বাংলাদেশের এত দুঃখ কিসে

দুঃখ একটি মানসিক অবস্থা। এর কোনো বিশেষায়িত সংজ্ঞা নেই। অনেকটাই উপলব্ধির বিষয়। তবে এখন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দুঃখের নানান সংজ্ঞা তৈরি করেছেন এবং মাত্রাগত তারতম্যের ভিত্তিতে সেগুলোকে ‘মন খারাপ’, ‘বিষণ্নতা’, ‘অবসাদ’ প্রভৃতি নামে নামকরণ করছেন। গবেষকেরা দুঃখ পরিমাপের চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জরিপকারী সংস্থা গ্যালাপ মানসিক চাপ, অবসাদ, ক্রোধ, শারীরিক ব্যথা প্রভৃতি বিষয়ে জরিপ করে বিশ্বের ১২২টি দেশের দুঃখ পরিমাপের চেষ্টা করেছে। তাদের ‘২০২২ গ্লোবাল ইমোশনস রিপোর্ট’-এ এসেছে বিশ্বের সবচেয়ে দুঃখী এবং অবসাদগ্রস্ত দেশের তালিকায় সপ্তম স্থানে বাংলাদেশ। প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ এত বিষাদময় হলো কীভাবে?

মানুষের দুঃখবোধ তৈরি হয় মূলত পরিবার, কর্মক্ষেত্র, আর্থিক সমস্যা ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা থেকে। বাংলাদেশে পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্কগুলো জটিল আকার ধারণ করেছে। একদিকে পরিবারগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে, বিষয়-সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে তিক্ততা ও দ্বন্দ্ব বাড়ছে। পারিবারিক টানাপোড়েন, কলহ, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, নির্যাতন, বিবাহবিচ্ছেদ, সামাজিক অস্থিরতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে। পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সম্পর্ক ও সম্প্রীতি ক্রমান্বয়ে দুর্বল ও  ম্লান হয়ে পড়ার বিরূপ প্রভাব গিয়ে পড়ছে নতুন প্রজন্মের ওপর। তাদের অনেকে বিপথগামী হচ্ছে। কেউ কেউ ভয়ংকর নেশায় আসক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে, স্থানীয় পর্যায়ে জাতীয় রাজনীতি প্রবেশ করায় সামাজিক বিভেদ ও হানাহানি বাড়ছে।

বাংলাদেশের মানুষের দুশ্চিন্তার একটি বড় কারণ খাদ্য। দেশের প্রায় সব খাবারেই ভেজাল, ক্ষতিকর কীটনাশক, কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে, যা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। ফলফলাদি, সবজি, মাছসহ অনেক খাদ্যসামগ্রীতে ফরমালিন মেশানো একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুরগি, গরু, মাছকে মোটাতাজাকরণ ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে, যা মানবদেহে স্থানান্তরের মাধ্যমে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। দেশে ডায়াবেটিস মহামারি আকার ধারণ করেছে। কিডনি, হৃদ্‌রোগ থেকে শুরু করে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন জন্মগত অসুখ কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এসব বিষয় পরিবার ও সমাজে হতাশা বাড়াচ্ছে।
সন্তানদের নিয়ে মা-বাবা চিন্তার অন্ত নেই। উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে যেসব চাকরিজীবী দেশে না ফিরে বিদেশে থেকে যাচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সবার দেশ নিয়ে বড় উদ্বিগ্নতার কারণ হলো দেশে সন্তানের নিরাপত্তা নেই, ভালো ভবিষ্যৎ নেই। এটা ঠিক, এ দেশে সন্তান গর্ভে আসা থেকে মা-বাবার দুশ্চিন্তা শুরু হয়। সন্তান একটু বড় হলে শুরু হয় কোচিং আর ভর্তিযুদ্ধ। স্কুল থেকে কলেজ, সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্র এটা চলতে থাকে। তারপর চাকরির বাজার। সন্তানদের বিপথে যাওয়ার শঙ্কা। কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে—এসব নিয়ে মা-বাবাকে ভীষণ দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়।

উন্নয়ন হলেও তা দিয়ে যেন আমরা বাজার থেকে দুঃখ কিনে আনছি। চারদিকে নির্মমতা আর নৈতিকতার অধঃপতন! বাক্‌স্বাধীনতা শৃঙ্খলাবদ্ধ। সামাজিক অস্থিরতা, শারীরিক অসুখ বাসা বাঁধছে ঘরে ঘরে। আয়বৈষম্য বাড়ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে—দেশ আরও দুঃখী হচ্ছে।

রোগ, শোক, অসুস্থতা, দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি—দরিদ্র মানুষের জন্য অনেক বড় মানসিক দুশ্চিন্তার উপকরণ। প্রতিদিন সড়কে রক্ত ঝরছে। পৃথিবীর আর কোনো দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় এত বেশি মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা বিরল। অসুস্থ হওয়া যেন একটি অভিশাপ। সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীদের দীর্ঘ লাইন। ভালো সেবা নেই, চিকিৎসা অপ্রতুল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। চিকিৎসার সক্ষমতার ঘাটতি।
দেশে কর্মসংস্থানের বেহাল দশা। যেখানে সাড়ে তিন লাখ চাকরিপ্রার্থী বিসিএস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হচ্ছেন, সেখানে শেষ পর্যন্ত চাকরির জন্য মনোনীত হচ্ছেন মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার। ধারণা করা হয়, দেশে প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি জনশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, যাদের একটি বড় অংশ বেকার থেকে যাচ্ছে বা পছন্দনীয় নয়, এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। চাকরিপ্রার্থী শিক্ষিত যুবসমাজের একটি বড় অংশ ভালো নেই। তাদের জীবনে নেমে এসেছে হতাশা-বিষণ্নতা। প্রতিটি চাকরি পরীক্ষার অতিরিক্ত ফি, আবার একের পর এক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস তাঁদের আরও বেশি হতাশ করে তুলছে। বেকারত্বের এই হতাশা অনেককে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। নানামুখী চাপের কারণে ইদানীং শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।

আরও পড়ুন

আর্থিক সমস্যা আরেকটি বড় মানসিক চাপ তৈরির উপকরণ হিসেবে কাজ করছে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মানুষের অর্থ উপার্জনের প্রতি মোহ ও ভোগবাদিতা—দুটিই বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নীতি–নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে মানুষ অর্থ উপার্জনের অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। সমাজে ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়ম বেড়ে যাচ্ছে। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিক থেকে ১৩তম আর দুঃখে নিচের দিক থেকে সপ্তম। যেন দুর্নীতি আর দুঃখ হাত ধরাধরি করে চলছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশ ঋণের দুষ্টচক্রের ফাঁদে পড়ে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছে। অনেকে ঋণ পরিশোধের ভয়ে রাতের আঁধারে এলাকা ছাড়ছেন। এক দিকে ঋণ পরিশোধের দুশ্চিন্তা অন্যদিকে যুক্ত হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ঊর্ধ্বগতি। যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

এসব মৌলিক বিষয় বাদেও অনেক বিষয় আছে। নদীপাড়ের মানুষের নদীভাঙনের চিন্তা। প্রতিবছর বিলীন হয়ে যাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে টিকে থাকার চাপ অনেকের জীবনে বয়ে এনেছে হতাশা ও বিষণ্নতা। বন্যায় সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। খরায় পোড়াচ্ছে। গরমে হাঁসফাঁস করছে। খাবার পানির সংকট। ঘরে খাবার নেই। লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা। ট্রেনের টিকিট নেই। কৃষকের সার নেই, সেচ পাচ্ছেন না, ফসলের ভালো দাম পাচ্ছেন না। মামলার জটে পড়ে মানুষ দিশেহারা। ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্যে দেশের ব্যাংকব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে। শেয়ারবাজার নিয়েও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বস্তি নেই।

আরও পড়ুন

মানুষের মানসিক চাপ কমানোর বা অবসাদ ঘুচানোর শক্তিশালী মাধ্যম হলো সুস্থ বিনোদন, খেলাধুলা আর অর্থনৈতিক–রাজনৈতিক স্বাধীনতা। আজ আমাদের সংস্কৃতি বিপন্নপ্রায়। যাত্রাপালা, সিনেমা, জারিগান—আজ শুধুই স্মৃতি। থিয়েটার কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে গেছে, সিনেমার দৈন্য দশা। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা বিলুপ্তপ্রায়। ক্রিকেট ছাড়া অন্য খেলাধুলার কোনো উন্নতি নেই। খেলার মাঠে স্থাপনা তৈরি হচ্ছে, নতুন প্রজন্ম ক্রীড়াবিমুখ হয়ে পড়ছে। তাদের জীবন এখন স্মার্টফোন ও গ্যাজেটনির্ভর হয়ে পড়ছে।

রাজনৈতিক বিভেদ প্রকট আকার ধারণ করছে। যে কায়দায় ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাতে মানুষ ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। গণতন্ত্র সংকুচিত হতে হতে কর্তৃত্ববাদের পথ ধরছে। মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হওয়ার উপায়গুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। মানুষের মস্তিষ্কের এ অপ্রকাশিত চাপ ধীরে ধীরে রক্তে মিশছে। রক্তের চাপ বাড়িয়ে শরীরে ব্যথাবেদনা তৈরি করছে, হৃদয়ে রোগশোক বাসা বাঁধছে। মানুষের ক্রোধ, মানসিক অস্থিরতা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন হলেও তা দিয়ে যেন আমরা বাজার থেকে দুঃখ কিনে আনছি। চারদিকে নির্মমতা আর নৈতিকতার অধঃপতন! বাক্‌স্বাধীনতা শৃঙ্খলাবদ্ধ। সামাজিক অস্থিরতা, শারীরিক অসুখ বাসা বাঁধছে ঘরে ঘরে। আয়বৈষম্য বাড়ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে—দেশ আরও দুঃখী হচ্ছে।

  • ফরিদ খান অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়