এই চোর ধরা পড়বে বলে বিশ্বাস করেন কি

১.

কল্যাণপুর ৫ নম্বর রোড থেকে দুই যাত্রী নিয়ে তাঁদের কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়েছিলেন রিকশাচালক মানিক মোল্যা। যাত্রীরা নেমে চলে যাওয়ার পর মানিক দেখলেন, রিকশায় একটি ব্যাগ। ব্যাগ খুলে দেখলেন, তার মধ্যে বেশ কিছু সোনার গয়না।

মানিক গরিব মানুষ। গয়না দেখে চেপে গেলেন। বাসায় ফিরে দেখলেন ভরি চারেক সোনা আছে। তিনি গয়নার খানিকটা দিলেন বউকে, খানিকটা দিলেন ভাই ইবাদতকে, আর খানিকটা উপহার দিতে চাইলেন শাশুড়িকে। শাশুড়ি থাকেন মাগুরায়। মানিক গয়না নিয়ে মাগুরায় গেলেন। শাশুড়ির হাতে ‘জামাই আদর’ পাওয়ার আগেই সেখানে পুলিশ গিয়ে হাজির। তাঁরা সেখান থেকে মানিককে ধরে সোজা হাজতে ভরে জামাই আদর দেওয়া শুরু করলেন।

মানিক পরিত্যক্ত ব্যাগে থাকা এই সোনা ‘চুরি’ করেছিলেন ৩০ আগস্ট। সোনার মালিক পুলিশের কাছে ওই দিনই জানানোর পর পুলিশ এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করল। তারা দ্রুত মানিককে চিহ্নিত করে ফেলল।

এরপর গত ২ সেপ্টেম্বর শনিবার মানিক আর মানিকের ভাই ইবাদতকে তারা ধরে ফেলল। তারা চুরি যাওয়া সোনা উদ্ধারও করে ফেলল।

প্রথম আলোতে ভেতরের পাতায় খুব ছোট করে ছাপা হওয়া এই খবর পড়ার পর যে কেউ বুঝতে পারবেন, ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় রিকশায় ফেলে যাওয়া গয়না মাগুরা থেকে কয়েক দিনের মধ্যে যে পুলিশ সদস্যরা উদ্ধার করেছেন, তাঁরা কতটা চৌকস।
রিকশাওয়ালা মানিক ও তাঁর ভাই ইবাদত গরিব ও অশিক্ষিত রিকশাওয়ালা। এখন তারা চুরির দায়ে হাজতে। তাঁদের পরিচয় এখন চোর। ধারণা করি, চোর হিসেবে এতক্ষণে তাঁদের ‘বাঁশ ডলা’ দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।

আরও পড়ুন

২.

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের শুল্ক বিভাগের গুদাম যাঁরা পাহারা দেন, তাদের একজন ২ সেপ্টেম্বর শনিবার চেঁচিয়ে উঠলেন। তাঁর চেঁচামেচিতে আশপাশের সবাই ছুটে এল। দেখা গেল গুদামের মধ্যে সোনার যে লকারটি আছে, সেটি ভাঙা। কর্মকর্তারা এলেন। লকার তল্লাশি করলেন। পরে তাঁদের বরাতে আমরা জানলাম, ঘটনা তেমন কিছু না; লকার থেকে মাত্র ৫৫ কেজির কিছু বেশি সোনা চুরি হয়ে গেছে। এই সোনার দাম মাত্র ৪৭ কোটি টাকার মতো।

এই ঘটনা শনিবারের হলেও জানাজানি হয়েছে পরদিন রোববার। বিমানবন্দরের লকারের মতো একটা সুরক্ষিত জায়গা থেকে কীভাবে ৫৫ কেজির বেশি সোনা চুরি হলো তা নিয়ে দু-একজন একটু আধটু বিস্ময় প্রকাশ করলেও বেশির ভাগ মানুষ এ নিয়ে খুব একটা গা করছেন বলে মনে হচ্ছে না।

চুরিবিদ্যা যে মহাবিদ্যা-সে কথা সম্ভবত প্রথম ধরতে পেরেছিল প্রাচীন গ্রিস। শোনা যায়, সেখানকার স্পার্টা নগরে কেউ চুরি করে ধরা পড়লে তার সাজা হতো। কিন্তু সেই সাজা চুরির জন্য হতো না, হতো ধরা পড়ার মতো বোকামির জন্য। আমাদের লেখাপড়া জানা বয়স্ক চোরগুলো মনে হচ্ছে, দেশকে ধীরে ধীরে সেই স্পার্টার কথিত আইনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

কে বা কারা এই সোনা সরাল, তা বের করতে শুল্ক বিভাগ একজন যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি যে চোর ধরবে এবং চুরি যাওয়া সোনা বের করে ছাড়বে, তা বিশ্বাস করেন, এমন লোক আশপাশে পাচ্ছি না।

শুল্ক বিভাগ বলছে, এসব সোনা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয়েছে। এত দিন এত সোনা বিমানবন্দরের গুদামে রাখার কথা না। এগুলো অনেক আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যায়নি। কেন যায়নি তার জবাব হয় খুঁজে নিতে হবে, নয় ‘বুঝে’ নিতে হবে।  

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, এক দিনে নয়, বিভিন্ন সময়ে এই লকার থেকে সোনা সরানো হয়েছে। আন্দাজ করি, যাঁরা সরিয়েছেন, তারা কল্যাণপুরের মানিক মোল্যার মতো অশিক্ষিত ও গরিব রিকশাওয়ালা না। এই ধরনের সুপার সেনসিটিভ জায়গায় যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা শিক্ষিত। টাইপ করা ভাষায় কথা বলেন। সরকার তাঁদের মোটা টাকা মাইনে দেয়।

আরও পড়ুন

প্রতি বছর বাবা দিবসে তাঁদের ছেলে মেয়েরা ‘আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৎ মানুষ’ বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে থাকে। সমস্যা হলো, তাঁরা চোর। তাঁরা গরিব রিকশাওয়ালা মানিক মোল্যার চেয়ে খারাপ চোর। তবে তাঁদের জন্য সুবিধার বিষয় হলো, তাঁদের কেউ সরাসরি চোর বলে না।  

ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনারের বরাতে জানা যাচ্ছে, কয়েক দিন আগে আগে গুদামটিতে অটোমেশনের কাজ শুরু হয়। এ কাজের অংশ হিসেবে গুদামের সোনা গোনার কাজ শুরু হয়েছে। ওই কর্মকর্তার ধারণা, সোনা অনেক আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এখন সোনা গোনার কাজ শুরু হওয়ায় সেটা ধরা পড়বে; তাই লকার ভাঙার একটা ‘নাটক’ তৈরি করা হয়েছে।

বিমানবন্দরের ভেতরের গুদাম কল্যাণপুরের ফাঁকা রাস্তার মতো উদোম জায়গা না। সেখানকার সব জায়গা সিসি ক্যামেরায় নজরদারির আওতায় থাকে। সেখানে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ কয়েকটি সংস্থা কাজ করে। এর মধ্যে সকাল বেলা একজন গুদামকর্মী ‘আল্লাহ রে! সব চুরি হয়ে গেছে রে!’ বলে মুদি দোকানের ভাঙা বাক্স দেখানোর স্টাইলে ভাঙা লকার দেখিয়ে দিয়েছেন—এ বড় বিনোদনের কথা।

দীর্ঘদিনের চর্চা ও অভিজ্ঞতা আমলে নিয়ে অনেকেই বলছেন, যেহেতু ঘরের মধ্যে হাজারো সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারির মধ্যে ৫৫ কেজি সোনা চুরি হয়ে গেছে; যেহেতু সেখানে দায়িত্বরত লোকজনকে তাৎক্ষণিকভাবে কোমরে দড়ি দিয়ে জেরা করার কোনো খবর এখনো পাওয়া যাচ্ছে না; যেহেতু ঘটনা তদন্তে সেই মুখস্থ কায়দায় একজন যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ‘কমিটি’ গঠন করা হয়েছে; সেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে এই সোনার ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।

৩.

চুরিবিদ্যা যে মহাবিদ্যা-সে কথা সম্ভবত প্রথম ধরতে পেরেছিল প্রাচীন গ্রিস। শোনা যায়, সেখানকার স্পার্টা নগরে কেউ চুরি করে ধরা পড়লে তার সাজা হতো। কিন্তু সেই সাজা চুরির জন্য হতো না, হতো ধরা পড়ার মতো বোকামির জন্য। আমাদের লেখাপড়া জানা বয়স্ক চোরগুলো মনে হচ্ছে, দেশকে ধীরে ধীরে সেই স্পার্টার কথিত আইনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

এখন আইন দিয়ে যেহেতু এই চোরদের ধরা যাচ্ছে না, সেহেতু সামাজিকভাবে তাদের সাজা দেওয়াটা জরুরি। সিঁধকাটার মতো বিলীয়মান হস্তশিল্পে সিদ্ধহস্ত সিঁধেল শিল্পীকে মনোজ বসু যতই আহ্লাদ করে ‘নিশিকুটুম্ব’ বলুন, লোকাল বাংলায় তাকে বলে ‘চোর’।

বিমানবন্দরের ৫৫ কেজি সোনা চুরি করা লোকেরা যত বড় শিক্ষিত হোক আর যতই স্যুট কোট টাই পরা থাক, তারা আসলে চোর। তারা ছ্যাঁচড়া চোর। এ কথাটা জনসমক্ষে তাদের মুখের ওপর বলাটা জরুরি।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।

    ই–মেইল: [email protected]