চট্টগ্রাম চারুকলাকে মূল ক্যাম্পাসে ফেরানোর দাবি কতটা যৌক্তিক

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটকে মূল ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনার দাবিতে চোখে কালো কাপড় পড়ে মানববন্ধন করেছেন শিক্ষার্থীরা

১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন একটি শিল্পশিক্ষালয় স্থাপনের জন্য সচিবালয়ে ছোটাছুটি করছিলেন। তিনি একজন আর্টিস্ট, সেটি জেনে মন্ত্রণালয়ের একজন কেরানি তাঁকে বলেছিলেন, ‘আর্টিস্ট ভাই, আমার ছাতাটিতে আমার নামটা একটু লিখে দিতে পারবেন?’ কেরানি ভদ্রলোকের ধারণা ছিল, যাঁরা সাইনবোর্ড লিখে সংসার চালান, মূলত তাঁরাই হলেন আর্টিস্ট বা শিল্পী। 

চারুকলার শিক্ষা নিয়ে কখনো পর্বতপ্রমাণ, কখনো অল্পস্বল্প সমস্যা ও বিভ্রান্তির সূচনা তখন থেকেই। ১৯৭৪ সালে যখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) চারুকলা বিভাগে শিক্ষকতায় যোগ দিই, তখন একটি কথা আড়ালে–আবডালে বা কখনো প্রকাশ্যে বলাবলি হতো—চারুকলা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো একটি বিষয় নাকি! সেই বাস্তবতার বদল হয়েছে বটে, তবে অন্যান্য চলতি বিষয় থেকে পৃথক হওয়ার কারণে চারুকলা নিয়ে বিভ্রান্তি ও ভুল–বোঝাবুঝির অবসান হয়নি। বিষয়টি নিয়ে ভাবার কারণ হলো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে কিছু শিক্ষার্থীর বিভিন্ন দাবিতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিক্ষোভ ও অচলাবস্থায় আমার ব্যক্তিগত উদ্বেগের জানান দেওয়া। তাঁদের মূল দাবি চারুকলা ইনস্টিটিউটকে মূল ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাঁরা ‘ফিরে আসুক চারুকলা’, ‘২১০০ একর জানে না, চারুকলার ঠিকানা’; ‘চারুকলা ক্যাম্পসে আনো’ ইত্যাদি স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে আন্দোলন করেছে। 

চারুকলার বর্তমান জমিটির দিকে স্বার্থান্বেষী মহলের শ্যেনদৃষ্টি বরাবরই রয়েছে। আজ অর্থবল, বাহুবল, রাজনৈতিক ও সামাজিক অপশক্তির মিলিত দাপটে বিশেষ করে জমি বেদখল হওয়ার তৎপরতা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। একটি অধরা মরীচিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা যেন চারুকলার জন্য নির্দিষ্ট মনোরম স্থানটি নিয়ে দখলদারদের সক্রিয় হওয়ার সুযোগ করে না দিই। এ ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে।

আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় যোগ দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অপর্যাপ্ত পরিসরে আর বর্তমানে শহরে অবস্থিত ইনস্টিটিউটে ৩৮ বছর শিক্ষকতা করে অবসরে গেছি। যদিও চারুশিল্প জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অবসান ঘটেনি। সে কারণেই অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়টি নিয়ে কিছু বলার নৈতিক দায়িত্ব অনুভব করছি। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করলে এখানে একটি চারুকলা বিভাগও স্থাপিত হয়। শিল্পী রশিদ চৌধুরী এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ ও চট্টগ্রাম শহরের সুধীসমাজের আগ্রহও এতে সহায়ক হয়েছিল। 

চারুকলায় মাস্টার্স বা স্নাতকোত্তর পাঠদানও এখানেই প্রথম। সেই আগ্রহে ঢাকার তৎকালীন আর্ট কলেজের ডিগ্রিধারী ব্যক্তিরা অনেকেই আসেন। রশিদ চৌধুরীর স্বপ্ন ছিল চট্টগ্রামে একটি পূর্ণাঙ্গ ও আধুনিক শিল্পশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এর জন্য একটি আর্ট কলেজ স্থাপনেও তিনি উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগটি ক্যাম্পাসে থাকাকালীন ৪০ বছরেও এর পরিসর ও অন্যান্য সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান হয়নি। কিছু অস্থায়ী পরিবর্ধনের পরও আমরা তিন অধ্যাপক একটি অত্যন্ত ছোট গ্রিল দেওয়া পরিসরে বসতাম, যাকে আমরা বলতাম ‘বানরের খাঁচা’।

শিক্ষকসংখ্যার দিক থেকে আমাদের তেমন অপ্রতুলতা ছিল না। তবে বেসরকারি চারুকলা কলেজটির শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ চালানো ক্রমেই দুঃসাধ্য হয়ে উঠছিল। শিক্ষকসংখ্যা কমে জনা আটেকে এসে দাঁড়িয়েছিল। সমাধান হিসেবে ১৯৮৪ সালে এটিকে সরকারীকরণ করা হয়। কিন্তু চারুকলার জন্য পৃথক নিয়োগবিধি না থাকায় নতুন নিয়োগ সম্ভব ছিল না। এই দ্বিবিধ সংকট মোচনের একমাত্র উপায় ছিল দুটি প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করা। একটিতে আছে অবকাঠামো, অন্যটিতে যথেষ্টসংখ্যক শিক্ষক। চারুকলা কলেজের অবকাঠামোটি ব্যবহার করে আধুনিক একটি ইনস্টিটিউট স্থাপন করা যায়, এর সম্প্রসারণও অনেক সহজ হয়। প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেয়ে জমিটি কেবল চারুকলা শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হস্তান্তরিত হয়। 

আরও পড়ুন

উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামের শিল্পানুরাগীদের সমর্থনে বর্তমান জমিতে চারুকলা কলেজ স্থাপিত হলেও জমিটি দখলে স্বার্থান্বেষী মহলের প্রয়াস কখনো থেমে থাকেনি। তারা অর্থব্যয় করে ও মামলা ঠুকে চলেছে। কলেজ সরকারীকরণের ফলে এখানে অবকাঠামো নির্মিত হয়, যা ইনস্টিটিউট স্থাপনের পর আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। একটি বড়সড় প্রদর্শনীগৃহ, সুপরিসর মিলনায়তন ও পাঠাগার, একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ও আধুনিক সেমিনার কক্ষ, একটি মুক্তমঞ্চ, চারুকলার উপযোগী শ্রেণিকক্ষ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার উল্লেখ করতে হয়। ছাপচিত্র শাখায় যেসব আধুনিক ছাপযন্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা রয়েছে, যা বাংলাদেশের কোথাও নেই।

এটি মানতে হবে যে ছাত্রদের দাবিদাওয়ার বিভিন্ন দিক রয়েছে। ২ হাজার ১০০ একরের মূল ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার প্রধান দাবিটি মূলত মনস্তাত্ত্বিক, বৃহত্তর ছাত্রসমাজের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মানসিক আকাঙ্ক্ষাপ্রসূত। অন্য অভিযোগগুলো প্রধানত ভৌত অবকাঠামো ও অন্যান্য সুবিধার সঙ্গে যুক্ত এবং এসবের সমাধান একটি চলমান প্রক্রিয়া। দালানকোঠা নির্মাণ করলে তার রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় মেরামত এই প্রক্রিয়ার অংশ, এটি সব অবকাঠামোর বেলায় সমান সত্য। ছাত্রীদের শৌচাগারের সংকট অবিলম্বে মোচন করা দুরূহ কিছু নয়। পাঠাগারসম্পর্কিত অভিযোগটি নিয়ে একটু দ্বিমত করতে চাই। বর্তমান পাঠাগারটির সমান বা বেশি পরিসর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়টি বিভাগে আছে জানি না। এরপরও নতুন নতুন পুস্তক সংযোজিত হোক, জ্ঞানের পরিসর বাড়তে থাকুক, এটা তো সবারই চাওয়া নিশ্চয়। 

মূল ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার আগ্রহের মধ্যে আবেগ যতটুকু রয়েছে, সে তুলনায় বাস্তবতা কতটুকু, তা ভেবে দেখতে বলি। যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মূল ক্যাম্পাসে বর্তমান ইনস্টিটিউটটির সমান সুবিধাযুক্ত ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করে দিতে পারে, তাহলেই কেবল সবার মতামত সাপেক্ষে স্থানান্তরের প্রশ্ন উঠতে পারে। 

চারুকলা বা সৃজননির্ভর বিষয়ের শিক্ষাব্যবস্থা সাধারণ জ্ঞাননির্ভর শিক্ষার চেয়ে অনেকটাই ভিন্নতর। এর জন্য দরকার সৃজনের সাধনার নিভৃতি আর সার্বক্ষণিক অনুশীলনের সুযোগ। অন্যান্য দেশের শিল্প শিক্ষালয়গুলোর দিকে তাকালেও আমরা দেখি, যে শিক্ষালয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় বা বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের অংশ, সেগুলোও স্বতন্ত্র ক্যাম্পাসে অবস্থিত। সৃজনশীলতার শিক্ষা ভিন্নতর বলেই এটি করা হয়। বর্তমান ইনস্টিটিউটে সৃজনশীল বিষয়ে শিক্ষার যেটুকু সুবিধা রয়েছে, মূল ক্যাম্পাসে গেলে সেটি বাড়বে বলে মনে করার বাস্তব কারণ নেই। আশা করি আন্দোলনকারীরা এটিও মাথায় রাখবেন।

চারুকলার বর্তমান জমিটির দিকে স্বার্থান্বেষী মহলের শ্যেনদৃষ্টি বরাবরই রয়েছে। আজ অর্থবল, বাহুবল, রাজনৈতিক ও সামাজিক অপশক্তির মিলিত দাপটে বিশেষ করে জমি বেদখল হওয়ার তৎপরতা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। একটি অধরা মরীচিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা যেন চারুকলার জন্য নির্দিষ্ট মনোরম স্থানটি নিয়ে দখলদারদের সক্রিয় হওয়ার সুযোগ করে না দিই। এ ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে।

আবুল মনসুর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, চারুকলা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়