টাকা হলে বাঘের দুধও মেলে, ট্রেনের টিকিট তো তুচ্ছ

কয় মাস ধরে একমাত্র কন্যাকে নিয়ে ময়মনসিংহ-ঢাকা বা ঢাকা-ময়মনসিংহ ঘন ঘন যাতায়াত করতে হচ্ছে। কন্যার বাসভ্রমণে নানাবিধ সমস্যা—বমি হয়, মাথা ঘোরে। সে সমস্যা এড়ানোর জন্য রেলকেই ভেবেছিলাম ভরসাস্থল। কিন্তু রেল থেকে না মিলছে ‘ভরসা’, না মিলছে ‘স্থল’-এর হদিস।

প্রবাদ আছে—পাশাপাশি বাড়ি থাকলে প্রতিবেশী চেনা যায়, বিপদে পড়লে বন্ধু চেনা যায়, টাকার লেনদেনে চেনা যায় মানুষ। অর্থাৎ, ‘মানুষ’ বা ‘তত্ত্ব’ বোঝার জন্য বিশেষ কোনো ঘটনা বা অনুষঙ্গের প্রয়োজন হয়। যেমন কয়েক মাস ধরে নিয়মিত রেলভ্রমণের ফলে রেলব্যবস্থার স্বরূপ সম্পর্কে আমি বিশেষ জ্ঞান লাভ করেছি। তবে ওই বিশেষ জ্ঞান মানে ‘বিজ্ঞান’ নয়। যেমন ‘বিশেষজ্ঞ’-এর অর্থ নয় ‘বিশেষভাবে অজ্ঞ’।

আমি রবীন্দ্রভক্ত মানুষ। কোনো কিছু শুরুর আগে তাঁর ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের একটা উক্তিকে স্মরণে রাখি। উক্তিটি হলো— ‘আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে। সন্ধ্যাবেলায় দীপ জ্বালার আগে সকালবেলায় সলতে পাকানো।’ কিন্তু হায় রবীন্দ্রনাথ, আপনি ‘সন্ধ্যাদীপের সলতে সকালে পাকাতে’ বলেছেন। কিন্তু আমি এক দিন, দুই দিন—এমনকি তিন-চার দিন আগেও সলতে পাকিয়ে প্রদীপ জ্বালাতে ব্যর্থ হচ্ছি; বারবার, বহুবার।

আমি নিশ্চিত, এ ব্যর্থতার পেছনে আমার কোনো দায় বা দোষ নেই। দোষ নেই সলতে কিংবা প্রদীপেরও; তা হলে কার দোষ? দোষ বোধ হয় আমার কপালের। ঘটনাটা তাহলে খুলেই বলি—

১৭ ডিসেম্বর, শনিবার, সকাল; কন্যাকে নিয়ে ঢাকা যাওয়ার দিনক্ষণ স্থির করেছিলাম। বরাবরের মতো এবারও রেলপথের দিকেই ঝুঁকলাম। যাত্রার বেশ কয়েক দিন আগেই (১৩ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার) ‘অনলাইন টিকিট’ ক্রয়ে নেমে পড়লাম। প্রথম তল্লাশি চালালাম ‘হাওর এক্সপ্রেস’-এ (মোহনগঞ্জ টু ঢাকা)। না, ময়মনসিংহ-ঢাকার কোনো টিকিট নেই; না অনলাইনে, না কাউন্টারে। টাকার চিন্তা না করে একটু পিছিয়ে গেলাম; নেত্রকোনা-ঢাকার টিকিটের অবস্থা জানতে সচেষ্ট হলাম। দেখলাম অনলাইন টিকিট নেই; তবে কাউন্টারে দুটি এসি এবং চারটি শোভন টিকিট অবিক্রীত আছে। এবার আরও একটু পিছালাম; মোহনগঞ্জ-ঢাকার টিকিট খোঁজ করলাম। কিন্তু হা হতোস্মি, টিকিট নেই, নেই।

এবার বিকল্প রাস্তা ধরে পা বাড়ালাম। ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেসের জামালপুর-ঢাকার টিকিট পেতে ব্যর্থ হওয়ার পর দেওয়ানগঞ্জ-ঢাকা ধরে খোঁজ নিলাম। পথ ভিন্ন হলেও ফলাফল কিন্তু ভিন্ন হলো না। সবখানে এক বার্তা, কাউন্টারে দু–চারটা টিকিট আছে বটে, কিন্তু অনলাইন—একবারেই শূন্য।

হঠাৎ মনে পড়ল, কিছুক্ষণ আগে অনলাইনে দেখেছিলাম নেত্রকোনা কাউন্টারে ছয়টা টিকিট অবিক্রীত। চটজলদি একজন শুভাকাঙ্ক্ষীকে ফোন করে নেত্রকোনা স্টেশন কাউন্টারে পাঠালাম। খোঁজ নিয়ে তিনি জানালেন, ‘না, কোনো টিকিট নেই।’ আমি শুভাকাঙ্ক্ষীর ফোন মারফত স্টেশনে কর্মরত ভদ্রলোকটিকে বললাম, ‘এখনো অনলাইনে দেখাচ্ছে, কাউন্টারে এসির দুটি এবং শোভনের দুটি টিকিট অবিক্রীত আছে।’ ভদ্রলোক ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘আপনার কী মনে হয়, আমি মিথ্যে কথা বলছি?’

তিনি মিথ্যা বলছেন কি না, এর উত্তর যখন আমার কাছেই জানতে চাইলেন, তখন তাঁকে ‘সত্যবাদী যুধিষ্ঠির’ হিসেবে প্রতিপন্ন করা আমার ‘অবশ্যকর্তব্য’ হয়ে দাঁড়াল। আমি তা-ই করলাম এবং ‘ট্রেনের টিকিট’ কেনার আশা বরাবরের মতো এবারও পরিত্যাগ করতে বাধ্য হলাম।

২.

আমাদের দেশে এমন অনেক নিন্দুক আছে, যারা প্রায়ই বলে, বাঙালি স্বার্থপর এবং আত্মকেন্দ্রিক জাতি। নিজের লাভ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না; অন্যের বিপদে এগিয়ে আসে না তারা। বস্তুত, নিন্দুকদের কথা যে সত্য নয়, এর প্রমাণ পেলাম এক দিন পরই।

বুধবার বিকেলে নেত্রকোনা থেকে ফোন এল। একজন শুভাকাঙ্ক্ষী বললেন, ‘শুনেছি আপনি নাকি শনিবারের হাওর এক্সপ্রেসের দুটি টিকিট খুঁজছিলেন। আমি টিকিট ম্যানেজ করতে পারব। তবে বাজারমূল্যের চেয়ে টাকা বেশ বেশি লাগবে।’

আরও পড়ুন

কীভাবে ম্যানেজ হবে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘সে কথা নাই-বা বললাম। আপনার টিকিট চাই কিনা বলুন?’ ‘না, টিকিট চাই না’, আমার কণ্ঠে এ কথা উচ্চারিত হতেই ওই প্রান্ত থেকে অন্য একজনের চড়া গলা ভেসে এল (খুব সম্ভবত তিনিই টিকিট বিক্রয়কারী), ‘এ জন্যই বলি, যেচে উপকার করতে নেই।’

কিছুক্ষণ পর আবার ওই শুভাকাঙ্ক্ষীর ফোন। তিনি যা বললেন এর সারাংশ হলো—অনলাইন বা কাউন্টারে ট্রেনের টিকিট কমই পাওয়া যায়। এটা পাওয়া যায় চা-পানের দোকানে, ‘অমুক’ ‘অমুক’ ভাইয়ের কাছে। তারা ক্রেতার ঢাকা যাওয়ার আগ্রহ ও প্রয়োজনের গুরুত্ব অনুভব করে টিকিটের দাম হাঁকে। মাঝেমধ্যে তারা কেনা দামের চেয়ে তিন-চার গুণ দামেও টিকিট বিক্রি করে থাকে।

৩.

সন্ধ্যের আড্ডায় ‘ট্রেনের টিকিট’-এর প্রসঙ্গটি আলোচনায় এল। স্মার্ট ও বাস্তববাদী এক বন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘ময়মনসিংহ টু ঢাকা কয়টি টিকিট চাই আপনার?’

আমি সবিস্ময় বললাম, ‘মানে!’
তিনি বললেন, ‘আপনি চাইলে টিকিট এক্ষুনি ম্যানেজ করে দেব। আগ্রহ থাকলে বলুন; আর কৌতূহল থাকলে চলুন আমার সঙ্গে।’

আমি তার সঙ্গে রাস্তায় নামলাম। টিকিট কেনার জন্য নয়, কৌতূহল মেটানোর জন্য। নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার পর দুষ্প্রাপ্য টিকিটের সহজলভ্য রূপ দেখতে পেলাম। অবশ্য দাম খুব চড়া, দ্বিগুণ-তিন গুণ।

ফেরার পথে বন্ধুটিকে বললাম, ‘এ রকম অনাচার দিনের পর দিন কী করে ঘটে চলেছে?’

বন্ধুটি যে জবাব দিল, এর সারাংশ এ রকম: আন্তনগর ট্রেনে মোহনগঞ্জ-বারহাট্টা-নেত্রকোনা টু ময়মনসিংহ আসনসংখ্যা নির্দিষ্ট করা আছে। ওই যাত্রীরা তাঁদের গন্তব্যে (ময়মনসিংহ) নেমে যাওয়ার পর ওই আসনগুলোই আবার ময়মনসিংহ-ঢাকা হিসেবে বিক্রি করা হয়। বস্তুত এ বিক্রি প্রক্রিয়া অনলাইনে চলে না, কাউন্টার থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। বস্তুত এ প্রক্রিয়াতে কেষ্ট-বিষ্টুদের প্রবেশাধিকার সীমিত। সেখানে যাতায়াত কেবল রাঘববোয়ালদের। তারাই বেশির ভাগ টিকিট নিজেদের কবজাতে নিয়ে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে তা কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করে।

বন্ধুটির কথা শোনার পর আমার মুখ ও মন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল।

৪.

বিদ্যমান বিধি অনুযায়ী, যাত্রার তারিখের চার দিন আগে অনলাইন বা নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে টিকিট বিক্রির কার্যক্রম শুরু করা হয়। বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া গড় সাধারণ মানুষ যাত্রার তিন-চার দিন আগে টিকিট ক্রয়ের কথা চিন্তাও করে না। কিন্তু যারা টিকিট-ব্যবসা করে, সেই অসাধু চক্রটি ফাঁকা মাঠে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে থাকে। অনলাইন এবং কাউন্টার দুই জায়গাতেই বারবার হানা দেয়। বুদ্ধি ও কৌশলের জোরে তারা বেশির ভাগ টিকিটই হাতিয়ে নেয়। ক্রয়কৃত টিকিট এরপর তারা ছড়িয়ে দেওয়া নির্দিষ্ট স্থানে স্থানে। বস্তুত রেলের স্থানীয় পর্যায়ের সহায়তা-ব্যতীত এমন কর্মকাণ্ড চালানো যায় কি না, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে।

কালোবাজারিদের কাছ থেকে এসব টিকিট কারা কেনে? এর উত্তর—টাকাওয়ালা লোকজন। তারা বাড়তি টাকা দিয়ে অনায়াসে টিকিট কেনার মধ্যে নিজেদের ক্ষমতার প্রতীকী চিত্র খুঁজে পান। তারা বিশ্বাস করেন, ‘টাকা হলে বাঘের দুধও মেলে, ট্রেনের টিকিট তো তুচ্ছ জিনিসমাত্র।’

আমাদের সমাজ মানসের গঠন এমনই যে এখানে কালোবাজারির প্রতি বিরূপতা বা ঘৃণা প্রকাশ করা হলেও, যারা ওই ব্যবসা সফলতার সক্রিয় অংশীদার, সেই টাকাওয়ালা টিকিটক্রেতার প্রতি কেউ-ই কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন না। বরং তাদের ‘অঘটন-ঘটনপটীয়সী’ বা ‘সকল কাজের কাজি’ হিসেবে সমীহ করা হয়।

রাষ্ট্র মানে তো কেবল সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা বিশেষ পদমর্যাদাধারী কোনো সংঘ বা পেশার লোকজন নয়। জনগণই মূলত রাষ্ট্রের মূল প্রপঞ্চ বা ‘হৃৎপিণ্ড’। তাই জনসচেতনতা ছাড়া অপরাধ বা দুর্নীতিরোধ করার উপায় নেই।

কালোবাজারির কাছ থেকে রেলের টিকিট কেনা একধরনের অপরাধ, এ অপকর্ম থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে, জনমনে এ বোধ জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত এ তমসা যুগের অবসান ঘটবে না। প্রশ্ন হলো, সেই আলোকিত দিন আদৌ আসবে কি? সত্যি সত্যিই আসবে?

  • বিধান মিত্র নেত্রকোনা সরকারি কলেজের অধ্যাপক