‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি’—স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবিতে সোচ্চার মানুষের এই স্লোগানের ভিন্ন একটা পাঠ হাজির করেছে পশ্চিমারা। অথচ এই স্লোগানের মর্মার্থ ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনে ঔপনিবেশিক শাসন ও ইহুদিদের শ্রেষ্ঠত্বের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন হওয়া।
৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েল বারবার প্রমাণ করেছে যে ইহুদিবাদীদের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার লড়াইয়ে তাদের এখনো হাজার হাজার মানুষের লাশ দরকার। আমরা জানি, ফিলিস্তিনে ইউরোপীয় জায়নবাদীদের বসতি স্থাপনের ঘটনা ঘটে দেড় শ বছর আগে।
আর এই অঞ্চলে তাদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার বয়স ৭৫ বছর। কিন্তু এত দিনেও ফিলিস্তিনিরা আত্মসমর্পণ করেনি, বরং সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ জারি রেখেছে দখলদারির বিরুদ্ধে। ইসরায়েল ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের কাছে ফিলিস্তিনিদের এই অবস্থান ‘অপরাধ’। গণহত্যার জন্য তাদের কাছে এই ‘অপরাধ’ই যথেষ্ট।
এই বর্বর হামলাকে ন্যায্যতা দিতে জায়নবাদী নেতারা ফিলিস্তিনিদের নানা অবমাননাকর নামে ডাকে। আরব বিশ্বে ফিলিস্তিনিদের ‘অমানুষ’ প্রমাণের চেষ্টা অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। তাই এখন তারা পুরোনো জায়নবাদীদের ব্যবহৃত শব্দগুলোকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বে ফিলিস্তিনিদের এই অপমানসূচক নামকরণ ভালো বিকোয়। কারণ, ইসরায়েল যতই অন্যায় করুক না কেন, তাতে তারা বিরক্ত হয় না।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যুদ্ধকে বলেছেন, ‘অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর যুদ্ধ, পশুত্বের বিরুদ্ধে মানবিকতার যুদ্ধ।’ কিন্তু তাঁর অতীতের বৈষম্যবাদী ও প্রতারণামূলক বক্তব্যের মতোই এই বক্তব্যও অসার।
জায়নবাদী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান থিওডর হার্জল ১৮৯৬ সালে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের উপনিবেশের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই উপনিবেশ হবে এশিয়ায় এক টুকরো ইউরোপ, বর্বরদের বিপরীতে সভ্য সমাজের একটা ঘাঁটি।
ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি—এই স্লোগানের মানে হলো ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ইহুদি শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উপনিবেশ থেকে মুক্তি পাবে। জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এলাকায় আর জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ থাকবে না। ইসরায়েলের বৈষম্যবাদী প্রতিষ্ঠান আর আইনকানুনগুলো কার্যকর থাকবে না। ফিলিস্তিন একদিন স্বাধীন হবে।
জায়নিস্ট অর্গানাইজেশনের প্রধান হাইম ওয়াইজমান এসেছিলেন বেলারুশ থেকে। ১৯৩৬ সালে তিনি ফিলিস্তিনিদের ‘ধ্বংসবাদী শক্তি’, ‘মরু বাহিনী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, ইহুদি ঔপনিবেশিকেরা ছিল, ‘সভ্যতা’ ও ‘সৃষ্টি’কামী।
ওয়াইজম্যান পরে ইসরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। জায়নবাদীদের ফিলিস্তিন দখল প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘এটা মরু বাহিনীর বিরুদ্ধে সভ্য জাতির পুরোনো যুদ্ধ। আমাদের কেউ থামাতে পারবে না।’
এই গণহত্যায় উসকানি বা বৈষম্যমূলক ভাষা শুধু যে জায়নবাদীরাই ব্যবহার করেছে তা নয়, ঔপনিবেশিক শক্তি কালে কালে এ ধরনের শব্দই ব্যবহার করে এসেছে। ফরাসিরা যখন নিউ ক্যালেডোনিয়া দখল করে, তখন তারাও আদিবাসী কানাক গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল প্রায়। ১৮৭৮ সালে ফ্রান্স তাদের গণহত্যামুখী নীতির নাম দিয়েছিল, ‘বর্বরতার বিরুদ্ধে সভ্যতার লড়াই।’
১৮৮২ সালে যুক্তরাজ্য যখন মিসর দখল করে, তখনো তারা বলেছিল প্রায় একই কথা, এই যুদ্ধ বর্বরতার বিরুদ্ধে সভ্যতার যুদ্ধ। ঔপনিবেশিক ইতিহাসে এ ধরনের আরও বহু উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়।
নেতানিয়াহুর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন পোল্যান্ডের। সমকালীন ইসরায়েলি নেতাদের মধ্যে তিনিই একা নন, তাঁর সহকর্মীরাও ফিলিস্তিনিদের মানুষ মনে করে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়াভ গ্যালান্ত ফিলিস্তিনিদের ‘মানুষের চেহারাওয়ালা পশু’ বলে মন্তব্য করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরাও পোল্যান্ড থেকে আসা। একই ধরনের কথা বলেছেন ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক। তাঁর পূর্বপুরুষ লিথুয়ানিয়ার। তিনি ইসরায়েল সম্পর্কে বলেছেন, এটা হলো জঙ্গলের মধ্যে একটা ভিলার মতো।
জায়নবাদীরা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করে। কিন্তু ফিলিস্তিনকে দখল করার বেলায় তারা ধর্মীয় ভাষ্যের আশ্রয় নেয়। আদতে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক অবস্থান জায়নবাদীদের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। গাজা দখলের আগে নেতানিয়াহু সেনাবাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘মনে রাখবে, আমালেক তোমাদের কী করেছে। হোলি বাইবেলে তার উল্লেখ আছে।’
ইহুদিদের ঈশ্বর তাদের বলেন, “এখন যাও। আমালেকাইটদের ওপর আক্রমণ করো। তাদের যা আছে, সব ধূলিসাৎ করো। কাউকে ছাড়বে না, হোক সে পুরুষ, নারী, শিশু বা নবজাতক, ভেড়া, উট বা গাধা।’ সামরিক বাহিনী যখন গাজার ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা করতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই নেতানিয়াহু তাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন ‘ঈশ্বরের’ নির্দেশনা।
নেতানিয়াহু ধর্মকে টেনে এনেছেন একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে। এর মাধ্যমে উপনিবেশ স্থাপনকারী ইউরোপীয় ইহুদিদের তিনি প্রাচীন হিব্রু ভাষাভাষী আদিবাসী হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন।
জায়নবাদীদের এই কল্পকথা বাইবেলের ভাষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাইবেলে বলা আছে, ইহুদিরা ফিলিস্তিনে বসবাস করছে দুই সহস্রাব্দ আগে থেকে। তারাই এই ভূমির অধিকর্তা। কিন্তু এখন আধুনিক ইহুদিরা নতুন গল্প ফেঁদেছে। তারা বলতে চাইছে, তারাই প্রাচীন হিব্রু জনগোষ্ঠী। তাদের এই দাবির অসারতা বুঝতে এডওয়ার্ড সাঈদ কানানাইটদের মতো করে বিশ্লেষণ করতে বলেছেন। কারণ, বাইবেল বলছে, কানান রাজ্যের বাসিন্দারা হলো প্রাচীন হিব্রু সম্প্রদায়ের মানুষ, এবং তারা ফিলিস্তিনের আদিবাসী।
জায়নবাদীদের দেশ দখল এবং ফিলিস্তিনে তাদের রক্তক্ষয়ী হামলার ইতিহাসকে মাটিচাপা দিতে ইসরায়েল ও পশ্চিমা গণমাধ্যমে তাদের মিত্ররা বারবার বলেছে, হলোকস্টের পর হামাসের এই হামলাই সবচেয়ে প্রাণঘাতী ছিল। ফিলিস্তিনিদের ইহুদিবিদ্বেষী বা নাৎসি প্রমাণের এই চেষ্টা চলে আসছে ১৯২০-১৯৩০ সাল থেকে। এই ঘৃণ্য প্রচারণার উদ্দেশ্য, ফিলিস্তিনিদের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামকে ইহুদিবিদ্বেষ বলে প্রচার করা। তারা জানে, এতে করে তারা পশ্চিমাদের সহানুভূতি পেতে পারে।
৭ অক্টোবর যেসব ইসরায়েলি সেনা ও বেসামরিক মানুষ নিহত হয়, তারা ইহুদি বলে খুন হয়েছে, এমন একটা ভাষ্য প্রচার করা হচ্ছে। আদতে তারা খুন হয়েছে উপনিবেশ স্থাপনের কারণে। তারাও ঔপনিবেশিক শক্তি বলেই ফিলিস্তিনিদের খুন করছে।
কিন্তু ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলকে প্রতিরোধ করে যাবে। কারণ, তারা দখলদার, তারা ইহুদি—সে কারণে নয়। এই দখলদারেরা খ্রিষ্টান, মুসলিম বা হিন্দু হলেও ফিলিস্তিনিরা একইভাবে প্রতিহত করত। ইহুদি বলে তাদের প্রতিরোধের ধরন বদলে গেছে, এমনটা বলার কোনো সুযোগ নেই।
ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি—এই স্লোগানের মানে হলো ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ইহুদি শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উপনিবেশ থেকে মুক্তি পাবে। জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এলাকায় আর জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ থাকবে না। ইসরায়েলের বৈষম্যবাদী প্রতিষ্ঠান আর আইনকানুনগুলো কার্যকর থাকবে না। ফিলিস্তিন একদিন স্বাধীন হবে।
আর পশ্চিমা সরকার ও গণমাধ্যমগুলো যারা ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিতে একমত, তাদের আচার-আচরণে অনেকে বিস্মিত হচ্ছে। আসলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ, এরাই তো একদিন আদিবাসীদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
জোসেফ মাসাদ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও আরবের ইতিহাস বিষয়ে অধ্যাপক
মিডল ইস্ট আইয়ে প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে অনূদিত