উপজেলা পরিষদ: স্বশাসন না ইজারাদারি

উপজেলা পরিষদ নির্বাচন চলছে। উপজেলা পদ্ধতিটি চালু করেছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, আশির দশকে। আমাদের সংবিধানে স্থানীয় স্বশাসনের কথা বলা আছে। স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রায়ণের প্রাথমিক শর্তই হলো স্থানীয় সরকার। মজার ব্যাপার হলো, স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রায়ণের পদ্ধতিটি তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ে চালু হয়নি; বরং চালু হয়েছে স্বৈরাচার এরশাদের হাত ধরে। এরশাদ হয়তো চেয়েছিলেন স্থানীয় পর্যায়ে তাঁর ক্ষমতার ভিত তৈরি করতে।

গণতন্ত্রের জন্য স্থানীয় সরকার আবশ্যকীয় বিষয়। আশির দশকে যখন উপজেলা পরিষদ যাত্রা শুরু করে, তখন সেটা মোটামুটি স্বাধীন স্থানীয় সরকার ছিল। উপজেলা পরিষদের প্রধান ছিলেন চেয়ারম্যান, তাঁর নির্বাহী সচিবের দায়িত্ব পালন করতেন থানা নির্বাহী কর্মকর্তা (বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা)। এখানে আর কারও খবরদারিটা ছিল না।

উপজেলা পদ্ধতি চালুর আগে স্থানীয় পর্যায়ে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওসি এবং সার্কেল অফিসার ছাড়া তেমন কোনো কর্মকর্তা ছিলেন না। ফলে সেবা নিতে মানুষকে যেতে হতো মহকুমা বা জেলা সদরে। আমাদের শত বছরের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় উপজেলা পদ্ধতিটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। দোরগোড়ায় অনেকগুলো সরকারি কার্যালয় যাওয়ায় তৃণমূলের মানুষের পক্ষে সরকারি সেবা পাওয়ার পথ তৈরি হয়েছিল। এ জন্য ঝুঁকি নিয়ে হলেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সাধুবাদ দিতে হয়।

আরও পড়ুন

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একানব্বইয়ে একটা গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। তারা এসে উপজেলা পদ্ধতিটি বন্ধ করে দেয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তারা উপজেলা পদ্ধতিটা পুনঃপ্রবর্তন করে। এখন উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসক আছেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আছেন, উপজেলা প্রকৌশলী আছেন। উপজেলা পদ্ধতিটা ফল দিতে শুরু করলেও সরকারের মাথায় কী খেয়াল চাপল যে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে এমপিদের দায়িত্ব দেওয়া হলো। এখন আমাদের দেশে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, একেকটা সংসদীয় আসনে এমপিরা সব ব্যাপারেই খবরদারি করেন।

কোথায় রাস্তা হবে, কোথায় সেতু হবে, কোথায় স্কুল হবে, কোথায় মসজিদ হবে—এগুলো দেখার কাজ তো জাতীয় সংসদের নয়। এর জন্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগ আছে। এমপিদের কাজ হচ্ছে আইন তৈরি করা, আইনের ব্যাখ্যা দেওয়া এবং আইন ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে সংসদে বিতর্ক করা। সেই কাজ বাদ দিয়ে এমপিরা এখন একেকটা সংসদীয় এলাকার ‘প্রশাসক’ হয়ে গেছেন। একেকজন এমপি এখন একেকটা সংসদীয় আসনের ‘ইজারাদার’।

নির্বাচন বর্জন করে জনগণের কী লাভ হবে, বিএনপির কী অর্জন হবে, সেটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব মনে করেন, তাঁরাই সবকিছু জানেন, বোঝেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, সেটা অভ্রান্ত। প্রচুর জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও একটা দল যে জনগণের মন বুঝে নীতি-কৌশল ঠিক করতে পারে না, বিএনপি তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা, তাঁদের এমপিদের কর্তৃত্ব বা খবরদারির মধ্যে কাজ করতে হয়। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান যাঁরা হন, তাঁদের অনেকের মনোনয়নও ঠিক করে দেন এমপিরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমপিদের সঙ্গে যাঁদের ভালো সম্পর্ক আছে বা আত্মীয়তা আছে, প্রার্থী হিসেবে তাঁদেরই বেছে নেওয়া হয়। আমরা দেখছি, পরিবারতন্ত্রটা আমাদের রাজনীতিতে জেঁকে বসেছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনের ছড়াছড়ি।

এবারে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেটা হলো, আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করবে না। এর মানে হলো, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তারা প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এর মানে, জনপ্রিয়তা হোক, পেশিশক্তি হোক, অর্থবিত্ত হোক কিংবা যোগাযোগ হোক, তার ভিত্তিতেই একজন নির্বাচিত হবেন। অতীতেও দলীয় ভিত্তিতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হতো না। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগ সরকার আইন সংশোধন করে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করার বিধান চালু করে। এর উদ্দেশ্য হলো, কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।

আরও পড়ুন

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বিএনপি লাগাতার নির্বাচন বর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখাতে দলীয় প্রতীক তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেওয়ায় সরকারি দলের সদস্যরা মূলত পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছেন। এটা ভালো লক্ষণ হলেও আওয়ামী লীগের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তারা যদি সত্যিই আন্তরিক হতো, তাহলে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার বিধানটাই বাতিল করে দিত। অনেকে মনে করেন, বিএনপিকে ধরার জন্য সরকারি দলের এটা একটা ফাঁদ।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনও বর্জন করেছে। প্রথমে আশা দেখা গিয়েছিল যে বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আসবে। কিন্তু পরে দেখা গেল, বিএনপি বলেছে, দলের কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে। অনেককে তারা বহিষ্কারও করেছে। বিএনপির এখনকার নীতি হচ্ছে, যত দিন আওয়ামী লীগ সরকার থাকবে, তত দিন তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না।

নির্বাচন বর্জন করে জনগণের কী লাভ হবে, বিএনপির কী অর্জন হবে, সেটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব মনে করেন, তাঁরাই সবকিছু জানেন, বোঝেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, সেটা অভ্রান্ত। প্রচুর জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও একটা দল যে জনগণের মন বুঝে নীতি-কৌশল ঠিক করতে পারে না, বিএনপি তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশ উপেক্ষা করে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনেরা নির্বাচন করছেন। প্রশ্ন হলো, এই স্বজন কারা? তাঁরা সরাসরি পরিবারের সদস্য বা বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয় কিংবা চাচা-ভাতিজা বা ভাগনের মতো আত্মীয়। তাঁদের কেউ কেউ মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিলেও অনেকেই সেটা করেননি। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ কোনো রকম হার্ডলাইনেও যায়নি। এর কারণ হলো, আওয়ামী লীগ মনে করে, হার্ডলাইনে গেলে তাদের সমস্যা হবে।

প্রশ্ন হলো, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এখন কতটা অস্তিত্বশীল? উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে যা হচ্ছে, তাতে বোঝাই যায়, আওয়ামী লীগের মধ্যে শৃঙ্খলা নেই। দলের সভাপতির যে নির্দেশ, সেটাও অমান্য করে অনেকে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে দল কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কতটা দুর্বল, কতটা নাজুক, সেটা বোঝা যায়।

যাহোক, উপজেলায় এখন প্রচুর উন্নয়ন হচ্ছে। যেখানে রাস্তা দরকার, সেখানে রাস্তা হচ্ছে, যেখানে রাস্তা দরকার নেই, সেখানেও কৃষকের জমির ওপর দিয়ে রাস্তা হচ্ছে। এখন আবার খাল কাটা কর্মসূচিও নেওয়া হচ্ছে; যদিও একসময় এই খাল কাটা কর্মসূচির কারণে বিএনপিকে অহরহ দোষারোপ করত। উপজেলা পর্যায়ে অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে। সেগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা বা সেই অর্থসম্পদ কবজা করে সেটাকে ব্যক্তি, পারিবারিক বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার একটা সুযোগ হিসেবে এসেছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। বিএনপি না আসায় আওয়ামী লীগ একচ্ছত্রভাবে সেই সুযোগ নিচ্ছে।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঠিকই হচ্ছে, কিন্তু স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকার নির্বাচন আমরা দেখছি না। বলা চলে, এখানে বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে আমলাতন্ত্রের। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকারের আমলারা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশেই স্থানীয় সরকারের জন্য প্রকল্পগুলো নেন এবং বাস্তবায়ন করেন। একনেক সভায় সেগুলো পাস হয়।

আমরা স্থানীয় সরকার বলছি ঠিকই, কিন্তু উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ স্বশাসিত স্থানীয় সরকার নয়। আমরা যদি ভারত, এমনকি চীনের দৃষ্টান্ত দেখি, সেখানেও স্থানীয় পর্যায়ে সব সিদ্ধান্ত হয়। স্থানীয় সরকারই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করে। অথচ আমাদের এখানে এমপিরা স্থানীয় সরকারগুলোর মাথার ওপর ‘ইজারাদার’ হিসেবে বসে আছেন। তাঁদের স্বজন ও আত্মীয়-কুটুম উপজেলায় নির্বাচিত হচ্ছেন এবং উপজেলা পরিষদ তাঁদের পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত হচ্ছে।

● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক