আন্দ্রেই বেলুসভকে নিয়োগ দেওয়া হলো। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক প্রধান নিকোলাই পাত্রুশেভের ভাগ্যে কী হতে চলেছে। উল্লেখ্য, নিকোলাই পাত্রুশেভকে রাশিয়ার দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি মনে করা হয়। অনেকে তাঁকে ভ্লাদিমির পুতিনের উত্তরসূরি বলেও মনে করেন।
দ্বিতীয় প্রশ্নটির সরাসরি উত্তর রয়েছে। পাত্রুশেভকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হলো। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেককভ জানিয়েছেন, পাত্রুশেভকে জাহাজনির্মাণ শিল্পের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। এ পদে থেকে পাত্রুশেভের পক্ষে খুব বেশি ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়।
শোইগুর অপসারণের বিষয়টি বরং একটু বেশি কৌশলী। এ ক্ষেত্রে পুতিন এমন একজন মিত্রকে নিষ্ক্রিয় করলেন, যিনি দিনে দিনে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছিলেন। রুশ ক্ষমতাকেন্দ্রের এই রদবদলকে প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার নিরাপত্তা কাঠামোর শীর্ষ বলয়ে দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান বলে মনে হতে পারে; যেটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়ও ছিল।
গত মাসে শোইগুর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী তাইমুর ইভানভকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এ সপ্তাহেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইউরি কুজনেটসভকে আটক করা হয়েছে।
কিন্তু রাশিয়ান রাজনৈতিক বিজ্ঞানী মিখাইল সাভা শোইগুর অপসারণ ও তাঁর স্থলে বেলুসভকে নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের বিষয়টাকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ বলে মনে করেন না। তিনি বলছেন, এই চক্রের সবাই চুরি করে। তাঁর মতে, এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় কাজ করেছে, সামরিক ব্যয়ের ওপর পুতিন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান এবং ক্ষমতার ওপর আসা যেকোনো হুমকি অপসারণ করতে চান।
বেলুসভ খুবই আস্থাভাজন। তাঁকে ‘আমলাদের মধ্যে আমলা’ এবং ‘প্রেসিডেন্ট পুতিনের আলবার্ট স্পির (হিটলারের যুদ্ধমন্ত্রী)’ বলে অভিহিত করা হয়। মনে করা হচ্ছে, বেলুসভ তাঁর নেতৃত্বে রাশিয়ার সামরিক শিল্প খাতকে সক্ষমতার দিক থেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। রাশিয়ার যুদ্ধপন্থী অনেক ব্লগার বেলুসভের এই নিয়োগকে তাই স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা মনে করছেন, সামরিক ব্যয়, কেনাকাটার ক্ষেত্রে বেলুসভ একজন সুদক্ষ ব্যবস্থাপক হতে পারবেন। কিন্তু সামরিক বাহিনীর ব্যাপারটা তিনি জেনারেলদের ওপর ছেড়ে দেবেন।
সব কটি বিষয় বিবেচনায় নিলে বলা যায়, ক্রেমলিনের ভেতরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে পুতিন ভয় পাচ্ছিলেন। যেহেতু পুতিন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তৈরি করতে চান, সে কারণে এমন কোনো ফাটল যেটা সামনে আরও বাড়তে পারে, সেটা বন্ধে আগাম পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। এই প্রেক্ষাপটে গত সপ্তাহে পুতিন তাঁর আশপাশে আর যাঁদের নতুন নিয়োগ দিয়েছেন, সেটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।
অর্থনীতিবিদেরা খুব প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে কেন্দ্রে রেখে রাশিয়া তার অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সামনে নিয়ে আসতে চায়। এর মধ্য দিয়ে পুতিন গোটা দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে চান যে পুরো রাশিয়াকে তিনি যুদ্ধযন্ত্রে পরিণত করছেন। সে কারণেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে এমন একজন দক্ষ টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী পুতিনের প্রয়োজন, যিনি সব দিক থেকেই তাঁর অনুগত।
প্রকৃতপক্ষে শোইগুর মতো বেলুসভ ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হবেন না। কিংবা ক্ষমতার বলয়ও তৈরি করবেন না। বেলুসভ তাঁর অবস্থানের জন্য পুতিনের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন। কেননা, অন্তর্মুখী স্বভাবের কারণেই কখনোই তাঁর ঘটনার পাদপ্রদীপে আসার সম্ভাবনা নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, পুতিনের বিপরীতে আরেকটি ক্ষমতার বলয় তিনি তৈরি করবেন না।
রাশিয়ার নিরাপত্তাযন্ত্রের সঙ্গে একসময়কার ঘনিষ্ঠ ও নির্বাসিত রাজনৈতিক ভাষ্যকার ভ্লাদিমির ওসেকিনের ব্যাখ্যা হচ্ছে, গত বছরের জুনের পুনরাবৃত্তি চান না পুতিন। ভাগনার গ্রুপের ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের নেতৃত্বে সে সময় বিদ্রোহ হয়েছিল।
সব কটি বিষয় বিবেচনায় নিলে বলা যায়, ক্রেমলিনের ভেতরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে পুতিন ভয় পাচ্ছিলেন। যেহেতু পুতিন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তৈরি করতে চান, সে কারণে এমন কোনো ফাটল যেটা সামনে আরও বাড়তে পারে, সেটা বন্ধে আগাম পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। এই প্রেক্ষাপটে গত সপ্তাহে পুতিন তাঁর আশপাশে আর যাঁদের নতুন নিয়োগ দিয়েছেন, সেটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।
পাত্রুশেভকে যখন ইউক্রেনীয় ড্রোনের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া রুশ জাহাজগুলো পুনর্নির্মাণের তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, ঠিক তখনই তাঁর ছেলে দিমিত্রিকে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে পদোন্নতি দিয়ে উপপ্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে। পুতিন তাঁর ঘনিষ্ঠতম মিত্র ও অর্থের মূল জোগানদার ইউরি কোভালচুকের ছেলে বরিস কোভালচুককে নিরীক্ষা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের সন্তানদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে পুতিন এই বার্তা দিতে চাইছেন যে, আরও দীর্ঘদিনের জন্য তিনি ক্ষমতায় থাকছেন। নিজের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করছেন তিনি।
রাশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মার্ক গ্যালোত্তির ব্যাখ্য হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিষদে নতুন পদে শোইগু আর তেমনটা ক্ষমতাবান থাকবেন না। নিকোলাই পাত্রুশেভকে এই পদে খুবই প্রভাবশালী হিসেবে দেখা গিয়েছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস অব রাশিয়ান ফেডারেশন বা এফএসবির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য।
সংক্ষেপে বললে, ক্ষমতার বলয়ে এই রদবদল পুতিনকে আরও অজেয় করে তুলবে। প্রকৃতপক্ষে শান্তি আসতে পারে এমন কোনো উদ্যাগে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই।
সামান্থা দ্য বেন্ডার্ন লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক চ্যাটাম হাউসের রাশিয়া ও ইউরেশিয়া কর্মসূচির সহযোগী ফেলো
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত