শ্রীলঙ্কার কথা এখন হারিয়েই গেছে

একটা সহজ কাজ বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ দল বেঁধে অথবা এমনকি এককভাবেও সানন্দে এবং দায়িত্ব নিয়েও করতে পারে। ধরুন, কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হলো অনেকগুলো সড়ক-মহাসড়ক, সেতু-মহাসেতু, ছয় লেন, আট অথবা দশ লেন ইত্যাদি নির্মাণ করার; সঙ্গে আরও জুড়ে দেওয়া হলো ৩০, ৪০ অথবা ৫০ তলা কিছু ইমারতও। মোটামুটি একটা হিসাব করে এ সবকিছু নির্মাণের যৌক্তিক খরচ হবে এক লাখ কোটি টাকা। তবে আপনার জন্য বরাদ্দ দুই লাখ কোটি টাকা। নিশ্চয়ই করতে পারবেন। সানন্দেই।

এ রকম সহজ কাজের ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া যায়। লেখালেখিতে বা টেলিভিশনের টক শোতে ঘুরেফিরে কথাগুলো অনেকবারই এসেছে। আপনাকে ৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হলো। কেন্দ্র নির্মাণ শেষে আপনার সঙ্গে সরকারের চুক্তি হলো আপনি সরকারকে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করবেন।

বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের জন্য খরচাপাতিসহ কিছুটা লাভের টাকা যোগ করে সরকার আপনার কাছ থেকে নিয়মিতভাবে এ বিদ্যুৎ ক্রয় করে সেটা বাবদ অর্থ পরিশোধ করবে।

এর সঙ্গে আরেকটি কঠিন শর্ত চুক্তিতে জুড়ে দেওয়া হলো। সরকারের যদি বিদ্যুতের প্রয়োজন না হয়, তাহলে তো আপনার কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অর্থহীন। চাহিদা না থাকলে সরবরাহের প্রশ্নটা আসে না। এর সঙ্গে যে কঠিন শর্তটা জুড়ে দেওয়া হলো তা হলো আপনি বিদ্যুৎ সরবরাহ না করলেও সরকার মাসে মাসে আপনাকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সরবরাহ করবে। অর্থাৎ আপনার কোনো খরচ নেই, কিন্তু লাভের টাকাটা নিয়মিত সরকারের কাছ থেকে পাবেন। এটাকেই বলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো।

বাস্তবটা অত্যন্ত কঠিন। সরকারও সিরিয়াস। এই নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থাটা পাকাপোক্ত করতে এক যুগ আগে একটা আইনও পাস করা হয়েছিল। সরকার যেহেতু আইনানুযায়ী ব্যক্তিমালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুৎ না নিয়েও অর্থ জোগান করছে, সেহেতু জোর গলায়ই বলা যায় যে সরকার আইনের শাসনের ঝান্ডা সমুন্নত রেখেছে।

অবশ্য সরকার যদি নিজেই নিজেকে আরও খুশি করতে চায়, আনন্দে আত্মহারা হতে চায়, তবে সরকার নিজেই জনমত জরিপের ব্যবস্থা করতে পারে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে লাখ লাখ ইভিএম তো কেনা হচ্ছে। সরকারের এই জরিপ ইভিএম মেশিন দিয়ে করলে তো সোনায় সোহাগা। লাখ লাখ লোকের ইভিএম জরিপে সঠিক, নির্ভেজাল এবং খাঁটি উত্তরে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও সরকারের নিখাদ উন্নয়নে ও সাফল্যে উদ্বেলিত হতাম। পত্রিকাগুলো তো আর জরিপ বোধ হয় করবে না, তাই সরকারই করুক, ইভিএম দিয়ে।

দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা সরকার বলে ২৪ হাজার মেগাওয়াট; সরবরাহ করা হয় ১১, ১২ কিংবা ১৩ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ আমরা সবাই লোডশেডিংয়ের ঠেলা সামলাচ্ছি। সামলাতে সামলাতে হাঁপিয়ে যাচ্ছি। প্রথমে এক ঘণ্টা, তারপর আমরা সবাই জানি লোডশেডিং বাড়ছে—দুই, তিন থেকে শুরু করে কোথাও কোথাও আট-নয় ঘণ্টায় গিয়ে ঠেকেছে। ফিলিং স্টেশনে ছোটখাটো হলেও কিছু মানুষের লাইনও শুরু হয়ে গেছে। স্বচক্ষে দেখিনি, দুর্মুখেরা বলছে এসব লাইন নাকি জেনারেটরের ডিজেলের জন্য। অধমের পুরোনো বাসা, জেনারেটর নেই, লাইন দিতে হবে না। শ্রীলঙ্কার লোকেদের চেয়ে অনেক সুখ–শান্তিতে আছি।

অবশ্য ছোটখাটো কষ্ট মাঝেমধ্যে হয়, অন্ধকার ঘরে বন্ধ ফ্যানের নিচে বসে থাকি। লোডশেডিং শেষে ফ্যান ঘুরতে শুরু করলে অত্যন্ত আনন্দিত হই। স্বীকার করছি, সেই মুহূর্তগুলোতে বিগলিত চিত্তে সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে পারি না। আর অন্ধকারে যখন বসে থাকি, তখন তো সরকারের উন্নয়ন চিত্র দেখতেও পাই না। সরকার ঠিকই করছে, দুর্ভাগ্য অধমের।

২.

২০০৮–এর নির্বাচনের সময় তখনকার নির্বাচন কমিশনের উকিল ছিলাম। নির্বাচনের দিন বীরদর্পে নির্বাচনকেন্দ্রে যাইনি। হাজার হলেও উকিল তো নির্বাচন কমিশনের। কোনো দলকে ভোট দিলে মনে মনে যদি আমার নিরপেক্ষতা ভঙ্গ হয়ে যায়, সেই অতিশয় বিশাল আশঙ্কায় ভোটের দিনটি পার করেছিলাম সুদৃঢ়ভাবে টেলিভিশনের সামনে সোফায় বসে। বিভিন্ন কারণে ২০১৪, ২০১৮–তেও ভোট দিতে যাইনি।

বিরোধী ও বিরোধী গোছের অনেক রাজনৈতিক দলই এখন বলছে, দাবি করছে, আন্দোলন করছে এবং আরও কত কিছু করছে আমাদের সামনে সুষ্ঠু ভোটের মুলা ঝুলিয়ে। অর্থাৎ আমরা সুষ্ঠু পরিবেশে ও নিশ্চিন্ত মনে ভোট দিতে পারব। প্রদত্ত ভোটাভুটির গণনাটাও সঠিক হবে। ভালো কথা, কিন্তু এতে আমার লাইট যে জ্বলবে বা ফ্যান যে ঘুরবে, এই আশা-ভরসা কোনো দলই তো এখনো দিচ্ছে না। আমাদের চিকিৎসা ব্যয় কি কমবে? চিকিৎসা ব্যয় কমানোর জন্য তারা কীভাবে কোন ব্যবস্থা নেবে, সে সম্পর্কে একটা বাক্যও শুনেছি বলে মনে তো পড়ে না।

মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য সহ্যসীমার মধ্যে তারা কীভাবে আনবে, তা এখনো ঠাওর করতে পারছি না, কারণ কিছুই কেউ বলে না। ভোট না হয় দিলাম, এতে আমাদের বেঁচে থাকা যে আরেকটু সহজ হবে, সেই আশ্বাসের জন্য হাপিত্যেশ করছি। শঙ্কা হয়, আগামীবারও হয়তো ভোট আর দেওয়া হবে না।

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের অনেকেরই উৎকণ্ঠা বাড়ছে। শিক্ষার খরচও বাড়ছে। কিন্তু বাজারে চাকরি নেই।

শিক্ষাব্যবস্থার অধঃপতন বোঝাতে গিয়ে আশপাশের চেনা–পরিচিত অনেককেই আজকাল একটা কুইজ জিজ্ঞাসা করি। কুইজটা আপনাদেরও জানিয়ে দিচ্ছি। বলুন তো, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে ১৪৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কয়টা বেসরকারি আর কয়টা পাবলিক? একেবারে সঠিক জবাব দিতে হবে না, মোটামুটি কাছাকাছি সংখ্যা হলেও চলবে। এই লেখার পরের বাক্যটিতে এই প্রশ্নের উত্তর আছে।

আরও পড়ুন

এত দূর এসে শ্রদ্ধেয় পাঠকে অনুরোধ—দুই–চার সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেই একটা সংখ্যা আন্দাজ করেন। আমার উত্তরে এক-দুই এদিক–সেদিক হতে পারে। গত কয়েক সপ্তাহে সঠিক সংখ্যা জানার জন্য গুগলকে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করিনি। শেষ জিজ্ঞাসা করেছিলাম কয়েক মাস আগে। গুগল উত্তর দিয়েছিল যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ১৪০ আর বেসরকারি ৮টি।

বড় দাগে আমাদের দেশেও এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শ দেড়েক। দুই-চারটা এদিক–সেদিক হতে পারে, তবে এ ১৫০টির মধ্যে ৫০টি পাবলিক আর ১০০টি বেসরকারি। পাবলিক–বেসরকারির এই অনুপাত ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি’।

৩.

এসব সমস্যা কমবেশি কারও অজানা নয়। কট্টর সরকারপন্থীরা অবশ্যই এর ব্যতিক্রম। কট্টর সরকারপন্থীদের সম্ভাব্য সংখ্যা আন্দাজ করার কোনো সুযোগ অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে এ দেশে আর নেই। একটা প্রচলিত ‘ফরেন চিজ’ আছে, এই ‘চিজ’টাকে ‘ফরেনে’ বলা হয় ‘অপিনিয়ন সার্ভে’। অবশ্যই এর জুতসই শব্দ আমাদের ভাষায়ও আছে। জনমত জরিপ। কিন্তু এটা তো আমরা বহু বছর দেখি না। এত পুরোনোকালের কথা তাই সঠিক মনে নেই বা হলফ করে দাবি করছি না।

যত দূর মনে পড়ে, প্রথম আলোসহ বেশ কিছু পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যম ২০১১, ২০১২ এমনকি ২০১৩–তেও বড় বড় জনমত জরিপ প্রকাশ করেছিল। সরকার কেমন করছে, কোন মন্ত্রী ভালো করছেন, কে খারাপ করছেন, সরকারের কোন নীতি বা পদক্ষেপ ভালো না খারাপ—এই গোছের কিম্ভূতকিমাকার সব প্রশ্ন থাকত। খোলা মনে নাকি সাধারণজন এসব প্রশ্নের উত্তরও দিত।

আরও পড়ুন

উত্তর সরকারের বিপক্ষে গেলেও পত্রিকাগুলো তা ছাপাতে দ্বিধা করত না। কী আশ্চর্য একটা দেশ ছিল রে বাবা। এখন জনমত জরিপ না হওয়ায় সরকার খুব সুখে–আহ্লাদে আছে। জনমত জরিপে অংশগ্রহণ করা হাজার হাজার লোক সরকার সম্পর্কে যদি মন্দ চিন্তা করে, সেটা জেনে সরকারকে এখন আর উৎকণ্ঠিত হতে হয় না।

অবশ্য সরকার যদি নিজেই নিজেকে আরও খুশি করতে চায়, আনন্দে আত্মহারা হতে চায়, তবে সরকার নিজেই জনমত জরিপের ব্যবস্থা করতে পারে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে লাখ লাখ ইভিএম তো কেনা হচ্ছে। সরকারের এই জরিপ ইভিএম মেশিন দিয়ে করলে তো সোনায় সোহাগা। লাখ লাখ লোকের ইভিএম জরিপে সঠিক, নির্ভেজাল এবং খাঁটি উত্তরে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও সরকারের নিখাদ উন্নয়নে ও সাফল্যে উদ্বেলিত হতাম। পত্রিকাগুলো তো আর জরিপ বোধ হয় করবে না, তাই সরকারই করুক, ইভিএম দিয়ে।

শ্রীলঙ্কা শব্দটি এখন আমরা ভুলেও উচ্চারণ করি না।

  • ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক