লোকেরা কেক খায় না কেন

কথিত আছে যে ফরাসি বিপ্লবের শুরুতে যখন প্যারিসের জনসাধারণ ব্যাপক দুর্ভিক্ষের সময় রুটির দাম নিয়ে বিক্ষোভ করেন, তখন রাজা চতুর্দশ লুইর রানি মারি অঁতোয়ানেত বলেছিলেন, ‘রুটি না পেলে তারা কেক খায় না কেন?’ কথাগুলো রানি সত্যিই বলেছিলেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও বাক্যাংশটি খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কারণ, সেই সময়ে রুটির দাম এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে, একজন মজুরের তার উপার্জনের বেশিরভাগ অর্থই রুটির পেছনে খরচ হয়ে যাচ্ছিল, অন্যান্য ব্যয়ের জন্য খুব কম অর্থ থাকছিল। ফলে সৃষ্টি হয় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি, এরপর বিক্ষোভ শুরু হয়, যা পরে ফরাসি বিপ্লবে রূপান্তরিত হয় এবং রাজা চতুর্দশ লুইয়ের শাসনের পতন ঘটায় এবং পরে রাজা ও রানিকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে গিয়েছিল।

মানুষ কেন কেক কিনছে না, এই প্রশ্ন করাটা ছিল উপহাস এবং এ থেকে প্রমাণ হয় যে কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবন থেকে রাজপরিবার দূরে ছিল।

বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও ক্ষতির প্রতিকারের দাবিতে কথা বলা গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। গণতন্ত্র কীভাবে কাজ করছে, তা মূল্যায়ন করার জন্য এসব প্রয়োজন। এগুলো এমন পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার তার কর্মক্ষমতা বিচার করে এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। একজন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা এবং তাঁর সহযোগীরা প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও জনগণের কাছ থেকে তাদের অভিযোগ শোনার দাবির প্রতি নিবিড় মনোযোগ দেন। কারণ, তাঁরা সত্যিকারের গণতন্ত্রে জনগণের প্রতিনিধি। তাঁরা নির্বাচিত হয়েছিলেন, কারণ, তাঁরা তৃণমূল পর্যায়ে তাঁদের ভোটারদের এবং বৃহত্তরভাবে তাঁদের জাতির সেবা করার জন্য তাঁদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার শপথ নিয়েছিলেন।

আমরা জানি, ডিম বা কাঁচা মরিচের দাম বাড়া আমাদের জনগণের জীবনে প্রাণঘাতী ঘটনা নয়। কারণ, মানুষকে এসব পণ্যের ওপর বাঁচতে হয় না। কিন্তু এগুলো এমন পণ্য, যা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন। ডিম ও কাঁচা মরিচ চাল বা রান্নার তেলের মতো অপরিহার্য নাও হতে পারে (যার দামও কিছুটা লাফিয়ে উঠেছে), তবে এগুলো সাধারণত বাংলাদেশের অন্যান্য পণ্যের মতো আমদানি করা হয় না।

মানুষ যখন মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভুগছে এবং নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না, তখন তারা সরকারকে হয়রানি করার জন্য আওয়াজ তুলছে না। তারা তাদের নেতাদের নিয়ে ঠাট্টাও করছে না। তারা কথা বলে এবং প্রতিবাদ করে, যাতে সরকার এবং নেতারা তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য পদক্ষেপ নেন। তারা হতাশায় রয়েছে, কারণ, তারা তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশা নিরসনের কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে না। তারা একটি আসন্ন সংকট দেখতে পাচ্ছে।

মূল্যবৃদ্ধি বা অন্যান্য গুরুতর অন্যায় যখন ঘটে, তখন মানুষ যেমন তাদের আওয়াজ উত্থাপন করে এবং প্রতিবাদ করে, তেমনি তারা আশা করে যে তাদের নেতা সমান গুরুত্বসহকারে প্রতিক্রিয়া জানাবেন, তুচ্ছ মন্তব্য করে নয়, যা তাদের দুর্ভোগের প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা প্রকাশ করতে পারে। কখনো কখনো একজন নেতা ভুল করে ভাবতে পারেন যে লোকেরা যেসব অভিযোগ উত্থাপন করে, তা তুচ্ছ, যা গুরুতর নীতিগত প্রতিক্রিয়ার যোগ্য নয়। কিন্তু একজন নেতার কাছে কোনো অভিযোগই তুচ্ছ প্রতিক্রিয়া দাবি করার মতো তুচ্ছ হতে পারে না।

ভারতে পেঁয়াজ, টমেটো ও চালের মতো কিছু সাধারণ কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে মোদি সরকার কিছু ধরনের চাল, পেঁয়াজ ও টমেটো রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এটি একটি নীতিগত প্রতিক্রিয়া ছিল, কারণ, এই দাম বাড়া আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের জন্য মোদি এবং তাঁর দলের জন্য হুমকি ছিল। মোদি দাম বাড়ার বিষয়টিকে তুচ্ছ করে তোলেননি, যেমন মানুষকে পেঁয়াজ কম খেতে বা সালাদে টমেটো না খেতে বলা। তিনি এই মূল্যবৃদ্ধিকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন।

আমরা জানি, ডিম বা কাঁচা মরিচের দাম বাড়া আমাদের জনগণের জীবনে প্রাণঘাতী ঘটনা নয়। কারণ, মানুষকে এসব পণ্যের ওপর বাঁচতে হয় না। কিন্তু এগুলো এমন পণ্য, যা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন। কিন্তু ডিম সেদ্ধ করে ডিপ ফ্রিজে রেখে মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলা করতে বলা কোনো বাস্তবসম্মত ধারণা নয়। একইভাবে বাজারে না গিয়ে এই সময়ের চাহিদা মেটাতে নিজের ছাদ বাগানে বা বারান্দায় টবে মরিচ চাষ করার পরামর্শ দেওয়াও একই রকম অস্বাভাবিক ধারণা। ডিম সেদ্ধ ডিপ ফ্রিজে রাখার বিজ্ঞানে না গিয়ে সাধারণ জ্ঞান থেকেও আমরা বিবেচনা করতে পারি যে কতগুলো ডিম আসলে ফ্রিজে রাখা সম্ভব? দেশে কতজনে রেফ্রিজারেটর আছে? ছাদে বা বারান্দার টবে কত কেজি মরিচ ফলানো সম্ভব?

ডিম ও কাঁচা মরিচ চাল বা রান্নার তেলের মতো অপরিহার্য নাও হতে পারে (যার দামও কিছুটা লাফিয়ে উঠেছে), তবে এগুলো সাধারণত বাংলাদেশের অন্যান্য পণ্যের মতো আমদানি করা হয় না।

এসব পণ্যের দাম বাড়া ভবিষ্যতে অন্যান্য খাদ্যপণ্যের সম্ভাব্য বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয় এবং এই উত্থানগুলো এমন অনুপাতে বৃদ্ধি পাওয়ার আগে সমাধান করা দরকার, যা না করলে দিগন্তে প্রদর্শিত হতে পারে এমন আরও বিশাল ধরনের বিক্ষোভ, যা সরকারেরই সামলাতে হবে। মনে রাখতে হবে যে ২০১০-১১–তে মিসর, তিউনিসিয়া আর সিরিয়াতে যে গণ–আন্দোলন হয়, তা শুরু হয়েছিল খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতির কারণে। পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে গেলে দেশগুলোর কী অবস্থা হয়েছিল, ইতিহাসে আছে।

আমি আগেই বলেছি, জনগণের জন্য কোনো প্রতিবাদ বা অভিযোগ তুচ্ছ নয়। প্রতিটি অভিযোগ ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে, তার একটি লক্ষণ। তবে এটি অপরিহার্য যে এসব মূল্যবৃদ্ধি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং উৎপাদন প্রণোদনা দিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণ বা প্রয়োজনে আমদানি সহজতর করার জন্য একটি নীতিগত প্রতিক্রিয়া প্রস্তুত রাখা উচিত। মূল্যবৃদ্ধির যেকোনো প্রশ্নের উপযুক্ত উত্তর পরিমাপের সঙ্গে দেওয়া উচিত, অবজ্ঞা বা উদাসীনতা ছাড়াই, অভিযোগের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত।

  • জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সাবেক সরকারি কর্মকর্তা