নিরাপদ ঈদযাত্রার জন্য যা করতে হবে

ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে প্রতিবারই বিআরটিএ ও হাইওয়ে পুলিশ অংশীজনদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করে। এসব বৈঠকে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়, কোনোভাবেই ঈদযাত্রায় লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন চলতে দেওয়া হবে না, সিটি সার্ভিসের বাস দূরপাল্লায় চলতে দেওয়া হবে না, ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে যাত্রী বহন করতে দেওয়া হবে না, বাড়তি ভাড়া আদায় কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে, সড়ক-মহাসড়কের চাঁদাবাজি যেকোনো মূল্যে রুখে দেওয়া হবে।

বাস্তবে এসবের তেমন কিছুই ঘটে না। ঘটার কথাও নয়। কারণ, ঈদযাত্রায় মাত্র তিন-চার দিনে ঢাকা থেকে এক কোটির কাছাকাছি মানুষ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করেন। এত অল্প সময়ে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ পরিবহন করার মতো গণপরিবহন দেশে নেই। রেলসেবা তো ব্যাপকভাবে অপর্যাপ্ত। নৌপরিবহন ব্যবস্থাও সুবিধার নয়। সুতরাং সিংহভাগ মানুষ আপনজনের টানে ঝুঁকি নিয়ে সড়কপথেই যাত্রা করেন।

ঈদযাত্রা নিরাপদ করার জন্য সরকারিভাবে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, সেসব উদ্যোগ ঈদ-পূর্ব যাত্রায় যতটা সক্রিয় থাকে, ঈদ-পরবর্তী ফিরতি যাত্রায় ততটা সক্রিয় থাকে না। ফলে ঈদের ফিরতি যাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটে

সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো এই দৃশ্য শুধু নির্বিকারভাবে দেখতে থাকে। সড়কের চাঁদাবাজি, বাড়তি ভাড়া আদায় এবং অনিরাপদ যানবাহন চলাচল বন্ধে তাদের তেমন কোনো তৎপরতা দৃশ্যমান হয় না। তবে কোনো কোনো বছর আবহাওয়া ও সড়ক ভালো থাকা সাপেক্ষে পুলিশ বাহিনীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় কিছুটা যানজটমুক্তভাবে মানুষ ঈদযাত্রা করতে পারেন।

আসলে একটি সুস্থ-নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে ঈদের ১০-১৫ দিন বা এক মাস আগে বৈঠক করে কর্মপরিকল্পনা সাজালে হবে না, এ জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে তিন বছরের একটি টেকসই ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার অধীনে রেললাইন সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে রেলের সংখ্যা বাড়িয়ে সড়কপথের মানুষকে রেলমুখী করতে হবে। নৌপথ সংস্কার ও জনবান্ধব করতে হবে। সড়কে বিআরটিসির রুট বিস্তৃত করে বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সড়কের সব মেয়াদোত্তীর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বন্ধ করতে হবে।

ঈদযাত্রায় পোশাকশ্রমিকেরা যাতে পর্যায়ক্রমে ছুটি উপভোগ করতে পারেন, সে জন্য পরিকল্পনা সাজাতে হবে। পোশাকশ্রমিকদের জন্য অঞ্চলভিত্তিক যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে। এই উদ্যোগগুলো ঠিকমতো গ্রহণ করলে পরবর্তী সব ঈদযাত্রা সুস্থ, স্বাভাবিক ও নিরাপদ করা সম্ভব হবে।

মহাসড়কে দ্রুতগামী বড় যানবাহনের সঙ্গে স্বল্পগতির ছোট যানবাহন সিএনজি, অটোরিকশা, নছিমন, ভটভটি ইত্যাদির সংঘর্ষ ঘটছে অহরহ। এসব দুর্ঘটনায় অধিক প্রাণহানি ঘটছে। অনেক সময় পুরো পরিবার নিহত হচ্ছে। এ জন্য মহাসড়কে ধীরগতির ছোট যানবাহন চলাচল বন্ধ করা জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের গ্রামীণ সড়কগুলো মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এসব সড়ক যদি মহাসড়কে সংযুক্ত না হয়ে পাশ দিয়ে চলে যেত, তাহলে ছোট যানবাহনগুলোকে মহাসড়ক ব্যবহার করতে হতো না।

মূলত গ্রামীণ সড়কের ধীরগতির যানবাহনগুলো স্বল্প দূরত্বে চলাচলের সময় মহাসড়ক ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। এ ছাড়া আঞ্চলিক এবং গ্রামীণ সড়কগুলোর সঙ্গে মহাসড়কের সংযোগস্থল একেবারে সরাসরি হওয়ার কারণে ছোট যানবাহনগুলো সরাসরি মহাসড়কে উঠে পড়ছে। ফলে বড় যানবাহনগুলো হঠাৎ ব্রেক করতে না পেরে ধাক্কা বা চাপা দিচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ সড়কগুলোকে মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত না রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আর যদি সংযুক্ত করতেই হয়, তাহলে ধীরে ধীরে করতে হবে। হঠাৎ করে সরাসরি নয়।

উল্লেখ্য, যেসব মহাসড়কে ছোট ধীরগতির যানবাহন চলতে দিতেই হবে, কোনো বিকল্প সড়ক নেই, সেসব মহাসড়কে সার্ভিস রোড নির্মাণ করতে হবে। রোড ডিভাইডার না থাকলে কিছু দূর অন্তর ফিতা টাঙিয়ে সড়কে বিভাজক তৈরি করতে হবে। মোটরসাইকেলের জন্য মহাসড়কে লেন থাকতে হবে। তবে গণপরিবহন সহজ ও সাশ্রয়ী করে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করতে হবে। মোটরসাইকেল কোনোভাবেই দূরপাল্লার গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না। সব যানবাহনকে গতিসীমা মানতে বাধ্য করতে হবে। এ জন্য প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

এবার আসি চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে। সড়ক পরিবহন খাতের অস্থিরতা ও অব্যবস্থাপনার প্রধান কারণ পথে–ঘাটে রাজনৈতিক পোশাকের বেপরোয়া চাঁদাবাজি। এই অপকর্মে পুলিশের কিছু অসাধু ব্যক্তিও জড়িত থাকেন। চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। যদি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি বন্ধ করা যায়, তাহলে পুলিশের অসাধু কর্মকর্তারাও চাঁদাবাজি করতে সাহস পাবেন না।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বিশেষ করে নিয়োগ, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকার কারণে আমাদের অধিকাংশ চালক মানসিক ও শারীরিকভাবে অস্থির ও অসুস্থ থাকেন। কাজেই নিরাপদ যানবাহন চালনা নিশ্চিত করতে হলে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী চালকের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এসব উদ্যোগের পাশাপাশি গণমাধ্যমে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে আধেয় (কনটেন্ট) তৈরি করে নিরাপত্তা যে একটি সংস্কৃতি এবং এটা জীবনেরই অংশ—বিষয়টি মানুষকে বোঝাতে হবে।

ঈদযাত্রা নিরাপদ করার জন্য সরকারিভাবে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, সেসব উদ্যোগ ঈদ-পূর্ব যাত্রায় যতটা সক্রিয় থাকে, ঈদ-পরবর্তী ফিরতি যাত্রায় ততটা সক্রিয় থাকে না। ফলে ঈদের ফিরতি যাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিতের কর্মকৌশল সাজাতে হবে।

  • সাইদুর রহমান নির্বাহী পরিচালক, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন