গরিব শহর বলে কি বাঁশ-দড়ি-ব্লকের সড়ক বিভাজক

রংপুর সিটি করপোরেশনের ব্যস্ততম সুপার মার্কেট এলাকায় সড়কবিভাজক তৈরি করা হয়েছে বাঁশ দিয়েছবি : লেখক

কয়েক দিন আগে রংপুরের জিলা স্কুলের মোড়ের পাশে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। দেখলাম কয়েকটি ট্রলি মোটা মোটা অনেকগুলো গাছের গুঁড়ি নিয়ে চলছে। ট্রাক, ভটভটি-ট্রলি যেকোনো ধরনের পরিবহন যেকোনো সময় রংপুর সিটি করপোরেশনের ভেতর অবাধে চলাচল করে। এই দৃশ্য শহরের বিভিন্ন ব্যস্ততম এলাকায়ও চোখে পড়বে।

রংপুর সিটি করপোরেশন হওয়ার পর থেকে জনবসতি, মানুষের নিয়মিত যাওয়া-আসা কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এসব বিবেচনায় সড়ক ব্যবস্থাপনায় সিটি করপোরেশন কিংবা মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎপরতা আরও বেশি হওয়া প্রয়োজন।

অথচ শহরের ভেতর থেকে বাসস্ট্যান্ড সরানো সম্ভব হয়নি। রংপুর থেকে কুড়িগ্রাম এবং বদরগঞ্জগামী বাসগুলোর একটি স্ট্যান্ড শহরের ভেতরেই আছে। শহরের শাপলা এলাকায় পিকআপ ভ্যানের পার্কিং। স্থানটি পিকআপ ভ্যানের স্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে।

কয়েক মাস ধরে সড়কের ভেতরে কোথাও বাঁশ, ছোট ছোট পাকা ব্লক দিয়ে সড়কের বিভাজক তৈরি করা হয়েছে। একটি ব্লক থেকে আরেকটি ব্লকে বাঁশ কিংবা দড়ি দেওয়া। ব্লকগুলোয় রংপুর মেট্রোপলিটনের নাম লেখা আছে। দ্রুতগামী গাড়ি যাবে এক লেনে, অন্য লেনে রিকশা, অটো এসব। কিন্তু কে মানে এসব। দেখারও কেউ নেই। ফলে যার যেদিক দিয়ে ইচ্ছা চলছে।

আরও পড়ুন

সড়কে বাঁশ, দড়ি কিংবা ব্লকের বিভাজক এখন বিড়ম্বনামাত্র। ব্লকগুলো সব সময় এক লাইনেও থাকে না। সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেড়েছে। রংপুর বিভাগ বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব। এ বিভাগে কিংবা এই সিটি করপোরেশনে বরাদ্দ সবচেয়ে কম। সেই কারণে কি সড়ক বড় না করে এই পদ্ধতি? 

সড়কের ওপর ফুটপাতে ভাসমান দোকান। সেগুলো সড়ক থেকে তুলে দেওয়া হয়নি। সড়ক না বাড়িয়ে মাঝখানে বাঁশ কিংবা ব্লক দিয়ে যে বিভাজক তৈরি করা হয়েছে, এতে করে যানজট কমানোর বদলে বেড়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

রংপুর শহরের ভেতরের সড়কগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক সরু। শহরের অনেক সড়কই এখন প্রশস্ত করা জরুরি। অপরিকল্পিতভাবে বাড়ছে শহর। জনজীবনে এর চরম প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে কোথাও না কোথাও যানজটে পড়তে হয়। বিশেষত সিটি করপোরেশন কার্যালয় থেকে জাহাজ কোম্পানির মোড় পর্যন্ত।

রংপুর সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে সড়কের স্থান ইজারা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। জিলা স্কুলের মোড়ের বঙ্গবন্ধু চত্বর থেকে ভূমি রেজিস্ট্রি অফিস এবং কেরামতিয়া মসজিদের দিকে চলে যাওয়া সড়কের এক পাশ ইজারা দেওয়া হয়েছে। সেখানে খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে। ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে সেতুটির বেহাল। শ্যামাসুন্দরী নদীর চেয়ে ছোট সেতু। এই সেতু মেরামত করা হলে কিংবা নতুন সেতু হলে এই সড়কের ওপর চাপ অনেকটাই বেড়ে যাবে। কিন্তু সড়ক ইজারা দেওয়ায় এই সড়কের ব্যবহার জনবান্ধব হবে না।

সড়ক ইজারা দেওয়ার প্রতিবাদে স্থানীয় লোকজন জেলা প্রশাসকসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেছেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে মেয়র বলেছেন, ‘এটি যেহেতু আমাদের ব্যক্তিগত জায়গা, এটার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক আমি, এখানে কাউকে জবাবদিহি করতে আমি বাধ্য নই।’ একটি সড়ক মেয়র ইজারা দিতে পারেন কি না, সেই বিতর্কে না গিয়েও প্রশ্ন তুলতে চাই তার সড়ক ইজারা দেওয়া নগর ও নাগরিকবান্ধব হলো কি না। ওই সড়কের পাশে কয়েক দিন আগে একটি ব্যানারও চোখে পড়েছে। সড়কের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা চেয়ে স্থানীয় জনগণ সেই ব্যানার টানিয়েছিলেন।

সড়কের দুর্ঘটনা এড়াতে, যানজটহীন যোগাযোগব্যবস্থা গড়ার কোনো তাগিদ আছে বলে মনে হয় না। সিটি করপোরেশনের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ যৎসামান্য, খুবই লজ্জাকর। এ কথা সত্য। মেয়র কোথাও কোথাও জায়গা অধিগ্রহণ না করেই মানুষকে বুঝিয়ে সড়ক বৃদ্ধি করেছেন। এটি নিঃসন্দেহে অনেক বড় সক্ষমতা। 

পিটিআই (প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) থেকে যে সড়ক শহরের লালকুঠির মোড়ের দিকে চলে গেছে, সেখানে একটি সেতু আছে। এই সেতু যে স্থানে হয়েছে, সে স্থানে সড়কের প্রস্থ ২৫ ফুট। কিন্তু সেতুর প্রস্থ ১০ থেকে ১২ ফুট। শ্যামাসুন্দরীর প্রস্থের চেয়েও সেতু অনেক ছোট। ফলে শ্যামাসুন্দরীর অবস্থাও খারাপ, সড়কের অবস্থাও খারাপ।

সিটি করপোরেশনের বয়স প্রায় এক যুগ। কিন্তু এত দিনেও এই ভাঙা সেতু মেরামত হয়নি। এ রকম অসংখ্য সেতু আছে রংপুর শহরের ভেতরেই। লালকুঠিতে চার রাস্তার মোড়ে চারদিক থেকে অনেক গাড়ি চলে। এখানে ট্রাফিক লাইট দেওয়া আছে। সেই লাইট দিনরাত ২৪ ঘণ্টা কেবল জ্বলে। সেখানে কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই। সিগন্যাল লাইট জ্বালিয়ে বিদ্যুৎ অপচয় ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। সড়কের ভেতরের বিদ্যুতের খুঁটি আজও সরানো সম্ভব হয়নি। ফলে সড়ক যে অংশে কিছুটা প্রশস্ত করা হয়েছে, তা-ও বিশেষ কাজে আসছে না। ইদানীং লক্ষ করছি, কোনা কোনো সড়কের ভেতরে আরও বিদ্যুতের খুঁটি বসানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন

সড়কের দুর্ঘটনা এড়াতে, যানজটহীন যোগাযোগব্যবস্থা গড়ার কোনো তাগিদ আছে বলে মনে হয় না। সিটি করপোরেশনের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ যৎসামান্য, খুবই লজ্জাকর। এ কথা সত্য। মেয়র কোথাও কোথাও জায়গা অধিগ্রহণ না করেই মানুষকে বুঝিয়ে সড়ক বৃদ্ধি করেছেন। এটি নিঃসন্দেহে অনেক বড় সক্ষমতা। 

রংপুর শহরের যোগযোগব্যবস্থা এখনই ঠিক করতে হবে। সড়ক ঘেঁষে যত বড় বড় ভবন উঠতে থাকবে, ততই সড়ক প্রশস্তকরণ কাজ কঠিন হবে। শহরে যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং চলছে। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট স্থান গড়ে তুলতে হবে। সিটি করপোরেশনের ভেতরের সড়ক দিয়ে বিভিন্ন জেলাগামী দূরপাল্লার গাড়ি চলে। এসব বাসের জন্য বাইপাস সড়ক প্রয়োজন। 

বর্তমান মেয়র রংপুর সিটি করপোরেশনের টানা দ্বিতীয়বারের নির্বাচিত মেয়র। বলা হয়, রাজনৈতিক সক্ষমতার চেয়ে তিনি মেয়র হয়েছেন ব্যক্তিগত সম্পর্কের গুরুত্বের কারণে। স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা-বিভাগীয় প্রশাসনসহ সবার যৌথ উদ্যোগে রংপুরের যোগাযোগব্যবস্থা জনবান্ধব হোক, এটাই সবার কাম্য।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক। ই–মেইল: [email protected]