কয়েক বছর আগের কথা। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের নেতাদের মধ্যে ‘বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে গেছে’ বা ‘সিঙ্গাপুরকেও ছাড়িয়ে যেতে চলেছে’ ধরনের ভাষ্য বেশ জোরদার হয়ে উঠেছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ–সংক্রান্ত আলাপের সরগরমের মধ্যেই কোনো একজনের ফেসবুক পোস্টে একটি মন্তব্য করেছিলাম—‘সিঙ্গাপুর একটি দুর্ভাগা দেশ। দেশটির ঐতিহাসিক স্বাধীনতা দিবসও নেই, বিজয় দিবসও নেই। যা আছে, সেটি হচ্ছে “ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া” দিবস।’
অনেকেই মন্তব্যটির ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। প্রত্যুত্তরে লিখেছিলাম, ‘শুধু ব্যাখ্যাই নয়, আমাদের বিজয় ও স্বাধীনতার ব্যর্থতা মূল্যায়নের একটি অত্যন্ত দরকারি আলাপ আকারেই উক্তিটি হাজির করব। আমাদের দুটি দিবস আছে। দুই দিবসেই আমরা চাওয়া-পাওয়া, প্রত্যাশা ও স্বপ্নের কথাগুলো বলার, নিজেদের মূল্যায়ন করার সুযোগ পাই। সিঙ্গাপুরে বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস না থাকায় তাদের মূল্যায়নের আনুষ্ঠানিক কোনো দিনও নেই; কিন্তু সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউর মাত্র তিনটি নীতিমালা নিলেই আমরা সত্যিই হয়তো সিঙ্গাপুর হয়ে উঠতে পারতাম।
‘ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া’ কথাটি আমার নয়, খোদ সিঙ্গাপুরের দ্রষ্টা-স্রষ্টা নির্মাতা লি কুয়ান ইউর।
সাংবাদিকেরা বা বিদেশিরা মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুরের ‘সিসেশন’ বা ‘সেপারেশন’ বা বিভক্তি হয়েছে বললে তিনি মনে করিয়ে দিতেন—না না না, বিভক্তি হয়নি, আমাদের বের করে দেওয়া হয়েছে (নট সাকসিডেড, উই আর এক্সপেলড)। বের করে দেওয়া নিয়ে তাঁর হীনম্মন্যতা ছিল না; বরং সত্য বলাটাই সততা—বিশ্বাস করতেন। ইতিহাস তো ইতিহাসই!
১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়ার সংসদে আইন করে সিঙ্গাপুরকে মালয়েশিয়া থেকে বের করে দেওয়ার পর লি কুয়ান ইউ বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তাঁর কান্নার বাঁধভাঙা আইকনিক ছবিটি অনেকেই দেখে থাকবেন। (খুঁজলে ছবিটি অনলাইনে এখনো পাওয়া যেতে পারে। টিভি ফুটেজও ইউটিউবে থাকার কথা।) মধ্য ষাটের দশকে মালয়ি-প্রধান মালয়েশিয়ার সঙ্গে সিঙ্গাপুরের অমালয়ি চীনা বংশোদ্ভূতরাসহ সংখ্যালঘু তামিল অধিবাসীদের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক পরিচিতির কারণে পিছিয়ে পড়া, এবং কেন্দ্রের দ্বারা প্রান্তের শোষিত হওয়া এবং অন্যান্য বৈষম্যের কারণে দ্বন্দ্ব বাড়ছিল। ১৯৬৪ সালে একটি সাংস্কৃতিক দাঙ্গাও হয়েছিল।
তুলনায় নিলে অবাক হওয়ার বিষয়, মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর দ্বন্দ্ব পরিস্থিতি এবং পশ্চিম পাকিস্তান-পুর্ব পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব পরিস্থিতি প্রায় একই রকম ছিল। দ্বন্দ্বগুলো তেজি হওয়ার ঘটনাও সমসাময়িক (মধ্য ষাট), সিঙ্গাপুরে যেমন মধ্য ষাটে, বাংলাদেশেও। বৈষম্য, বঞ্চনা, কেন্দ্র দ্বারা প্রান্তের শোষণ ও রাজনৈতিক হিস্যায় কমতি ইত্যাদি। মালয়েশিয়া সংসদে আইন করে সিঙ্গাপুরকে আলাদা করে দিল। ভাবসাব, ‘যা বাবা, অত মারামারি, ঝুটঝামেলা, বৈষম্যের অনুযোগ-অভিযোগ নিয়ে একসঙ্গে থাকতে হবে না! যা আলাদা হয়ে যা।’
আলাপটি মোড় ঘুরে অন্যদিকে চলে যাওয়ার আগে লি কুয়ান প্রসঙ্গে ফিরি। লি কুয়ান কেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, তাঁর কাছ থেকে কী শেখার ছিল, আমরা কেন না শিখে ঠিক উল্টো পথেই হাঁটলাম, সেই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা দরকার।
লি কুয়ান রাষ্ট্রসংস্কারে নামলেন। সংস্কার এলে পুনর্গঠন হবেই। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বেশ কিছু নীতিমালা করলেন। নীতিমালাগুলোর তিনটির বিষয়ে ন্যূনতম ছাড়ও দেননি। সেই অন্যতম তিনটি নীতিমালা বাংলাদেশ অনায়াসেই অনুসরণ করতে পারত। কারণ, ১৯৭১ সালে বিজয়ের পরপরই দেখার সুযোগ ছিল মাত্র ছয় বছরে সিঙ্গাপুর কোথায় গিয়ে পৌঁছাল, কীভাবে পৌঁছাল! সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের চালকেরা সামান্য ভিশনারিও যদি হতেন, সিঙ্গাপুর থেকে শিখতেন।
লি কুয়ানের যুদ্ধ ঘোষণার মতো তিন নীতিমালার একটি বিষয়ে তাঁর উদ্ধৃতি—ইফ ইউ ওয়ান্ট টু বিট করাপশন, বি প্রিপেয়ার্ড টু জেল ইয়োর ফ্রেন্ডস (যদি আপনি দুর্নীতিকে হারাতে চান, তবে নিজের বন্ধুদের জেলে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত থাকুন।) দুর্নীতির বেলায় ‘জিরো টলারেন্স’ তিনি শুধু কথার কথাই রাখেননি। সত্যিকারের প্রয়োগও ঘটিয়েছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু, তারই মন্ত্রিপরিষদের ডাকসাইটে মন্ত্রী আত্মগ্লানিতে আত্মহত্যা করেছিলেন। তিনি বন্ধুকে রক্ষায় দাঁড়াননি। কারণ, বন্ধুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ মিলছিল।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালাটি ছিল—যেকোনো মূল্যে নির্বাহী বিভাগকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের চাপ থেকে শতভাগ মুক্ত করে দিয়ে মেধানির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। তিনি দেখালেন, কীভাবে সত্যিকারের মেরিটোক্র্যাসির (মেধাতন্ত্রের)চর্চা হয়। কীভাবে সবচেয়ে মেধাবী, দক্ষ, সৎ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিক্ষিতজনকে দিয়ে দেশ গড়ে তুলতে হয়। প্রধানমন্ত্রীরও যেন সব সময়ের জন্য জানা থাকে—একটি সুশৃঙ্খল অরাজনৈতিক প্রশাসনের নিয়মসিদ্ধ কার্যক্রমের বেলায় তাঁর রাজনৈতিক প্রভাবের কানাকড়ি দামও থাকবে না।
লি কুয়ান থেকে শিক্ষণীয় তৃতীয় শক্তিশালী নীতিমালা, ‘একটি দেশ পারিবারিক ব্যবসা নয়।’ রাষ্ট্রে পরিবার ঢোকানো যাবে না। তাহলে সেটি হয়ে পড়বে প্যাট্রিমোনিয়াল স্টেট, শেষ বেলায় স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বলেছিলেন, ‘যদি আমার ছেলে অযোগ্য হয়, তবে তাকে অন্য যে কারো মতোই পদচ্যুত করতে হবে। আরেকবার বলেছিলেন, ‘যে মুহূর্তে আপনার পরিবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে, সেই মুহূর্তেই রাষ্ট্র শেষ হয়ে যাবে।’
‘ফ্রম থার্ড ওয়ার্লড টু ফার্স্ট’ আত্মজীবনীটি ছাড়াও তাঁর নির্বাচিত সাক্ষাৎকারগুলোর সংকলন রয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে তাঁর একটি উক্তি আছে যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘একবার যদি আপনি সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্যকে মানদণ্ড হিসেবে অনুমোদন করেন, তাহলে আপনি রাষ্ট্রকেই ধ্বংসের পথে ঠেলে দেবেন।’ ১৯৭০ সালে সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘সরকার আসবে ও যাবে। সিভিল সার্ভিসকে অবশ্যই সৎ, দক্ষ ও রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ থাকতে হবে।’ তিনি লিখেছিলেন, ‘যদি আপনি যোগ্যতার পরিবর্তে আনুগত্য দেখে লোক নিয়োগ দেন, তবে পুরো ব্যবস্থাটি পচে যাবে।’
লি কুয়ান থেকে শিক্ষণীয় তৃতীয় শক্তিশালী নীতিমালা, ‘একটি দেশ পারিবারিক ব্যবসা নয়।’ রাষ্ট্রে পরিবার ঢোকানো যাবে না। তাহলে সেটি হয়ে পড়বে প্যাট্রিমোনিয়াল স্টেট, শেষ বেলায় স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বলেছিলেন, ‘যদি আমার ছেলে অযোগ্য হয়, তবে তাকে অন্য যে কারো মতোই পদচ্যুত করতে হবে। আরেকবার বলেছিলেন, ‘যে মুহূর্তে আপনার পরিবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে, সেই মুহূর্তেই রাষ্ট্র শেষ হয়ে যাবে।’
লি কুয়ানের ছেলে লি সিয়েন ল্যুংও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন; কিন্তু সেটি মোটেও উত্তরাধিকারের রাজনীতির মাধ্যমে ঘটেনি। লি সিয়েন বহু বছর সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও মন্ত্রিসভায় নানা পর্যায়ে ও ধাপে কাজ করেছেন। কাউকে ডিঙিয়ে তাঁর প্রমোশন হয়নি। ক্ষমতায় আসার আগে তাঁকে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে দলীয় কাঠামো ও সংসদীয় প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়েই প্রধানমন্ত্রী হতে হয়েছিল।
লি কুয়ান উইল করে গেলেন, যাতে তাঁর মৃত্যুর পর অক্সলি রোডের ঐতিহাসিক বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়। কারণ, বাড়িটি যেন কোনোভাবেই ‘রাজনৈতিক স্মৃতিসৌধ’ বা পারিবারিক ক্ষমতার প্রতীক হয়ে উঠতে না পারে। স্বভাবতই তাঁর সন্তানদের মধ্যে উইলটি নিয়ে মতভেদ তৈরি হয় তাঁর উইলকালে এবং জীবদ্দশাতেই। তবুও লি কুয়ান ইউ নিজের অবস্থান বদলাননি। তাঁর ভাষ্য ছিল, ‘ব্যক্তিগত স্মৃতি রাষ্ট্রের প্রতীক হয়ে উঠলে, রাজনীতি আবেগবন্দী হয়ে পড়ে।’
১৯৭১ সালের বিজয়-পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের চিত্র মিলিয়ে দেখা যাক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অন্তত এই তিনটি নীতিমালার ওপর দাঁড়িয়ে এগোনোর রাজনৈতিক সততার পথে হাঁটতে পারত। হেঁটেছে শতভাগ উল্টো পথে।
১৯৭২ সাল থেকেই দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিতে থাকে। সিভিল সার্ভিসের বীভৎসতম দলীয়করণ হয়। আমরা হাস্যরস করি ‘তোফায়েল কমিশন’ নিয়ে। সে সময় আওয়ামী লীগ হরিলুটের মতো প্রশাসনকেও লুট করে নেয়। তোফায়েল আহমেদের তালিকাই ছিল প্রশাসনের পদ-পদায়নের ভিত্তি। অসংখ্য অদক্ষ-অযোগ্য, অপরাধী ও দুর্নীতিবাজ মানুষে প্রশাসন ভরে গিয়েছিল। সেই যে মগজে পচনের শুরু, রোগটির সংক্রামক হয়ে ওঠা আর থামেনি। পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বয়সও ৫৫ বছরে পড়ছে।
২০২৪ সালে স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর বাংলাদেশের সামনে আরেকবার সুযোগ এসেছে শেখার ও ভুল সংশোধনের। নির্বাচনের ডামাডোল শুরু হয়েছে। নানা অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়েছে। এখন কি তাহলে আমরা আবারও সিঙ্গাপুরের মতো সেই সুযোগটি হারাব?
হেলাল মহিউদ্দীন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটার মেভিল স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞান অধ্যাপনায় নিয়োজিত
*মতামত লেখকের নিজস্ব
