যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালে জো বাইডেনের কাছে কর্তৃত্ববাদী ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় এবং গত বছর ব্রাজিলে লুলা ডি সিলভার কাছে কর্তৃত্ববাদী জইর বলসোনারোর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে যে ধারা সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ধারাকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও আগামী অক্টোবরে পোল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় পার্লামেন্ট নির্বাচন এগিয়ে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
তুরস্কের অনুষ্ঠিত এবং পোল্যান্ডের অনুষ্ঠেয় নির্বাচন যে জোরালো আভাস দিচ্ছে তা হলো, জনতুষ্টিবাদী কর্তৃত্বপরায়ণ নেতৃত্বের জোয়ার থামতে শুরু করেছে। তুরস্কে প্রথম দফার ভোটে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের উতরে না যেতে পারা সেই আভাসকে জোরালো করেছে। তবে গণতান্ত্রিক শক্তির অগ্রযাত্রায় নির্বাচনী সাফল্যই চূড়ান্ত সাফল্য নয়। এটিকে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কেবল প্রথম ধাপ বলা যেতে পারে।
কারণ, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মতো কঠিন কাজ শুধু তখনই সম্ভব হয়, যখন কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন ঘটানো যায়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্বদানকারীরা কীভাবে সফল হবেন, যখন প্রধান প্রধান রাজনৈতিক শক্তি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনী ব্যবস্থার মৌলিক বিষয়গুলোই মানতে নারাজ? এই বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনালোচিত থেকে যাচ্ছে।
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে গণতন্ত্রীকরণের ‘তৃতীয় তরঙ্গ’ প্রায় একচেটিয়াভাবে সৃষ্টি হয়েছিল। এটিকে আমরা ক্ষমতার ‘পারস্পরিক সহযোগিতামূলক’ পালাবদল বলতে পারি। এই সময়টাতে পতনশীল শাসকদের পেছনে থাকা রাজনৈতিক শক্তিগুলো সরকার পরিবর্তনের জন্য আলোচনার টেবিলে বসুন কিংবা ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হোন না কেন, তাঁরা শেষ পর্যন্ত নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছিলেন। কখনো কখনো তা তাঁরা সমর্থনও করতে চেয়েছিলেন।
উদাহরণস্বরূপ, পোল্যান্ডে ১৯৮৯ সালে পোলিশ গণপ্রজাতন্ত্রের তৎকালীন কার্যত শাসক জেনারেল ওজসিচ জারুজেলস্কি সংহতি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে চুক্তি করেন এবং চুক্তির অংশ হিসেবে প্রেসিডেন্টের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। চিলিতে জেনারেল অগাস্তো পিনোশে ১৯৯০ সালে সরকারপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করার পর সিনেটে আজীবন সদস্য হিসেবে আসন গ্রহণ করেছিলেন। সেই দশকের মাঝামাঝিতে মধ্য ইউরোপের দেশগুলোয় সাবেক কমিউনিস্ট নেতারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়লাভ করছিলেন; কেউ হেরে গেলে সে ফল তাঁরা মেনেও নিচ্ছিলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই সময়ে এসে ট্রাম্প ও বলসোনারোর মতো স্বৈরাচারী নেতারা খুবই ভিন্ন ধরনের ‘অসহযোগিতামূলক’ মডেল অনুসরণ করেছেন। দুজনই নিতান্ত অনিচ্ছায় ও কিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়ে ক্ষমতা ছেড়েছেন; তবে তাঁরা বা তাঁদের সমর্থকেরা কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রবণতা জারি রাখার লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি।
ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে যাওয়ার প্রায় তিন বছর পরও তাঁর অনেক সমর্থক জোর দিয়ে বলে থাকেন, ট্রাম্পের ভোট ‘চুরি’ হয়েছিল। এটি যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে হচ্ছে তা-ই নয়। পোল্যান্ডে ২০০৭ সাল থেকে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসা ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (পিআইএস) এবং উদারপন্থী বিরোধীদের মধ্যে সংঘাত লাগতে যাচ্ছে। বিরোধীদের আন্দোলনে প্রথমবার পিআইএস সরকারের পতন হওয়ার পর ডোনাল্ড টাস্কের (যিনি ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন) নেতৃত্বাধীন বিজয়ী জোট একটি দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়েছিল।
পিআইএসের অন্যায়ের (যেমন পিআইএসের কুখ্যাত মন্ত্রী জাবিগনিউ জিওব্রোর ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয় নথিভুক্ত করা) শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে ডোনাল্ড টাস্ক কঠোর হতে পারেননি। রাজনৈতিক সম্প্রীতির স্বার্থে তিনি পিআইএসের অন্যায়ের বিষয়ে ‘হালকা স্পর্শের পদ্ধতি’ বেছে নিয়েছিলেন। ফলে পিআইএস নেতাদের কখনোই জবাবদিহি করা হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় আবার তারা মাথাচাড়া দেয়।
তুরস্কে এরদোয়ান ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদের যে ভিত্তি গড়েছেন, তা যথেষ্ট কঠিন। উদারপন্থীদের পক্ষে তা রাতারাতি ভেঙে ফেলা কঠিন, কিন্তু ধাপে ধাপে গণতন্ত্রকে সেখানে এগিয়ে আনা সম্ভব। তুরস্কের নির্বাচনে উদারপন্থীদের জোরালো অবস্থান সেটিই দেখাচ্ছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● ম্যাকিয়েজ কিসিলোস্কি সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির আইন ও পাবলিক ম্যানেজমেন্ট বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং
● আনা ওয়াজসিউক ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক