বেঁচে আছি এটাই তো আশ্চর্য!

মৃত্যু, হাসপাতাল, অক্সিজেন, বিধিনিষেধ, কোয়ারেন্টিন, জীবিকার হাহাকার—আরও কত কী শঙ্কা-হ্যাশেল চারদিকে।
ফাইল ছবি

বাঁ পাশে বসা যাত্রীর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে কথা বলে চলেছেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক। মাথায় টুপি, পরনে পাঞ্জাবি, বয়স ৪০-এর কোঠায়, শ্মশ্রুমণ্ডিত চেহারায় পরিপক্বতা (ম্যাচিউরিটি) দৃশ্যমান। পেছনের আসনে বসে থেকে হঠাৎ সংবিৎ ফিরে এল তাঁর এক কথায়। তখন বিদেশ ছাপিয়ে দেশেও করোনার খড়্গ। মৃত্যু, হাসপাতাল, অক্সিজেন, বিধিনিষেধ, কোয়ারেন্টিন, জীবিকার হাহাকার—আরও কত কী শঙ্কা-হ্যাশেল চারদিকে।

নাম না-জানা সেই চালক বলেছিলেন, ‘মরে যাওয়া স্বাভাবিক। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, বেঁচে আছি এটাই আশ্চর্য!’ তাঁর কথার রেশ এখনো মস্তিষ্কে কাটছে। ভাবনার গভীরতায় নিত্যনতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। তাঁর কথার যে ভার, তা বিপরীত যুক্তিকে নুইয়ে দিচ্ছে। ঘটনাটি ২০২০ অথবা ২০২১ সালের কোনো এক ঈদের পর ভোলার লালমোহন থেকে বোরহানউদ্দিন উপজেলায় যাওয়ার পথে।

২.

প্রিয় কেউ গত হলে ফেসবুকে লিখে থাকি—ওহ না, এটা হতে পারে না, এটা মেনে নেওয়া যায় না, এটা অবিশ্বাস্য ইত্যাদি। আসলে, এটাই হতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। বরং আমরা যাঁরা এখনো বেঁচে আছি, সেটাই আশ্চর্য। আর সেটা যদি হয় রাজধানী ঢাকা বা এমন কোনো এলাকা, তাহলে সে আশ্চর্য তো বহুগুণ!

মাথার ওপর যে বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে, কখনো দিন শেষে শুনি, তা পড়ে কেউ একজন এই গ্রহ ত্যাগ করেছেন। যে বাহনে চেপে কাজে যাই, তা চিড়েচ্যাপটা হয়ে গত হয়েছেন কতজন। ভবনে উঠতে যে লিফট দেখি, তা ছিঁড়ে মুহূর্তে নেই আদমসন্তান। দেশলাই ধরাতেই শেষ পুরো পরিবার। ঠান্ডা বাতাস দেওয়ার পরিবর্তে অগ্নিমূর্তি রূপে নিজেকে জানান দেয় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। দুই পক্ষের গোলাগুলি, ঠেলাঠেলি, মধ্যখানে পড়ে ঝরে যায় কোনো মায়ের সন্তান, যে মৃত্যুর এক মুহূর্ত আগেও জানত না, কী ঘটেছে সেখানে।

বাজার থেকে আনা খাবার খেয়ে মারা যাচ্ছি। ঘুরতে গিয়ে মারা যাচ্ছি। ঘুমাতে গিয়ে মারা যাচ্ছি। মুঠোফোন টিপতে গিয়ে মারা যাচ্ছি। হাসতে হাসতে খিল ধরে মারা যাচ্ছি। আসলে আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এক-একটি মৃত্যুর ফাঁদ। এত ফাঁদ টপকিয়ে এখনো যাঁরা বেঁচে আছি, তা কি আশ্চর্য ছাড়া আর কিছু?

নাসিরুদ্দিনের গল্পের মাছগুলো গাছে উঠতে পারবে কি পারবে না, তা আমাদের জানা নেই। তবে আমরা যে মৃত্যুপুরীতে বসবাস করছি, তা থেকে বাঁচতে মনে হয় না কোনো জায়গা খুঁজে পাব। সবাইকে ঈদ মোবারক! আসুন, অন্যকে বাঁচতে সাহায্য করি। দেখবেন, নিজেও বেঁচে আছি ঠায়, সৃষ্টির নিয়ম মেনে আনন্দে হবে বিদায়।

৩.

তাহলে আমরা কি নন্দলাল হয়ে ঘরে বসে থাকব? নাকি বেখেয়ালি জীবনে চলে যাব? দুটির উত্তরই, না। কারণ, দুটি পথই সামগ্রিক প্রাণ-প্রকৃতি ও ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ববিরোধী। তাই প্রয়োজন প্রাণ থাকা পর্যন্ত জীবন চালিয়ে যাওয়া। প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাওয়ার পথে চেষ্টা চালানো। তবে অবশ্য সাবধানে। যে জীবনে থাকবে না কারও প্রতি জুলুম। যে জীবনে থাকবে সবাইকে নিয়ে সমানভাবে চলার চিন্তা। একা চলতে চাইলে হোঁচট খাওয়ার গতি বেশি। শুধু নিজের ইমারত শক্ত-পোক্ত করলে হবে না। কারণ, অন্যদেরও ইমারত শক্ত-পোক্ত না হলে ব্যক্তির কদম ফেলার জো নেই।

ধরুন, আপনি খুব ভালো মোটরসাইকেল চালাতে পারেন, কিন্তু তাতে কি নিরাপদ? উত্তর, না। কারণ, আপনার নিরাপত্তার জন্য প্রতিযোগী অন্যান্য বাহনের চালকদেরও হতে হবে পেশাদারি, সড়ক হতে হবে ত্রুটিমুক্ত। না হলে হয়তো কোনো পাগলা চালক গাড়ি নিয়ে সোজা আপনার ওপর ওঠে যেতে পারেন। আবার পড়ে যেতে পারেন চোরা গর্তে। নিজের ঘরটি প্রযুক্তি ও প্রকৌশলের আধুনিক সংস্করণে গড়ে তুলেও চিন্তামুক্ত থাকার জো নেই, যদি বাজারের ঘরগুলো হয় ভঙ্গুর।

ব্যক্তি কখনোই শুধু একার উপরে নির্ভরশীল নয়। ফলে ভালো থাকাটা শুধু কারও একার ওপর নির্ভর করে না।

৪.

নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গল্প। একদল তথাকথিত বুদ্ধিমান লোক খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার বিষয়: নদীতে আগুন লাগলে নদীর মাছগুলো প্রাণ বাঁচানোর জন্য কোথায় যাবে? তারা পাঁচ দিন পাঁচ রাত ধরে এ নিয়ে তর্ক করলেন। অবশেষে তারা তাদের মধ্যকার সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে পাঠালেন মোল্লা নাসিরুদ্দিনের কাছে, তার মত শুনতে।

প্রশ্নটি শুনে নাসিরুদ্দিন বললেন, ‘বন্ধু, এই সামান্য প্রশ্ন নিয়ে তোমরা কেন মাথা ঘামাচ্ছ? নদীতে সত্যিই যদি আগুন লেগে যায়, তাহলে মাছগুলো গাছে গিয়ে উঠবে!’
নাসিরুদ্দিনের গল্পের মাছগুলো গাছে উঠতে পারবে কি পারবে না, তা আমাদের জানা নেই। তবে আমরা যে মৃত্যুপুরীতে বসবাস করছি, তা থেকে বাঁচতে মনে হয় না কোনো জায়গা খুঁজে পাব। সবাইকে ঈদ মোবারক! আসুন, অন্যকে বাঁচতে সাহায্য করি। দেখবেন, নিজেও বেঁচে আছি ঠায়, সৃষ্টির নিয়ম মেনে আনন্দে হবে বিদায়।

মো. ছানাউল্লাহ প্রথম আলোর সহসম্পাদক