শিক্ষায় নতুন ওবিই পদ্ধতি চালু যে কারণে জরুরি

সামাজিক অবস্থা, অর্থনীতির প্রকৃতি, সমাজের জনসংখ্যাগত চরিত্র আর প্রযুক্তির পরিবর্তন শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে। পাঠদানপদ্ধতিকেও প্রভাবিত করে। এ যুগে বিশ্বায়ন চতুর্থ নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমাজ পরিবর্তন করে—এমন ধারণা সঠিক নয়। বরং পরিবর্তিত সমাজের চাহিদা অনুসারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ভূমিকা পরিবর্তন করেই অবদান রাখতে হবে। এটি স্বীকৃত যে প্রতিষ্ঠানগুলো সমস্যা সমাধানে সর্বোত্তম, কারণ তারা সামাজিক পরিবর্তন ও সংস্কারের দাবি পূরণ করতে পারে।

প্রথম শিল্পবিপ্লব (১৭৬৫-১৮৭০) এবং দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের (১৮৭০-১৯৬৯) সময় শিক্ষাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। আমেরিকার হোরেস মানকে ১৭৯৬ সালে স্কুলের ধারণা দেওয়ার জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয়। এ দুটি শিল্পবিপ্লবের সময়ে প্রযুক্তিগত এবং কর্মক্ষেত্রে দক্ষতাসহ অধিক শিক্ষিত কর্মী বাহিনীর চাহিদা বৃদ্ধি পায়, তাই সব স্তরের শিশুরা স্কুলে যেতে শুরু করে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি শিক্ষকেরা শিক্ষাদানে চক-বোর্ড ব্যবহার শুরু করেন। ১৯৮০ দশকের শেষের দিকে হোয়াইটবোর্ড না আসা পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে এটিই ছিল একমাত্র শিক্ষাদানের সরঞ্জাম।

আরও পড়ুন

প্রাক্‌-শিল্পবিপ্লবের যুগে শিশুদের ঐতিহ্য, রীতিনীতি, আচার ও ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষিত করা হয়। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ভাষা, গণিত ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে পড়ানো হয়। হেনরি ফিশেল—একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী—১৯ শতকের শেষের দিকে ছাত্রদের মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষার ধারণাটি দেন। চীন ছিল প্রথম দেশ, যারা প্রথম পরীক্ষাপদ্ধতি চালু করেছিল।

১৯০৫ সালে রবার্তো নেভিলিস—ভেনিসের একজন শিক্ষক—ক্লাসে পঠিত বিষয়বস্তু যেসব ছাত্র ভালোভাবে বুঝতে পারত না, তাদের জন্য অ্যাসাইনমেন্ট উদ্ভাবন করেছিলেন। ১৯০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কার্নেগি ফাউন্ডেশন প্রথম ক্রেডিট পদ্ধতিতে কোর্সের জন্য ক্রেডিটের সংজ্ঞা দেয়।

কম্পিউটারাইজেশন, ডিজিটালাইজেশন ও ওয়েবভিত্তিক আন্তসংযোগ ছিল তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের (১৯৬৯ থেকে ২০০০) ফলাফল। শিক্ষকেরা পাঠের সময় ব্ল্যাকবোর্ড ও হোয়াইটবোর্ড ব্যবহার করার পাশাপাশি ওভারহেড প্রজেক্টর এবং ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করেন। পাঠ্যক্রম প্রণীত হয় পাঠ্যপুস্তকের ওপর ভিত্তি করে।

সমাজ চেয়েছে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী আর তা তৈরি করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠদানপদ্ধতি চালু করে। যুক্তরাষ্ট্রে ড. হাওয়ার্ড ল্যাম্ব প্রস্তাবিত ফ্যাক্টরি মডেল সিস্টেমটি হেনরি ফোর্ডের গাড়ি উৎপাদন কারখানার সমাবেশ লাইন দ্বারা জনপ্রিয় করা হয়েছিল। স্কুলগুলো মূলত শিল্পবিপ্লবের সময় ভবিষ্যতের কারখানার কর্মীদের ব্যবহারভিত্তিক জ্ঞানে শিক্ষিত করার প্রয়োজনে শিক্ষার ফ্যাক্টরি মডেলটি ব্যবহার করা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে সমাজের চাহিদা পূরণে অনেক শিক্ষণ মডেল, যেমন লেকচার, কো-অপারেটিভ লার্নিং, অনুসন্ধানভিত্তিক শিক্ষা, সেমিনার ও প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা প্রবর্তিত হয়। তিনটি শিল্পবিপ্লবেই শিক্ষাব্যবস্থাকে চিহ্নিত করা হয় পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্য ছাত্রদেরকে মুখস্থনির্ভর করা এবং একমুখী প্রক্রিয়া, যেখানে শিক্ষকেরা ইনপুট হিসেবে পড়ান আর শিক্ষার্থীরা মূলত তথ্যের ভোক্তা।

আরও পড়ুন

সারা বিশ্বের মানুষ বর্তমানে ‘তথ্যযুগে’ বাস করছে, যা বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অভূতপূর্ব প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে শুরু হয়েছিল। বর্তমান ও ভবিষ্যতের কর্মজীবী মানুষদের যেসব দক্ষতা থাকা দরকার, তা হলো মৌলিক দক্ষতা (পড়া, লেখা ও গণিত), ফাউন্ডেশন দক্ষতা (কীভাবে শিখতে হয়, তা শেখা), যোগাযোগদক্ষতা (শোনা ও মৌখিক যোগাযোগ), অভিযোজনযোগ্যতা (সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ও সমস্যা সমাধান), গ্রুপ কার্যকারিতা (আন্তব্যক্তিক দক্ষতা, আলোচনা ও দলগত কাজ), প্রভাব (সাংগঠনিক কার্যকারিতা ও নেতৃত্ব), ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনা (আত্মসম্মান ও প্রেরণা/লক্ষ্য নির্ধারণ), মনোভাব (ইতিবাচক জ্ঞানীয় শৈলী) ও প্রয়োগযোগ্য দক্ষতা (পেশাগত ও পেশাদার দক্ষতা)। মনে রাখতে হবে, আগের শিল্পবিপ্লবগুলো মানুষকে প্রতিস্থাপন করেছে, কিন্তু তার চিন্তাভাবনা নয়। কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এটাও করবে। তবে আশার কথা, উল্লিখিত দক্ষতাগুলো মেশিন দ্বারা কোডিং করা যায় না। কাজেই কর্মীদের দক্ষতা সেটে পরিবর্তনের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্বিবেচনা এবং পুনর্বিন্যাস করতে হবে।

শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে শিক্ষকদের দেওয়া ইনপুটের ওপর অযথা জোর দেয়, যা হওয়া উচিত আউটকামভিত্তিক। বর্তমান প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অত্যাধুনিক শ্রেণিকক্ষ, পরীক্ষাগার, গ্রন্থাগার এবং শিক্ষকের ব্যবস্থা করে। শিক্ষক ক্লাসে একটি কোর্সের বিষয়বস্তুগুলো নিয়ে পড়ান এবং পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের মূল্যায়ন করেন। গবেষণা ফলাফল থেকে জানা যায়, এ পদ্ধতি ছাত্রদের মুখস্থনির্ভর করে এবং কর্মসংস্থানে দক্ষতা অর্জনে কার্যকর ভূমিকা রাখে না।

আউটকাম-বেজড এডুকেশন (ওবিই), একটি সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতি, যা বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় যথেষ্ট আগ্রহ সৃষ্টি করছে। এটি একটি ছাত্রকেন্দ্রিক শিক্ষণ এবং শেখার পদ্ধতি যেখানে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য এবং ফলাফল (আউটকাম) অর্জনের জন্য কোর্স ডেলিভারি এবং মূল্যায়নের পরিকল্পনা করা হয়। শিক্ষার্থীরা কখন ও কোথায় শিখবে, তার চেয়ে শিক্ষার্থীরা কী ও কেন শিখছে, তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যভাবে বলা যায়, অভীষ্ট আউটকামগুলো অর্জন এবং সেগুলো পরিমাপ করা একটি প্রোগ্রামের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন

একজন শিক্ষার্থী প্রোগ্রামে যেসব কোর্স নেয়, তার প্রতিটির জন্য কয়েকটি সুনির্দিষ্ট আউটকাম থাকে, যা তাদের অবশ্যই কোর্সের শেষে অর্জন করতে হবে, তা জ্ঞান বা দক্ষতার বিকাশ, যা-ই হোক। এখানে প্রত্যেক ছাত্রের প্রতিটি আউটকাম বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরিমাপ করা হয়। শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, একটি নির্দিষ্ট কোর্সের জন্য কী ধরনের পরিমাপযোগ্য আউটকাম থাকবে এবং তারপর তাঁরা এসব বিষয় মাথায় রেখে পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করবেন। কন্টিনিউয়াল কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট (সিকিউআই) ওবিইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাবসিস্টেম, যা নিশ্চিত করে যে শিক্ষণ, মূল্যায়ন, পাঠ্যক্রম, কোর্স আউটকাম (সিও), প্রোগ্রাম আউটকাম (পিও) ও প্রোগ্রাম এডুকেশন্যাল অবজেকটিভস (পিইও) পর্যায়ক্রমে পর্যালোচনা করা ও আপডেট করা, যাতে প্রোগ্রামটি সমাজের প্রত্যাশার সঙ্গে ভালোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ অনুসারে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের একাডেমিক সিস্টেম হিসেবে ওবিই চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত। এটির কার্যকারিতা শিক্ষকদের ওবিই সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বোঝার এবং প্রতিটি কোর্সের আউটকামগুলোকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত ও পরিমাপের ব্যবস্থা করার ওপর নির্ভর করে। এমন অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে ওবিই অসম্পূর্ণভাবে বোঝার কারণে ওবিই প্রবর্তন করা যায়নি।

  • এম এম শহিদুল হাসান ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য
    ইমেইল: [email protected]

আরও পড়ুন