ইসরায়েল দশকের পর দশক ধরে চরম অবিচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধ ও দখলদারি চালিয়ে আসছে, তা যুক্তরাষ্ট্র ও বাকি বিশ্বের বাসিন্দারা এই প্রথমবারের মতো সর্বাংশে উপলব্ধি করতে পারছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন সাধারণ মিডিয়ার গৎবাঁধা দৃষ্টিভঙ্গি উড়িয়ে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সেই সত্যগুলো প্রকাশ করেছে, যা আগে দীর্ঘদিন ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারণ ‘মূলধারার’ সংবাদমাধ্যমে আগে ইসরায়েলকে আক্রমণের শিকার ও ফিলিস্তিনকে আক্রমণকারী হিসেবে দেখানো হতো।
আমেরিকানদের এই জনমতের পরিবর্তনকে প্রথম দিকে অনলাইনে সক্রিয় অল্প কিছু কিশোরের ‘ক্ষণস্থায়ী রোগের’ ফল সাব্যস্ত করে উপেক্ষা করা হয়েছিল। কিছু জায়নবাদী নেতা এটিকে একেবারেই পাত্তা দেননি, কারণ তাঁরা পশ্চিমা মিডিয়ায় দীর্ঘদিনের প্রভাবের কারণে মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, প্রচলিত মিডিয়া ও নির্বাচিত কর্মকর্তাদের যেহেতু তাঁরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন, সেহেতু জনগণের মতামত কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তাঁরা ভেবেছিলেন, তাঁদের ‘সুপরিকল্পিত’ প্রোপাগান্ডা বরাবরের মতোই মানুষকে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ঠিকই ঘুরিয়ে আনতে পারবে।
কিন্তু এবার তাঁরা বুঝতে পারলেন, কিছু বিষয় মৌলিকভাবে একেবারে বদলে গেছে। মানুষ এখন সরাসরি ফিল্টারবিহীন ছবি, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা এবং গাজা থেকে আসা কণ্ঠ শুনতে পারছে। কোনো ধরনের প্রচার এগুলোকে মুছে দিতে পারবে না।
নতুন জরিপগুলো দেখাচ্ছে, এই পরিবর্তন কতটা গভীর। কুইনিপিয়াক এবং নিউইয়র্ক টাইমসের নতুন জরিপের তথ্য উল্লেখ করে সিএনএনের প্রধান তথ্য বিশ্লেষক হ্যারি এন্টেন বলেছেন, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ভোটাররা +৪৮ পয়েন্টে ইসরায়েলের পাশে ছিলেন। অর্থাৎ ইসরায়েলকে সমর্থন করা ভোটারদের সংখ্যা ফিলিস্তিনকে সমর্থন করা ভোটারের তুলনায় ৪৮ পয়েন্ট বেশি ছিল। কিন্তু এখন একই জরিপে দেখা গেছে, ভোটাররা ফিলিস্তিনকে +১ পয়েন্টে সমর্থন করছেন। অর্থাৎ এবার ফিলিস্তিন সামান্য হলেও এগিয়ে আছে। তিনি বলেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের জনমত জরিপে ইসরায়েলের চেয়ে ফিলিস্তিনের এগিয়ে থাকার এটিই প্রথম ঘটনা।
জনমত এমনভাবে বদলাচ্ছে যে কোনো নিয়ন্ত্রিত কাহিনি তা আটকাতে পারছে না। কোনো মিডিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং যুদ্ধাপরাধ ঢাকতে পারবে না। সোশ্যাল মিডিয়া ইসরায়েলের ভেজালি নৈতিক ছদ্মবেশ ভেঙে দিয়েছে। কোনো বিলিয়নিয়ার তহবিল, কোনো কংগ্রেসে নেতানিয়াহুর জন্য দাঁড়িয়ে প্রশংসা—কিছুই মুছে দিতে পারবে না, যা মানুষ দেখেছে। যে মিথ অনেক বছর ধরে দখল এবং ইহুদি বর্ণবৈষম্যকে টিকিয়ে রেখেছিল, সেই মিথ নিয়ে মানুষ এখন প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে।
এই পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে। দুই বছর আগে ডেমোক্র্যাট ভোটাররা +২৬ পয়েন্টে ইসরায়েলের পাশে ছিলেন। অর্থাৎ ইসরায়েল সমর্থনকারী ডেমোক্র্যাটরা ফিলিস্তিন সমর্থকদের তুলনায় ২৬ পয়েন্ট বেশি ছিলেন। এখন একই ডেমোক্র্যাট ভোটাররা +৪৬ পয়েন্টে ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান করছেন। অর্থাৎ তাঁরা এখন ফিলিস্তিনকে সমর্থন করছেন এবং সেই সমর্থন ইসরায়েল সমর্থনের তুলনায় ৪৬ পয়েন্ট বেশি।
মাত্র দুই বছরে অবস্থান উল্টে গেছে ৭২ পয়েন্টে। অর্থাৎ, যাঁরা আগে ইসরায়েলের পক্ষে ছিলেন, তাঁরা এখন একই মাত্রায় ফিলিস্তিনের পক্ষে চলে গেছেন। যেন পাল্লাটা সম্পূর্ণ উল্টে গেছে।
অন্যদিকে, রিপাবলিকান ভোটারদের মধ্যে বয়সভিত্তিক ফারাক দেখা যাচ্ছে। ৫০ বছরের কম বয়সী ভোটাররা ইসরায়েলকে অনেক কম সমর্থন করছেন। তবে বয়স্ক ভোটাররা এখনো তুলনামূলকভাবে বেশি সমর্থন দেখাচ্ছেন।
যাঁরা জনমত নিয়ন্ত্রণের নকশা করেছেন, তাঁরা বুঝতে পারেননি, এই পরিবর্তন সাময়িক নয়। এটি প্রজন্মগত এবং নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবভিত্তিক।
তরুণ আমেরিকানরা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে নিরপেক্ষ চোখ থেকে দেখছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পশ্চিমা রাজনীতিতে ইসরায়েলকে ভিকটিম হিসেবে দেখানোর যে ধারা চলে এসেছে, সেই ধারাকে অন্ধের মতো মেনে নেওয়া এখনকার প্রজন্মের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
তাঁরা এমন একটি বৈশ্বিক প্রজন্মের অংশ, যাঁরা দুটো-পাঁচটি নিউজের রুটিন বা শীতল যুদ্ধ দেখে বড় হননি। তাঁদের জন্য তথ্যের উৎস এখন অবাধ। রিয়েল-টাইম ভিডিও এখন প্রচলিত মিডিয়ার বাঁধাধরা বার্তাকে বাইপাস করছে।
ইসরায়েল যখন আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশে বাধা দিল, তখন তা অজান্তে বিকল্প সংবাদ চাহিদাকে বাড়িয়ে দিল। সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি স্বাধীন উৎস হয়ে উঠল। এটি একধরনের সমতার ভূমিকা রাখল। এর মাধ্যমে সেই সব নৃশংসতা প্রকাশ পেল যা আগে পুরোনো মিডিয়া নেটওয়ার্কগুলো ফিল্টার করে চাপা দিয়ে দিত।
সোশ্যাল মিডিয়া লাখ লাখ মানুষকে যুদ্ধাপরাধ দেখার সুযোগ করে দিল। তারা ছবিগুলো দেখল কোম্পানির চোখে নয়, ভুক্তভোগীর চোখে। এটি ৭৭ বছরের জন্য ইসরায়েলকে জবাবদিহি থেকে রেহাই দেওয়া ভাষ্যের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণকে ভেঙে দিল। ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতাল, পাড়া-মহল্লা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অনাহারী শিশুদের ‘র ফুটেজ’ বিশ্বজনমনে পরিবর্তন এনেছে।
এসব ফুটেজই কেন ইসরায়েল স্থানীয় সাংবাদিকদের হত্যা করেছে এবং কেন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে গাজায় ঢুকতে দিচ্ছিল না, তার প্রকৃত কারণ দেখিয়ে দিয়েছে।
জনমতের এই পরিবর্তনই ব্যাখ্যা দেয় কেন আমেরিকার জায়নবাদীরা এখন আরও আক্রমণাত্মকভাবে প্রচলিত এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি জনগণের সহানুভূতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, ইসরায়েল ও তার মিত্ররা বারবার কাহিনি বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা ‘গল্প পরিবর্তন’ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করছে যাতে তারা বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যমে তাদের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে।
জ্যাকি ও জেফ কার্শ নামে দুজন ধনী জায়নবাদী ২০২৫ সালে একটা নতুন ‘জার্নালিজম ফেলোশিপ’ শুরু করেছেন। বাইরে থেকে এটা সাংবাদিকতার ট্রেনিং প্রোগ্রাম বলে দাবি করা হলেও, এর উদ্দেশ্য হলো ইসরায়েলের পক্ষে গল্প বদলে দেওয়া, অর্থাৎ মিডিয়ার বয়ানকে আবার ইসরায়েলপন্থী করে তোলা।
এটির বিজ্ঞাপনেও বলা হয়েছে, ‘শুধু ইহুদিদের নিয়ে বিশ্বের একমাত্র ফেলোশিপ’। এই প্রোগ্রামের মেন্টরের তালিকায় আছে সিএনএন ও নিউইয়র্ক টাইমসের ইসরায়েলপন্থী সাংবাদিকেরা (যেমন ভ্যান জোনস, জোডি রুডোরেন, শারন ওটারম্যান)।
তাঁরা বাইরে থেকে ‘স্বাধীন সাংবাদিকতা’ নামের মোড়ক লাগালেও, ভেতরে আসলে এটি একটি বড়সড় প্রোপাগান্ডা প্রকল্প। এর লক্ষ্য ইসরায়েলের ভাবমূর্তি রক্ষা ও পুনর্গঠন করা। অর্থাৎ প্রোপাগান্ডাকে সাংবাদিকতার পোশাক পরিয়ে আবার মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা।
তবে গাজার বাস্তবতা আনফিল্টার করা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পৌঁছে যাচ্ছে। জনমত এমনভাবে বদলাচ্ছে যে কোনো নিয়ন্ত্রিত কাহিনি তা আটকাতে পারছে না। কোনো মিডিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং যুদ্ধাপরাধ ঢাকতে পারবে না। সোশ্যাল মিডিয়া ইসরায়েলের ভেজালি নৈতিক ছদ্মবেশ ভেঙে দিয়েছে। কোনো বিলিয়নিয়ার তহবিল, কোনো কংগ্রেসে নেতানিয়াহুর জন্য দাঁড়িয়ে প্রশংসা—কিছুই মুছে দিতে পারবে না, যা মানুষ দেখেছে। যে মিথ অনেক বছর ধরে দখল এবং ইহুদি বর্ণবৈষম্যকে টিকিয়ে রেখেছিল, সেই মিথ নিয়ে মানুষ এখন প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে।
এই সচেতনতার রাজনৈতিক প্রভাব ওয়াশিংটনকে ধীরে ধীরে অস্থির করে তুলছে। আগে যেখানে ইসরায়েলের বিষয়ে দুই দলীয় সমঝোতা অটুট ছিল, এখন সেখানে দৃশ্যমান ফাটল দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে মতভেদ বেড়ে চলেছে।
দুই বছর আগে, আমি কল্পনাও করতে পারতাম না, প্রার্থীর পক্ষ থেকে এমন টেক্সট বার্তা পাব যেখানে তাঁরা আইপ্যাকের তহবিল গ্রহণ না করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এমনকি কংগ্রেসের হলগুলোতেও, যেখানে আগে আইপ্যাক কোনো ভিন্নমতকে চুপ করিয়ে দিত, সেখানে এখন ধীর ধীরে একটি নীরব বিদ্রোহ গড়ে উঠছে।
যাঁরা আগে ‘ফিলিস্তিন’ শব্দ উচ্চারণ করতে দ্বিধা করতেন, তাঁরা এখন এটি নৈতিকতার একটি মান হিসেবে উল্লেখ করছেন। আইপ্যাক এবং ইসরায়েলের নীতির প্রশ্ন করা এখন মূলধারার রাজনৈতিক আলোচনার অংশ হয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত, এই প্রজন্মগত বিভাজনে দেখা যাচ্ছে সেই ভয়ের ক্ষয়, যা আগে অনেককে ভীত করত। কথা বলার ভয়, তহবিল হারানোর ভয় বা অ্যান্টিসেমিটিক হিসেবে দাগা খাওয়ার ভয় এখন কমে আসছে। এর পরিবর্তে উঠে আসছে দৃঢ় বিশ্বাস। তরুণ আমেরিকানরা সত্য ও নৈতিক স্পষ্টতা নিয়ে আসছেন। ইসরায়েলকে ইহুদিদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে এক কাতারে মিলিয়ে দেওয়া ধারণাকে কারা প্রত্যাখ্যান করছেন।
জামাল কান্জ লেখক ও বুদ্ধিজীবী। তিনি নিয়মিত আরব বিশ্বের বিষয় নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কলাম লেখেন
কাউন্টার পাঞ্চ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ