পঁচিশে দুর্দান্ত প্রথম আলো বলুক কথা অবিরত

১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু করা প্রথম আলো রজতজয়ন্তী উদযাপন করছে
ছবি : প্রথম আলো

প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনমান ও চিন্তাধারার যুগপৎ পরিবর্তন হচ্ছে। পৃথিবী দুর্বার গতিতে ছুটছে, সেই সঙ্গে মানুষ ছুটছে। প্রযুক্তির সেবা গ্রহণ করতে আমরা নিজেদের অভিযোজন ক্ষমতা বাড়িয়ে ফেলছি।

একটা সময় ছিল, যখন আমরা তথ্য পেতে অপেক্ষা করতাম টেলিভিশন, রেডিও কিংবা ছাপা পত্রিকার ওপর। এখন ইন্টারনেট-প্রযুক্তি আমাদের আরও বেশি ইউনিফায়েড করে ফেলছে। বিশেষ করে এখন তথ্য ছাড়া নিজেদের অস্তিত্বও কল্পনা করা যায় না। আর সেই খোরাক মিটিয়ে চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যম। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো নানা গুজবের ভিড়ে মানুষ এখনো আস্থার জায়গায় বিশ্বস্ত গণমাধ্যমগুলোকে এগিয়ে রাখছে।

গত এক দশকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বলতে গেলে সব ধরনের ছাপা পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ডিজিটাল সংস্করণ করা হয়েছে, যেখানে অনলাইন নিউজ পোর্টালের মতো সব সময় সংবাদ আপলোড করা হচ্ছে। মুঠোফোনের সহজলভ্যতায় মানুষও সেগুলো ব্রাউজ করছে। এসবের ভিড়ে সারা বিশ্বেই ছাপ পত্রিকাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

কিন্তু এসব ঝুঁকি মাথায় নিয়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর তিন থেকে চারটি করে ছাপা পত্রিকার আবির্ভাব ঘটছে। করপোরেট দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে থেকে ব্যবসায়িক ঢাল হিসেবে যত্রতত্র গণমাধ্যমকে ব্যবহার করার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশে সাংবাদিকতার পেশাদারি ও দায়বদ্ধতার অবনমন ঘটেছে। কোনো গণমাধ্যম নবজাতক অবস্থায়ই হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে সংখ্যায় বাড়লেও মানুষ এখনো আস্থার সংবাদমাধ্যম হিসেবে গুটি কয়েকের ওপরই নির্ভরশীল।

দুর্দান্ত এই পথচলায় প্রথম আলো আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে, জাতি গঠনে একটি সত্যিকার সংবাদপত্রের ভূমিকায় থেকেছে। অনেক নিপীড়িত মানুষের দেহ ও মনে শক্তি সঞ্চার করেছে, অনেক অদম্য মেধাবীর অন্বেষণ করেছে, যা সাংবাদিকতার বাইরে দেশ গঠনে একটি পত্রিকার বড় অবস্থান থাকা দরকার, তা অন্যদের পথ দেখিয়েছে। প্রথম আলো এই অবদান অক্ষুণ্ন রাখুক।

২৫ বছরের পথচলায় প্রথম আলো কেবল পাঠকদের সামনে সংবাদই পরিবেশন করেননি, বরং সামাজিক দায়বদ্ধতার চর্চাটাও অব্যাহত রেখেছে। ডজন ডজন সংবাদপত্রের ভিড়ে গ্রাম থেকে শহরে এখনো প্রথম আলোই এগিয়ে।

আমরা যাঁরা সংবাদপত্রে জড়িত ছিলাম, তাঁরা ঠিক কাছ থেকে প্রথম আলোর দীপ্তিমান শিখা অনুভব করতাম। প্রতিযোগিতার ভিড়ে ভুলভাল তথ্য আর গুজবের ডালপালায় মানুষ যখন দিশেহারা, তখন নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম হিসেবে বাজারে টিকে থাকার লড়াই যে কতটা চ্যালেঞ্জিং, তা সংবাদ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভালো বুঝতে পারবেন।

রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমের যে ভূমিকা থাকার কথা, সেটি যখন আমরা গত কয়েক দশকে হারিয়ে ফেলতে বসেছি, তখন দেশের যে কয়েকটি গণমাধ্যম স্বমহিমায় রাষ্ট্রটাকে গতিশীল রেখেছে, ভুলভ্রান্তি খুঁচিয়ে পথচলার সাহস জুগিয়ে ‘আলোকবর্তিকা’ হিসেবে এগিয়ে এসেছে, সেখানে প্রথম আলোর নাম জড়িয়ে থাকবে, আছে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আর এই কৃতিত্বের জন্য একমাত্র দাবিদার প্রথম আলোর পেশাদার সাংবাদিকতা।

বাংলাদেশ তো বটেই, আমার ধারণা, বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা লাখো বাংলাভাষী মানুষের জনপ্রিয় প্রথম আলোর দাপুটে এই পথচলার রয়েছে তাৎপর্য। তাই প্রথম আলোর ভূমিকা কেবল একটি গণমাধ্যম হিসেবেই দেখার সুযোগ নেই, বরং পত্রিকাটি পাঠক তৈরির পাশাপাশি সমালোচকও তৈরি করেছে, মানুষকে ভাবনার রসদ জুগিয়েছে।

একজন পাঠক ও সমালোচক হিসেবে যদি পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতির দিকে নজর দিই, তাহলে দেখা যাবে, গত ২৫ বছর পত্রিকাটি সব সময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর হিসেবে লড়েছে, দুর্নীতি, অপশাসন, দুরভিসন্ধি আর অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচনে নির্বিঘ্নে কাজ করে গিয়েছে। গণমানুষের কণ্ঠ ধারণ করে রাষ্ট্রকে সঠিক পথ বাতলে দিতে গণমাধ্যমের সাহসী ভূমিকার সঠিক পক্ষাবলম্বন করেছে প্রথম আলো।

প্রথম আলো যে সাংবাদিকতা করেছে, তা আমাদের অনেক গর্বের, অনেক প্রাপ্তিরও বটে। যদিও সব সময় ক্ষমতাসীন ‘ভয়ের কারণ’ হিসেবে থাকা প্রথম আলো জনগণের যে আস্থার জায়গা তৈরি করেছে, সেখানে প্রথম আলোর নৈতিক সম্পাদকীয় নীতি সব সময় প্রশংসনীয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আরও পড়ুন

হ্যাঁ, এ কথা সত্য, প্রথম আলো আজ থেকে এক দশক আগে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেই জায়গা থেকে কিছুটা হলেও সরে এসেছে। আমাদের মতো সাধারণ পাঠকেরা আগে যতটা না অনুসন্ধানমূলক সংবাদ পেতাম, তার সংখ্যা কমে গেছে, সাংবাদিকতার মানের সঙ্গে কিছুটা হলেও আপস করা হয়েছে, যা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। মূলত, ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীদের চাপিয়ে দেওয়া আইনে সমগ্র দেশেই বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পরিধি ছোট হয়ে এসেছে।

সাংবাদিক নির্যাতনের মাত্রা যেমন বেড়ে গেছে, তেমনি তাঁদের হত্যা করার বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। ফলে বাক্‌স্বাধীনতার নির্ভরযোগ্য এই স্তম্ভ কার্যত ‘অবাধ তথ্যপ্রবাহের’ প্রতিশ্রুতি ক্ষয়িষ্ণু।

সারা বিশ্বেই গণমাধ্যমগুলো আজ আর মুক্ত নয়। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী, সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় কিংবা জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ গণমাধ্যমগুলো নিরপেক্ষতার মানদণ্ডে নিজেদের আপস করে চলছে। বাজারে টিকে থাকার লড়াইয়ে নিজেদের সীমাবদ্ধতা তৈরি করে সংবাদপত্র শাসকগোষ্ঠীগুলোরই স্তুতি গাইছে; যদিও শাসকেরা মনে করেন, দেশের গণমাধ্যম হবে তাঁদের জনসংযোগ দপ্তর আর সংবাদপত্রের খবর হবে ‘স্তুতিময়’।

এমন জায়গায় আমাদের দেশেও গণমাধ্যমগুলো আটকে গিয়েছে। সেই জায়গায় প্রথম আলো যে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে, বিরোধী শিবিরে মতামতও তুলে ধরছে, সেখানে সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারালেও জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। আর সেটিই প্রথম আলোর বড় শক্তি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে আপস করতে হয়—এমন কোনো সংবাদ আমরা গত ২৫ বছরে প্রথম আলোর কাছ থেকে পাইনি। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাতিকে জাগানোর ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলা এই পত্রিকা চলতে গিয়ে পা পিছলে পড়েনি, তা নয়। পড়েছে, বেশ কয়েকবারই পড়েছে। তারাও সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে অনেক সময় লেজেগোবরে করে ফেলে। আবার অনেক সময় একপেশে সংবাদও পরিবেশন করে, যা পাঠকদের কাছে বিরক্তিকর।

প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় দাবি করে এসেছে, তারা ব্যক্তির একাডেমিক কিংবা রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে থাকা নামই প্রকাশ করার নীতি গ্রহণ করেছে এবং সে কারণে তারা ডাকনাম বাদ দেওয়ার নীতি নিয়েছে। তবে একজন ব্যক্তি একাডেমিক নামে যতটা পরিচিত হোন, আর ডাকনামে হয়তো অনেক বেশি পরিচিত, সেটি জানা আবশ্যিক। প্রথম আলো কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি নিয়ে ভাবার অনুরোধ জানাই। অন্যদিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি প্রথম আলোর  ‘বিনোদন’ বিভাগকে ক্লিকবাইটের মোহ ত্যাগ করার দিকে নজর দিতে হবে।

আরও পড়ুন

প্রথম আলো শেষ পাতায় প্রতিদিনই সংস্কৃতি, প্রকৃতি আর ঐতিহ্য নিয়ে একটি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। নিঃসন্দেহে এটি ভালো দিক। দেশ ও প্রকৃতি বিষয়ে জানা যেমন মানুষকে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে, তেমনি নৈসর্গিক পাঠকও তৈরি করে। তবে আমার একটু অনুরোধ থাকবে, ‘বিজ্ঞান-গবেষণা’ নিয়ে প্রতিবেদন আমরা সেখানে সপ্তাহে অন্তত একটিবার যেন দেখতে পাই। দেশের মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করতে এ ধরনের প্রতিবেদন হয়তো সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ‘পড়ালেখা’ নামে যে এক পৃষ্ঠার খবর ছাপানো হয়, তার বিপক্ষে আমি। পত্রিকা কেবলই তথ্যপ্রবাহের উৎস হওয়া উচিত। স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে ছাপানো এই বিভাগ অনেক সময় অসাড়।

ভিনদেশের পত্রিকায় আমরা এগুলো দেখতে পাই না। কারণ, পত্রিকা পড়বে শিক্ষার্থীরা কেবল দেশ-বিদেশ সম্পর্কে জানার জন্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে জানার জন্য। কিন্তু পত্রিকা পড়ার টেবিলের মতো পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ধরিয়ে দেওয়া সমীচীন নয়। কারণ, পত্রিকা পড়তে এসে শিক্ষার্থীরা যদি পাঠ্যপুস্তকের স্বাদ পেয়ে বসে, তাহলে সে অন্যান্য খবরের সার্থকতা খুঁজে পায় না। বিশ্বাস করি, দেশের গণমাধ্যমগুলো এই পাতার প্রয়োজনীয়তা পুনর্বিবেচনা করবে।

প্রথম আলো সমাজের দুর্বল ও ভুক্তভোগীদের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রথম আলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে কথা বলে। দুর্বলদের পক্ষে কথা বলায় সবলেরা প্রথম আলোকে ভয় পেয়ে আসছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করায় স্বাধীনতাবিরোধীরা আস্ফালন করেছে, বিরোধী দলের কণ্ঠস্বর তুলে ধরায় ক্ষমতাসীনদের চক্ষুশূল হয়েছে। আর এটিই একটি পত্রিকার জোরালো অবস্থান হওয়া উচিত, যা প্রথম আলো করে আসছে।

দুর্দান্ত এই পথচলায় প্রথম আলো আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে, জাতি গঠনে একটি সত্যিকার সংবাদপত্রের ভূমিকায় থেকেছে। অনেক নিপীড়িত মানুষের দেহ ও মনে শক্তি সঞ্চার করেছে, অনেক অদম্য মেধাবীর অন্বেষণ করেছে, যা সাংবাদিকতার বাইরে দেশ গঠনে একটি পত্রিকার বড় অবস্থান থাকা দরকার, তা অন্যদের পথ দেখিয়েছে। প্রথম আলো এই অবদান অক্ষুণ্ন রাখুক।

প্রথম আলোসহ দেশের গণমাধ্যমগুলোর নির্ভীক পথচলার ওপর যে খড়্গ, তা উঠে যাক। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় প্রথম আলোর আগামীর পথচলা অব্যাহত হোক—এ প্রত্যাশা করি। একজন একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে, রজতজয়ন্তীতে প্রথম আলোর প্রত্যেক কর্মীর প্রতি শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা রইল।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: [email protected]