মুরসি ও ঘানুসির মতো ইমরানেরও কি একই পরিণতি?

মোহাম্মদ মুরসি, রশিদ ঘানুসি ও ইমরান খান
ছবি: সংগৃহীত

২০১৪ সালের গ্রীষ্মের কথা। তত দিনে মিসরের ক্ষমতাচ্যুত মোহাম্মদ মুরসি নিক্ষিপ্ত হয়েছেন আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির কারাগারে। তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতঅলুর মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক একটি বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিল ‘বিলিম ভে সানাত ভাকফি’ নামক ইস্তাম্বুলের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে।

দাভুতঅলু অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির। বাক্য ও শব্দচয়নে দাভুতঅলুর দক্ষতা তখনকার সময়ে প্রশংসিত ছিল প্রায় সব রাজনৈতিক দলের কাছে। কিন্তু গ্রীষ্মের ওই দিনে দাভুতঅলু ছিলেন অসম্ভব উত্তেজিত। মুরসির ক্ষমতাচ্যুতি এবং কারাবরণ মেনে নিতে পারেননি দাভুতঅলু। বক্তব্যে অত্যন্ত স্পষ্ট কিছু কথা বললেন আরব বিশ্বে পশ্চিমাদের বিশেষ করে মার্কিনদের হস্তক্ষেপের দরুন সৃষ্ট জবরজং অবস্থা নিয়ে।

দাভুতঅলু প্রায় এক ঘণ্টার বক্তৃতার ইতি টানলেন পশ্চিমাদের উদ্দেশে পরিষ্কার একটি প্রশ্ন রেখে। প্রশ্নটি ছিল, ‘পশ্চিমকে এ কথা অবশ্যই সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে আমরা গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত, কিন্তু পশ্চিমারা আমাদের গণতন্ত্র চর্চা করার সুযোগ করে দেবে কি না, সে সিদ্ধান্ত পশ্চিমকেই নিতে হবে।’

আরও পড়ুন

সম্প্রতি পাকিস্তানের ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতি, কারাদণ্ড, আগত জাতীয় নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণাসহ সার্বিক পরিস্থিতি আবার সামনে নিয়ে এসেছে দাভুতঅলুর প্রায় এক দশক আগের আলোচিত প্রশ্নটি। ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন রাষ্ট্রীয় উপঢৌকন বিক্রিতে।

উপমহাদেশের রাজনীতিতে গরু, ছাগল, বই কিংবা ঘরের আসবাব চুরির মামলা হরহামেশাই হয়ে থাকে। ওই মামলায় ইমরানের সাজা হয়েছে তিন বছরের। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন ইমরান খানকে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অযোগ্য ঘোষণা করেছে পাঁচ বছরের জন্য।

ইমরান–সংক্রান্ত আলাপ এখানেই থেমে যেতে পারত; কিন্তু প্রচলিত সংবাদকাঠামোর বাইরে গিয়ে সংবাদ সরবরাহে বিখ্যাত সংবাদ সংস্থা দ্য ইন্টারসেপ্ট ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুত নিয়ে প্রকাশ করেছে চমকপ্রদ এক খবর।

আরও পড়ুন

দ্য ইন্টারসেপ্ট দাবি করেছে, ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং মার্কিন সরকারের মধ্যে সমঝোতার একটি দলিল তাদের হস্তগত হয়েছে। ইমরান নিজেও একই দাবি করেছিলেন ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে।

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইমরানকে ক্ষমতা থেকে অপসারণে মার্কিন এই তৎপরতা দাভুতঅলুর প্রশ্নকে অর্থবহ করে তুলেছে প্রচণ্ডভাবে। কারণ, ইমরানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হওয়া উচিত ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে; সেনাবাহিনী ও মার্কিন পরিকল্পনায় নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত সরকার উৎখাতে পশ্চিমা এবং মার্কিনদের রয়েছে এক বিস্তর ইতিহাস।

‘আরব বসন্ত’–পরবর্তী সময়ে স্বচ্ছ নির্বাচন ক্ষমতায় বসিয়েছিল মুরসিকে। কিন্তু নির্বাচনের এক বছরের মধ্যেই নানান অভিযোগ তুলে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল মিসরের সেনাবাহিনী মার্কিন মদদে। তখন মিসরের সেনাবাহিনীর গণতন্ত্রবিরোধী এমন কার্যকলাপে জোরেশোরে সমর্থন দিয়েছিল সৌদিঘেঁষা আল নুর পার্টি এবং মিসরের সুশীল সমাজের একটি অংশ।

এই সুশীল সমাজের নেতৃত্বে ছিলেন আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার (আইএইএ) সাবেক প্রধান এল বারাদি। উৎখাতপরবর্তী সময়ে জেলখানায় নিহত হয়েছেন মুরসি। একই ধারায় তিউনিসিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন তিউনিসিয়ার রশিদ ঘানুসির দল আন নাহদা। রশিদ ঘানুসি আরব বিশ্বের অন্যতম প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতা।

আরও পড়ুন

রাজনৈতিক ইসলামের ধারণাকে নতুনভাবে সংগঠিত করে সেক্যুলারিজমসহ অন্য সব মতামতকে সঙ্গে নিতে কীভাবে সবার অন্তর্ভুক্তিসহ একটি সমাজ গঠন করা যায়, সে বিষয়ে নানান মতামত প্রকাশ করে আসছিলেন কয়েক বছর ধরেই।

কিন্তু ঘানুসির শেষ রক্ষা হয়নি। করোনা মহামারির অব্যবস্থাপনাসহ নানান অজুহাত তুলে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদ ২০২১ সালের গ্রীষ্মে ভেঙে দেন জাতীয় সংসদ এবং স্থগিত করেন সংবিধান। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে গ্রেপ্তার করেন রশিদ ঘানুসিকে। অনেকটা মুরসি ও ইমরানের মতোই বর্তমানে কারাগারে ঘানুসি।

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ঘানুসির কারাবাস নিশ্চয়ই সচেতন পাঠকদের দাভুতঅলুর উত্থাপিত প্রশ্নটির গুরুত্ব অনুধাবনে সাহায্য করেছে।

সম্ভবত ইমরানের পরিণতি অনেকটাই মুরসি ও আলেন্দের পরিণতির দিকে যাচ্ছে। তাই আহমেদ দাভুতঅলুর প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমকেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে অ–ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের নিজেদের কায়দায় গণতন্ত্র চর্চা করার সুযোগ পাবে কি না?

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাতের এই পশ্চিমা নীতি শুধুই মধ্যপ্রাচ্য কিংবা দক্ষিণ এশিয়ায় থেমে থাকেনি; ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সমাজতন্ত্রকে বিদায় করার জন্য পশ্চিমারা, বিশেষ করে মার্কিনরা লাতিন আমেরিকার নানান দেশে সেনাশাসন চাপিয়ে দিয়েছিল। সেই তালিকা অনেক দীর্ঘ এবং রক্তাক্ত।

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসি, ঘানুসি কিংবা ইমরানের ঘটনার সঙ্গে চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের অনেক মিল। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় আলেন্দে নির্বাচিত হয়েছিলেন গণতান্ত্রিকভাবে। স্বপ্ন দেখেছিলেন চিলিসহ লাতিন আমেরিকার সম্পদ, বিশেষ করে কৃষিজমিতে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার।

তাই আলেন্দে সমাজতন্ত্রের আলোয় নির্ভর করে কলকারখানা জাতীয়করণ আর ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে লাগাম টেনে ধরেছিলেন মার্কিনদের বাণিজ্যের। যার দরুন জীবন দিতে হয়েছিল তাঁকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে এভাবেই অ–ইউরোপীয় দেশগুলোয় গণমানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা বারবার হেরে গিয়েছে পশ্চিমের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শিক স্বার্থের কাছে, যার সর্বশেষ নজির ইমরান খান ও ঘানুসি।

সম্ভবত ইমরানের পরিণতি অনেকটাই মুরসি ও আলেন্দের পরিণতির দিকে যাচ্ছে। তাই আহমেদ দাভুতঅলুর প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমকেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে অ–ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের নিজেদের কায়দায় গণতন্ত্র চর্চা করার সুযোগ পাবে কি না?

  • রাহুল আনজুম যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা সহকারী