বরেন্দ্রে বৃষ্টিহীনতা, ব্যাঙের বিয়ে ও আবাদের মৌসুম

আশানুরূপ বৃষ্টি হচ্ছে না। তাই ধানের খেত ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
ফাইল ছবি

বিরান প্রান্তর। ফসলশূন্য। যত দূর চোখ যায়, তত দূর। মাকে নিয়ে ট্রেনে বসে রাজশাহী থেকে দিনাজপুরে যাচ্ছিলাম। নওগাঁর কাছাকাছি যেতেই জমির দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হচ্ছিল। ভরা আমনের সময় কিন্তু অনেক জমি রোপনহীন অবস্থায় পড়ে আছে। বর্ষাকালে বৃষ্টি নেই। যে বৃষ্টি হয়, তাতে জমির ধুলাও যেন ভিজছে না। আগের দিনে বর্ষাকালে খাল-বিলে যে থইথই পানি দেখা যেত, সেই দেখা দুর্লভ হয়ে উঠেছে দিনে দিনে।

এখন আবাদের মৌসুম। জমি কাঠ হয়ে আছে। পাট জাগ দেওয়ার পানি নেই।

গত বছরও ছিল তাপদাহের একই অবস্থা। সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছিল যুক্তরাজ্য। নজিরবিহীন দাবানলে পুড়েছে পশু-পাখি। রেড অ্যালার্ট জারি হয়েছে। তাপদাহে জলাজঙ্গল, গাছ, বাঘ পুড়ে যাচ্ছিল। নগর, ফুটপাতে পা ফেললেই ফোসকা পড়ে যাচ্ছিল। বড় কথা, সেখানে গরমে শত শত মানুষ মরে যাচ্ছিল।

আমাদের দেশ নদীমাতৃক। আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। এককালে বিদেশি পরিব্রাজকেরা বলতেন, বঙ্গদেশ আর্দ্রতা ও ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন একটি বদ্বীপ। প্রচুর গাছপালা, পানি, নদী, বালু, মাটি সব মিলেমিশে একাকার। জল–জঙ্গল ছিল ফলমূল ও প্রাণিজ সম্পদে ভরপুর।

অথচ ইউরোপের মতো গত বছর এখানেও তাপদাহের একই অবস্থা ছিল। বরেন্দ্রে ও উত্তরে অপদেবতার পাঠানো ধরনের গরম আবহাওয়া বয়ে যাচ্ছিল। পাট পুড়ে গেছে। ধানখেত পুড়ে গেছে। গাছের পাতা পুড়ে যাচ্ছিল। ফুল, ফল, পেয়ারা, সফেদা, বানর, খরগোশ সব পুড়ে যাচ্ছিল। তাপদাহে বানররা কীভাবে জলে বারবার গোসল করছিল, সেসব খবর পত্রিকায় দেখা যাচ্ছিল।

ফলে বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার লৌকিক সংস্কারও এখানে সংবাদমাধ্যমের খবর হয়ে ওঠে।

এ বছরও বৃষ্টির জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে সবাই। ক্যালেন্ডারে এখন বর্ষাকাল। কিন্তু বরেন্দ্রে বর্ষার দেখা নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্ষার রূপ পাল্টে যাচ্ছে। কোনো কোনো অঞ্চলে বর্ষার চিরচেনা রূপের দেখা নেই। বৃষ্টি নেই। ফলে শুকিয়ে মাঠ কাঠ। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। যদিও এর মধ্যে আছে মানবসৃষ্ট কারণ, বিশেষ করে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবও অনেকটা দায়ী। তবে অনাবৃষ্টির দরুন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া সুপেয় পানির অভাবে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাচ্ছে।

সম্প্রতি ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪০ ভাগ এলাকা ‘পানি সংকটাপন্ন’: গবেষণা’ এই শিরোনামে দ্য ডেইলি স্টার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে, কয়েক দশক ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪০ শতাংশেরও বেশি ইউনিয়নে পানিশূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফলে এসব এলাকায় খাবার ও সেচের পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে।

ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং পানিসংকটাপন্ন অঞ্চলগুলোর পরিধি প্রসারিত হচ্ছে।

রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলাজুড়ে ‘উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতির হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং' শীর্ষক গবেষণাটি ২০১৮ সালে শুরু হয় এবং জুন মাসে ওয়ারপো কর্তৃক অনুমোদিত হয়।

স্থানীয় সরকার ও সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের (এসডিসি) যৌথ অর্থায়নে এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।

গবেষণায় অঞ্চলের মোট ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, অর্থাৎ কমপক্ষে ৮৭টি ইউনিয়নকে ‘অতি উচ্চ’ ও ‘উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এই জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য, গবেষণাটিতে পানি সংকটাপন্ন এলাকাগুলোয় সংকটের তীব্রতা অনুযায়ী বিকল্প হিসেবে ভূপৃষ্ঠের পানির উৎস ব্যবহার এবং ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠের পানির সম্মিলিত ব্যবহারকে উৎসাহিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি আবহাওয়াবিদ ড. আবদুল মান্নান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, এমনিতে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমাদের দেশের পশ্চিমাঞ্চল সাধারণভাবে তাপপ্রবাহপ্রবণ এলাকা। এর সঙ্গে বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থার কারণে আরও কিছু এলাকা তাপপ্রবাহের আওতায় পড়েছে। আগে রংপুর অঞ্চলে তাপপ্রবাহের দাপট থাকত বেশি। এখন সেখানে ধীরে ধীরে কমে আসছে। এ বছরও রংপুরে তাপমাত্রা ততটা চড়েনি। অথচ রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগ তাপপ্রবাহের আওতায় আসছে এখন।

আরও পড়ুন

নিউম্যারিক্যাল ওয়েদার প্রেডিকশন মডেলিং ও মেটিরিওলজি গবেষক ড. মোহন কুমার দাশ মনে করেন, বন্যার মতোই তাপপ্রবাহ ধীরে ধীরে দুশ্চিন্তার বড় কারণ হয়ে উঠছে বাংলাদেশের জন্য।

দিনে দিনে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের গড় বৃষ্টিপাত ছিল ২ হাজার ৩০০ মিলিমিটার, বরেন্দ্র এলাকায় গড় বৃষ্টিপাত হয়েছিল ১ হাজার ১৫০ মিলিমিটার। এ রকম স্বল্প বৃষ্টিপাত দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গিয়ে খরায় আক্রান্ত হবে বিপুলসংখ্যক মানুষ। এর মধ্যে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের লোকই বেশি।

বিভিন্ন স্থানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পেয়ে দেখা দিচ্ছে স্থায়ী মরুকরণ। ফসলের আবাদ কমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তায় বড় প্রভাব ফেলতে পারে। সেই সঙ্গে নতুন ধরনের রোগবালাই দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকাসহ দেশের মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান এখন তাপপ্রবাহের আওতায় রয়েছে। মানুষ, কৃষি ও প্রাণিকুল সবচেয়ে বেশি ভুগছে। তাপপ্রবাহের জন্য সতর্ক করার পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, বৃক্ষরোপণ বাড়ানো ও ছায়াশীতল বিশ্রামের ব্যবস্থাসহ কিছু উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

২ আগস্ট যখন এই লেখা লিখছি, তখন কিছুটা ভারী বৃষ্টির দেখা মিলেছে। আকাশ ঘন মেঘে ভারী হয়ে আছে। কৃষকের নাভি ও নিশ্বাসের দিকে কান পাতলেই বোঝা যায়, বৃষ্টির জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন তাঁরা। আবাদের মৌসুমে জমি কাঠ হয়ে আছে। এখন এই যে বৃষ্টি হচ্ছে, নিশ্চয়ই জমি ভালো পানি পাবে।

অনেক দিন পর যখন বৃষ্টি নামে, তখন মেঘের ভারের সঙ্গে কৃষকের মনের ভারও কিছুটা কমে। ধুলাবালু কমে। পাতাগুলো উজ্জ্বল দেখায়। নতুন সম্ভাবনা আশা জাগায়।

  • নুসরাত নুসিন কবি ও সাংবাদিক