ডাকসু ও জাকসু: জাতীয় নির্বাচনে কী করবে এনসিপি

ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের অভাবনীয় সাফল্য আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে নতুন ভাবনা যুক্ত করেছেছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদ (ডাকসু ও জাকসু) নির্বাচনে ছাত্রশিবির জোটের বড় বিজয় ও ছাত্রদলের পরাজয় নিয়ে সমাজের নানা পরিসরে ব্যাপক আলোচনা চলছে।

তবে জুলাই আন্দোলনের প্রথম সারির নেতাদের নিয়ে গঠিত গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ভরাডুবির কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপির) ভবিষ্যৎ ও রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে।

যদিও ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল ভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক গুণনীয়কের ওপর নির্ভর করে। কেননা জাতীয় নির্বাচনে দেশজুড়ে নানা ধর্মের, মতের, বয়সের ও আর্থসামাজিক অবস্থানের ব্যক্তি ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করেন। তবু এই ‘মিনি নির্বাচন’গুলোয় আশানুরূপ ফল না করা রাজনৈতিক দলগুলো যদি আত্মসমালোচনা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে, জাতীয় নির্বাচনে তা কিছুটা হলেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয়।

আরও পড়ুন

ডাকসু নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ-সমর্থিত প্যানেল বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসংসদের প্রার্থীরা ২৮টি পদের ১টিতেও জিততে পারেননি। নির্বাচনে এই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ৯ দফা দাবি ঘোষণা করে আলোচনায় আসা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আবদুল কাদের। আর জিএস প্রার্থী ছিলেন সম্মুখসারির আরেক সাবেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। ভিপি পদে মাত্র ১ হাজার ১০৩ ভোট পেয়েছেন কাদের আর জিএস পদে বাকের পেয়েছেন ২ হাজার ১৩১ ভোট। ভোটের হিসাবে দুজনই হয়েছেন পঞ্চম।

আর চারটি সম্পাদকীয় পদে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থীরা দ্বিতীয় হয়েছেন, তবে অন্যগুলোয় তাঁরা উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাও তৈরি করতে পারেননি। যদিও এই পরাজয়ের পেছনে দলের নেতাদের অনেকেই প্যানেল নিয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতাদের মধ্যে বিভাজন ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের অসমর্থনকে দায়ী করেছেন। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই জুলাই আন্দোলনের নেতাদের জনপ্রিয়তার এই পতনকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন রয়েছে।

সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়নের অধ্যাপক অশোক সোয়েইন গত মার্চ মাসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেন, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের পর গণবিক্ষোভের যে ‘মোমেন্টাম’ তৈরি হয়েছিল, এনসিপি নতুন দল গঠনের মাধ্যমে তার সদ্ব্যবহার করে।

তবে এর দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়েছে। কেননা, ভারতের রাজনীতিতে জনতা পার্টি (১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বিরোধীদের নিয়ে গড়ে ওঠা কোয়ালিশন) বা অসম গণপরিষদের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি মনে করেন, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া দলগুলো প্রায়ই তাদের প্রাথমিক সাফল্য ধরে রাখতে এবং পরবর্তী সময়ে অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়।

এর কারণ হিসেবে অধ্যাপক সোয়েইন যে তিনটি বিষয় উল্লেখ করেন, সেগুলো হলো একটি শক্তিশালী আদর্শের অভাব, নিবেদিতপ্রাণ তৃণমূল সমর্থকদের অনুপস্থিতি এবং তাৎক্ষণিক সংকট কেটে যাওয়ার পরে একইভাবে জনসাধারণের উৎসাহ ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ।

নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপির এখনো বিকাশের কিছু সুযোগ রয়েছে। গত ১৬ বছরে মোট প্রায় ৪ কোটি নতুন ভোটার হয়েছে। তাঁদের অনেকেই প্রচলিত বংশগত রাজনীতির শক্তিশালী প্রভাবের বাইরে গিয়ে বিকল্প খুঁজছেন।

খেয়াল করে দেখবেন, নবগঠিত দল এনসিপির ক্ষেত্রে এ তিন কারণই বিদ্যমান। কোনো রাজনৈতিক দলের এমন একটি শক্তিশালী ও সুস্পষ্ট আদর্শের প্রয়োজন, যা সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের সঙ্গে অনুরণিত হয়। দল গঠনের প্রথম থেকেই নেতারা নিজেদের ‘বাংলাদেশপন্থী’ ও ‘মধ্যপন্থী’ বলে দাবি করলেও তাঁদের আদর্শ বিষয়ে সাধারণ জনমনের অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি দলটি একেবারেই পরিষ্কার করতে পারেনি।

এ ছাড়া এখন পর্যন্ত এনসিপিকে মূলত পতিত সরকারের বিরোধিতাকারী দল হিসেবেই দেখা যাচ্ছে, যেখানে তাদের প্রধান বক্তব্য শেখ হাসিনা সরকারের বিচার চাওয়া, মুজিববাদকে উৎপাটন করা, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি। নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার পরিবর্তে শুধু আওয়ামীবিরোধী অবস্থান নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি জনসমর্থন ধরে রাখা সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে সদ্য প্রয়াত লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমর প্রথম আলোকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা বলছে, তারা বামপন্থী নয়, তারা দক্ষিণপন্থীও নয়, তারা মধ্যপন্থী। সত্যিকার অর্থে মধ্যপন্থী বলতে দুনিয়ায় তো কিছু নেই। তাদের তো বলতে হবে তারা কী, তারা কিসের দল করছে। সেটা কিন্তু দেখা যাচ্ছে না..., তাদের এখন পর্যন্ত দেশের কৃষক, শ্রমিকের পক্ষে কোনো কথা বলতেও শুনিনি’ (২২ এপ্রিল ২০২৫)। তাই স্পষ্ট নীতি ও শক্তিশালী বার্তা ছাড়া দলটির প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখা যে কঠিন হয়ে উঠতে পারে, তা সাম্প্রতিক নির্বাচনী ফলাফলই বলে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন

আরেকটি সমস্যা হলো এনসিপিতে ক্যারিশমাটিক নেতার অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান বা জেনারেল এরশাদের মতো শক্তিশালী ব্যক্তিত্বদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। অন্যদিকে এনসিপি যৌথ নেতৃত্বের যে মডেল বেছে নিয়েছে, সেটি দীর্ঘ মেয়াদে জন-আকাঙ্ক্ষা গড়ে তুলতে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করি।

এনসিপির জন্য আরেকটি বড় বাধা হলো তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনের অভাব। বাংলাদেশে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর বিস্তৃত শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে, যা সবচেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয়ও প্রতিষ্ঠিত। ব্যাপক এই স্থানীয় সমর্থন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সারা দেশে তাদের কয়েক দশকের অব্যাহত জনসংযোগ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে এনসিপি মূলত শহরকেন্দ্রিক দল। তৃণমূল পর্যায়ে এখন পর্যন্ত তাদের তেমন উপস্থিতি বা প্রভাব দেখা যায়নি।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিভিন্ন পেশা ও অবস্থান থেকে আসা এনসিপির নেতারা জুলাই আন্দোলনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিলেও পরবর্তী সময়ে দল গঠনের পর নানা সময়ে তাঁদের ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আকাঙ্ক্ষা দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। যেহেতু দলের কোনো প্রধান নেতৃত্ব নেই, নেতারা গণমাধ্যম ও জনসমাবেশে বিভিন্ন আদর্শপ্রসূত বক্তব্য দেন, যা জনগণকে আরও বিভ্রান্ত করেছে।

আরও পড়ুন

মূলত নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি যে সম্ভাবনা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল, তার ধারাবাহিকতা তারা ধরে রাখতে পারেনি। অধ্যাপক সোয়েইনের উল্লেখিত কারণগুলো ছাড়াও আরও দুটি কারণে এনসিপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এক. বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও সমন্বয়কদের চাঁদাবাজি ও অর্থ কেলেঙ্কারিতে সংযুক্ত থাকার অভিযোগ। দুই. নানা সময়ে অপরিশীলিত ও অপরিপক্ব বক্তব্য প্রদান। অনেকটা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই দল বিভিন্ন সময়ে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে যে সরকারি সমর্থন পেয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই নজিরবিহীন ও দৃষ্টিকটু। এই পক্ষপাতিত্ব তাদের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাকে জ্যামিতিক হারে কমিয়েছে। তা সত্ত্বেও এনসিপির বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি পোস্টে এনসিপিকে ‘পুনর্নির্ধারণ, পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধার’ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। এ ছাড়া ১৪ সেপ্টেম্বর এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের নির্বাহী কাউন্সিলের সভায় গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদকে নাম পরিবর্তনসহ কিছু সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে দলটি।

পরিশেষে বলা যায়, নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপির এখনো বিকাশের কিছু সুযোগ রয়েছে। গত ১৬ বছরে মোট প্রায় ৪ কোটি নতুন ভোটার হয়েছে। তাঁদের অনেকেই প্রচলিত বংশগত রাজনীতির শক্তিশালী প্রভাবের বাইরে গিয়ে বিকল্প খুঁজছেন।

গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সংঘটিত মব সন্ত্রাস, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও বিভিন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন, শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন বকেয়ার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো নিয়ে একনিষ্ঠ প্রতিবাদ ও কল্যাণমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করলে জনগণের কিছুটা কাছাকাছি যেতে পারবে এবং যোগ্য রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করার প্রতিযোগিতায় কিছুটা হলেও এগিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করি।

  • উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

    মতামত লেখকের নিজস্ব