শীতল যুদ্ধের ভূত এখনো ওয়াশিংটনের ঘাড়ে

ওয়াশিংটন–বেইজিং সম্পর্ক নিয়ে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস এবং ইতিহাসবিদ নিল ফার্গুসনের যৌথভাবে লেখা একটি নিবন্ধ সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা প্রকাশ করেছে। এই নিবন্ধের জন্য তাঁদের তিরস্কার প্রাপ্য বলে মনে করি।

বিংশ শতকের শীতল যুদ্ধ এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান কথিত দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধের মধ্যে কী কী পার্থক্য লক্ষ করা যাচ্ছে, সেটিই তাঁদের লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। তবে সে লেখা পড়ে মনে হচ্ছে, শীতল যুদ্ধের মানসিকতা তাঁদের এখনো তাড়া করে ফিরছে।

রাইস ও ফার্গুসন ভুলক্রমে এমন একটা ধারণা সামনে এনেছেন যে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে নিজেকে মেলে ধরে চীন কেবল একাই লাভবান হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের করপোরেট খাত শিল্পোৎপাদনের আউটসোর্সিংয়ে চীনের জনশক্তি ব্যবহার করে এবং এশিয়ায় সরবরাহ শৃঙ্খল বিস্তার করে যে বিশাল লাভ করেছে, সেটি তাঁদের লেখায় নেই। চীন থেকে পশ্চিম যে আকাশছোঁয়া আর্থিক সুবিধা নিয়েছে, তা–ও সে লেখায় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

অনেক পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী, বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদ চীনের আজকের এই সাফল্যের পেছনে পশ্চিমের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরির ভূমিকা আছে বলে দাবি করলেও রাইস ও ফার্গুসন সঠিকভাবেই স্বীকার করেছেন, চীনের সাফল্যকে কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক-সম্পত্তি চুরি হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে চীনের বিষয়ে তাঁরা এমন কিছু অভিযোগ তুলেছেন, যেগুলোকে ঠিক ন্যায্য মূল্যায়ন বলা যায় না।

রাইস ও ফার্গুসন এই বলে আহাজারি করেছেন যে ‘বছরের পর বছর ধরে চীন আমেরিকার শক্তিকে শুষে নিচ্ছে।’ তবে এর মাধ্যমে তঁারা কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা বোঝা মুশকিল। রাইস একজন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ফার্গুসন পশ্চিমা অর্থনীতির উত্থানের ইতিহাসবিষয়ক একজন শীর্ষ পর্যায়ের লেখক। সেই সুবাদে অন্য যে কারও চেয়ে তাঁদের ভালো করে জানার কথা, এক জাতির কাছ থেকে আরেক জাতির ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার কাহিনিই মানবেতিহাসের মূল উপজীব্য।

বস্তুত, এক সাম্রাজ্যের শক্তি অপর সাম্রাজ্যের কেড়ে নেওয়ার মধ্যেই ইতিহাস আবর্তিত হয়। রাইস ও ফার্গুসন কি মনে করেন বৈশ্বিক নেতৃত্ব চিরকালই আমেরিকার হাতে থাকবে? তাঁরা কি মনে করেন আর কোনো শক্তিরই ভালো কিছু করার ক্ষমতা নেই?

আরও পড়ুন

অনেকে হয়তো এই যুক্তি দেবেন, চীন খেলার নিয়মকানুন না মেনেই আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। কিন্তু প্রসঙ্গটি তর্কসাপেক্ষ। কারণ, এই প্রশ্ন উঠবেই যে এই কথিত আইন বা কানুন কে বানিয়েছে এবং সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সেগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। রাইস ও ফার্গুসন কি আমাদের এ কথা বিশ্বাস করাতে চান যে গত কয়েক দশকে পশ্চিমা পুঁজিবাদ খুব নিয়মকানুন মেনে বৈশ্বিক ব্যবস্থায় তার উত্থান ঘটিয়েছে?

এই দুই লেখক ভুলভাবে এই ধারণা দিতে চেয়েছেন যে ২০১৩ সালে সি চিন পিং চীনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে আমেরিকার সঙ্গে চীনের মূল সমস্যার শুরু হয়েছে। তাঁরা সি চিন পিংয়ের প্রধান দুটি ‘পাপ’ উল্লেখ করেছেন। একটি হলো ‘সীমান্ত প্রযুক্তিতে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাওয়া’ এবং আরেকটি হলো, ‘তাইওয়ান প্রণালিকে চীনা জাতীয় জলসীমার ভূখণ্ড’ দাবি করা। অথচ এর একটিও মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মৌলিক হুমকির প্রতিনিধিত্ব করে না।

দুই লেখকের নিবন্ধের গোপন বার্তাটি হলো, কোনো দেশের, বিশেষ করে কমিউনিস্ট চীনের আমেরিকান প্রযুক্তির শিখরকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখানো ঠিক নয়। কিন্তু তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, চীন ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নেতৃস্থানীয় কিছু প্রযুক্তিতে (ফাইভ–জি থেকে ইন্টারনেট অব থিংস পর্যন্ত) ছাড়িয়ে গেছে। সেমিকন্ডাক্টরের বিষয়ে দুই দেশের ব্যবধান সংকুচিত হয়ে আসছে।

আরও পড়ুন

আমেরিকার জন্য সর্বশেষ বড় ধাক্কা হলো, মোবাইল প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ের একটি ঘোষণা। হুয়াওয়ে ঘোষণা করেছে, ১৭ ন্যানোমিটারের প্রসেসর দিয়ে তারা মেট ৬০ প্রো স্মার্টফোন বানাবে। চীনা প্রযুক্তির এই প্রকল্পে আমেরিকান একটি উপাদানও ব্যবহৃত হবে না।

বলা বাহুল্য, চীনের এই কোম্পানি চার বছরের বেশি সময় ধরে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা ও ভয়ভীতির শিকার হয়ে আসছে। এত কিছুর পরও হুয়াওয়ে যদি আইফোন ১৪ এবং সম্প্রতি বাজারে আসা আইফোন ১৫–কে টক্কর দিতে সক্ষম একটি মোবাইল ফোন বাজারে ছাড়ার সক্ষমতা দেখাতে পারে, তাহলে হয়তো চীনের সরকার সে দেশের সমগ্র প্রযুক্তি খাতকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অধীনে দেখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।

চীনের দ্বিতীয় বড় অপরাধ তাইওয়ানকে ঘিরে। চীন এটিকে তার জলসীমার আওতাধীন দাবি করে আসছে। কোনো সন্দেহ নেই, এটি আন্তর্জাতিক জলসীমা এবং তাইওয়ানের ওপর চীন সার্বভৌমত্ব দাবি করলে তা আন্তর্জাতিক জলসীমার প্রশস্ততাকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু এই দাবি সি চিন পিং তোলেননি। কয়েক দশক ধরে চীন এই দাবি তুলে যাচ্ছে।

চীনের বিরুদ্ধে রাইস ও ফার্গুসনের আরও হাস্যকর অভিযোগ হলো, চীন যুক্তরাষ্ট্রের ‘অংশীদার দেশগুলোতে টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো গড়ছে, সাগরের নিচ দিয়ে সাবমেরিন কেব্‌ল টানছে, বন্দরে প্রবেশাধিকার নিচ্ছে এবং সামরিক ঘাঁটির মতো নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।’

প্রশ্ন হলো, সাম্প্রতিক দশকে যুক্তরাষ্ট্র কি এর চেয়ে আলাদা কিছু করেছে?

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত

● মার্কো কার্নেলোস একজন সাবেক ইতালীয় কূটনীতিক, যিনি সোমালিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং জাতিসংঘে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন