ভোটারের ‘আকাল’ এবং রাজনীতির ‘অসুস্থ’ ধারা

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপের ভোট হয়ে গেল গত বুধবার (২৯ মে)। এই ভোট নিয়ে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপেও ভোটারখরা অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যেই হামলা, সংঘর্ষ, জালভোট, ব্যালট পেপার ছিনতাইসহ নানা অনিয়মের খবর পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় অন্তত ৮৪ ব্যক্তিকে আটক ও শাস্তি দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভোটারশূন্য কেন্দ্রে গতকাল বুধবার আড্ডা দিতে দেখা যায় ভোট কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের।...’ (ফাঁকা ভোটকেন্দ্রেও ইসির অগাধ তুষ্টি, সমকাল, ৩০ মে, ২০২৪)

আরও পড়ুন

ভোটারের ‘আকাল’ বনাম নির্বাচন কমিশনের দাবি

উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট হয় ৮ মে। ওই দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পড়তে পারে। পরদিন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভোট প্রদানের হার ৩৬ দশমিক ১৮ শতাংশ।

২১ মে উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোট হয়। এদিন সিইসি বলেছিলেন, ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে থাকতে পারে। সংবাদমাধ্যমের খবরাখবর থেকে দ্বিতীয় দফায় প্রথম দফার চেয়ে কম ভোট পড়েছে—এমনটাই প্রতীয়মান হয়েছিল। এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘উপজেলা ভোটে এ পর্যন্ত সবচেয়ে কম ভোটার উপস্থিতির রেকর্ড হয়েছিল প্রথম ধাপেই। দ্বিতীয় ধাপে ভোট পড়ার হার আরও কম হতে পারে।’ (রাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরলে ভোটার খরা কেটে যাবে, সমকাল, ২২ মে, ২০২৪)

কিন্তু দ্বিতীয় ধাপের ভোটের পরদিন কমিশনের পক্ষ থেকে ৩৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ ভোট পড়ার দাবি করা হয়। (দ্য ডেইলি স্টার, ২৩ মে, ২০২৪)। প্রথম দফার চেয়ে দ্বিতীয় দফায় ভোটার উপস্থিতি বেশি ছিল—এমনটা দৃশ্যমান হয়নি। তারপরও কীভাবে ভোটের হার বেড়ে গেল?

আরও পড়ুন

তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন (২৯ মে) সিইসি ৩৫ শতাংশের কমবেশি ভোট পড়তে পারে বলে জানান। পরদিন নির্বাচন কমিশন দাবি করে, ৩৬ দশমিক ২৪ শতাংশ ভোট পড়েছে।

লক্ষণীয় হলো, দ্বিতীয় দফা ভোটের দিন (২১ মে) সিইসি বলেন, ‘তিনি ব্যক্তিগতভাবে ৩০ শতাংশ ভোটকে কখনোই খুব উৎসাহব্যঞ্জক মনে করেন না।’ (সিইসি জানালেন, ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে থাকতে পারে, প্রথম আলো, ২১ মে, ২০২৪)। পরিহাসের ব্যাপার হলো, তৃতীয় ধাপের ভোটের দিন (২৯ মে) ৩৫ শতাংশের কমবেশি ভোট পড়তে পারে—এমন কথা বলে তিনিই আবার সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। (ফাঁকা ভোটকেন্দ্রেও ইসির অগাধ তুষ্টি, সমকাল, ৩০ মে, ২০২৪)। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে ভোট নিয়ে সিইসির অবস্থানের এই পরিবর্তন কেন?  

উপজেলা নির্বাচনের প্রথম, দ্বিতীয় না তৃতীয়, কোন দফায় বেশি ভোট পড়েছে—এটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, নির্বাচন কমিশনের দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা। লক্ষণীয়, উপজেলা নির্বাচনের মতো এর আগে জাতীয় নির্বাচনেও ভোটের হার নিয়ে সন্দেহ, প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। (ভোটের হার নিয়ে সন্দেহ, প্রশ্ন, প্রথম আলো, ৯ জানুয়ারি, ২০২৪)

গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে দুটি নির্বাচন (২০১৪ ও ২০২৪) ছিল ‘একতরফা’। আরেকটি নির্বাচন (২০১৮) ছিল দারুণভাবে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’। এ রকম পটভূমিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্যে এবারের উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে। এই নির্বাচনে এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, তা আসলে জাতীয় নির্বাচনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর একরকম পুনরাবৃত্তি। ফলে নির্বাচন ও ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ, প্রশ্ন ও আশঙ্কা দিন দিন আরও বাড়ছেই।

ভোটের হার নিয়ে এসব সন্দেহ, প্রশ্ন আরও বেড়ে যায় ক্ষমতাসীন দলেরই কোনো কোনো নেতার কথায়। এ মাসেই ঠাকুরগাঁওয়ে উপজেলা নির্বাচনের এক প্রচার সভায় দেওয়া ক্ষমতাসীন দলের নেতা (কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক) কামরুল ইসলাম খোকনের বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা নেই, বিশ্বাস উঠে গেছে। সারা দিন দু-তিনটা ভোট পড়ছে। বিকেলে তা বানানো হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩ হাজার। এ কারণে ভোটের ওপর মানুষের আস্থা নেই।’ (সারা দিনে ভোট পড়ে ৩০০, বিকেলে হয়ে যায় ৩০০০: আ.লীগ নেতার মন্তব্য ভাইরাল, আজকের পত্রিকা, ১৫ মে, ২০২৪)

আরও পড়ুন

রাজনীতির ‘অসুস্থ’ ধারা

উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দফায় কম ভোট পড়া নিয়ে সিইসি বলেছিলেন, ভোটাররা ধান কাটায় ব্যস্ত থাকায় কেন্দ্রে যাননি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় তিনি আর সে রকম ‘মনগড়া’ কোনো কথা বলেননি। দ্বিতীয় ধাপের ভোটের দিন (২১ মে) তিনি বলেন, ‘দেশের রাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরলে কেন্দ্রে কম ভোটার পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’ (রাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরলে ভোটার খরা কেটে যাবে, সমকাল, ২২ মে, ২০২৪)

সিইসির বক্তব্য থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, দেশে রাজনীতির একটি ‘অসুস্থ’ ধারা চলমান রয়েছে। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি। পূর্বে উল্লিখিত আওয়ামী লীগ নেতা কামরুল ইসলাম খোকনের ভাইরাল হওয়া বক্তব্য থেকে এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি, এর জন্য আমরাই দায়ী। আমরা এমনভাবে রাজনীতি করছি যে এখানে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ থাকবে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আওয়ামী লীগ থাকবে, বিএনপিসহ সব দল থাকবে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে এ দেশে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ...খোকন বলেন, রাজনীতিবিদেরা রাজনীতিকে নষ্ট করে এটাকে ব্যবসায় পরিণত করছেন। চালাকি, ধান্দাবাজি আর চালবাজি করে আমরা ভোটটা করছি। এ কারণে মানুষের ভোটের প্রতি আস্থা নেই। ভোট দিতে মানুষ ভোটকেন্দ্রে আসতে চান না।’ (ভোট পড়ে ৩০০, বানানো হয় ৩ হাজার, বললেন আ.লীগ নেতা, কালবেলা, ১৬ মে, ২০২৪)

গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে দুটি নির্বাচন (২০১৪ ও ২০২৪) ছিল ‘একতরফা’। আরেকটি নির্বাচন (২০১৮) ছিল দারুণভাবে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’। এ রকম পটভূমিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্যে এবারের উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে। এই নির্বাচনে এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, তা আসলে জাতীয় নির্বাচনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর একরকম পুনরাবৃত্তি। ফলে নির্বাচন ও ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ, প্রশ্ন ও আশঙ্কা দিন দিন আরও বাড়ছেই।

  • মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক