ইরানকে সঙ্গে নিয়ে সার্বিয়া যেভাবে ইউরোপকে পরীক্ষায় ফেলেছে

সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার ভুচিচ ও ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি

রাশিয়াকে সামরিক সহযোগিতা দেওয়া এবং নিজ দেশের আন্দোলনকারীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু বলকান অঞ্চলে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার আবেদন করলেও সার্বিয়া সাম্প্রতিক কালে ইরানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছে।

ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য ইরানের সঙ্গে যেখানে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, সেখানে  ইসলামিক রিপাবলিক ইরানকে বন্ধুদেশ বলে মনে করছে সার্বিয়া। পক্ষান্তরে বলকান অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধিতে সার্বিয়া ইরানের জন্য নিখুঁত এক সুযোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান ৪ ডিসেম্বর তাঁর সার্বিয়া সফরকালে বলেছেন, যৌথ স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ইরান ও সার্বিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক ধারাবাহিকভাবে উন্নতি ও সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ দফায় দুই দেশের মধ্যে নতুন কোনো স্বাক্ষর হয়নি। কিন্তু নারী অধিকার প্রশ্নে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন নির্মমভাবে দমনের কারণে তেহরান যখন আন্তর্জাতিক চাপে পড়েছে, সে সময় দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তাকে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছে সার্বিয়া। 

আবদুল্লাহিয়ান তাঁর এ সার্বিয়া সফরকে ইউরোপের দেশগুলোতে থাকা দেশটির সব কূটনীতিকের এক জায়গায় সমবেত করতে ব্যবহার করেন। ইউরোপে নিযুক্ত ইরানের কূটনীতিকেরা বেলগ্রেডে তাঁদের মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। সার্বিয়া সফর শেষে আবদুল্লাহিয়ান বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা সফর করেন। সেখানে তিনি বলেন, বসনিয়ার কঠিন সময়ে তেহরান সব সময় তাদের পাশে ছিল।

১৯৯০-এর দশকে বসনিয়া যুদ্ধের সময় সেখানকার মুসলিম সশস্ত্র গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। কিন্তু ইরান ইদানীং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা থেকে বলকান অঞ্চলে সার্বিয়াকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ায় সারসহ অন্যান্য পণ্য বিকল্পভাবে ইরান থেকে আমদানি করছে। এর বিনিময়ে ইরানে নিজেদের গম রপ্তানি করতে চায় সার্বিয়া। ইরান থেকে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিও শুরু করেছে দেশটি। 

চারপাশে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ পরিবেষ্টিত বলকানের এই দুটি দেশ ইরানের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করবে বলে মনে হয় না। ইরানের কর্মকর্তারা সম্প্রতি দাবি করেছিলেন, বেলগ্রেড তাঁদের কাছ থেকে ড্রোন কিনতে যাচ্ছে। কিন্তু সার্বিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ দাবির সত্যতা নাকচ করেছেন। বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইরানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি হলে পশ্চিমা তাতে চোখ বন্ধ করে রাখবে না।

ইরান ও সার্বিয়ার মধ্যে যে মাঝারি ধরনের বাণিজ্য বিনিময় হয়ে আসছে, এখন দুই দেশই সেটা বাড়াতে চাইছে। ২০২১ সালে দুই দেশের মধ্যে ৫০ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছিল। 

এ বছরের জুলাই মাসে বেলগ্রেডে ইরান ও সার্বিয়ার ৮০ জন ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ীদের সংগঠনের প্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তারা একটি সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। এ সম্মেলন সার্বিয়া ও ইরানের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে।

বেলগ্রেড ও তেহরান একটি যৌথ চেম্বার অব কমার্স প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে, যেটি দুই দেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতে বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করবে। এ ছাড়া অক্টোবর মাসে বিমান চলাচলে সার্বিয়ার সঙ্গে ইরান নতুন একটি চুক্তি করেছে। নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, এটা নিয়মিত বাণিজ্যিক বিমান চলাচল-সম্পর্কিত চুক্তি। 

গত ফেব্রুয়ারিতে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার ভুচিচ টেলিফোনে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গে কথা বলেন। সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকালে দুই নেতার মধ্যে সরাসরি সাক্ষাৎ হয়। ভুচিচ নিকট ভবিষ্যতে ইরান সফরের পরিকল্পনা করেছেন। ইরানের সঙ্গে কৃষি, খাদ্য, রাসায়নিক, তেল, পর্যটন, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা বাড়াতে চায় সার্বিয়া।

আরও পড়ুন

এ অর্থনৈতিক স্বার্থের বাইরে দুই দেশের মধ্যে একটি রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। আবদুল্লাহিয়ান তাঁর সফরে শুধু সার্বিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেই বৈঠক করেননি, দেশটির প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও দেখা করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে বেলগ্রেড ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। ২০০৮ সালে সার্বিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কসোভোর স্বাধীনতার স্বীকৃতি এখন পর্যন্ত দেয়নি ইরান। চীন, রাশিয়াসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাঁচটি দেশও কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়নি। 

সার্বিয়ার অখণ্ডতায় সমর্থন করায় সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন। অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি সার্বিয়া এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনিয়া। তা সত্ত্বেও চারপাশে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ পরিবেষ্টিত বলকানের এই দুটি দেশ ইরানের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করবে বলে মনে হয় না। ইরানের কর্মকর্তারা সম্প্রতি দাবি করেছিলেন, বেলগ্রেড তাঁদের কাছ থেকে ড্রোন কিনতে যাচ্ছে। কিন্তু সার্বিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ দাবির সত্যতা নাকচ করেছেন। বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইরানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি হলে পশ্চিমা তাতে চোখ বন্ধ করে রাখবে না।

বলকান অঞ্চলে প্রধান বিদেশি খেলোয়াড় হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানোয় এখন পর্যন্ত তারা কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। হতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত বলকানে ইউরোপিয়ান ও আমেরিকানদের স্বার্থে বড় আঘাত না আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সার্বিয়ার ‘বহুপক্ষীয় পররাষ্ট্রনীতিতে’ তাঁরা নীরব থেকে যাবেন।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ
নিকোলা মিকোভিচ সার্বীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক