চীন-মার্কিন ঝগড়া বিশ্বব্যবস্থাকে যেভাবে বদলে দেবে

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন সম্প্রতি চীন সফর করেনছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট এল ইয়েলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনসহ অন্য মার্কিন কর্মকর্তারা বেশ কয়েক দফায় চীন সফর করার পরও যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনা রয়ে গেছে। অধিকাংশ অমীমাংসিত বিষয়ে উভয় পক্ষের দ্বিমত থাকতেই পারে, কিন্তু সংলাপ চালিয়ে যাওয়া ভূরাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশ।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ওপরের সারির রাজনীতিবিদদের তাইওয়ান সফর এবং যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ থেকে চীনা গোয়েন্দা বেলুন ভূপাতিত করার ঘটনার পর দুই দেশের মধ্যে যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছিল, তা কূটনীতির ক্ষেত্রে বিপজ্জনক অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছিল।

কারণ, যখন দুটি বিবদমান পক্ষ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা বন্ধ করে দেয়, তখন সংঘাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কিন্তু ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে এসে সম্পর্কের গভীর চিড় সারাইয়ের ক্ষেত্রে সংলাপের অক্ষমতা প্রমাণিত হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে দুই দেশের অবস্থান, জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে তাদের মধ্যকার উদ্বেগ ও বাণিজ্য উত্তেজনার কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থার কারণে এই প্রধান পরাশক্তি দুটির সংঘাত চলতে থাকবে বলে মনে হচ্ছে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মুখ দেখাদেখি বন্ধের কারণে বিভিন্ন বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান, ফোরাম ও সংস্থা বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। এর জেরে আঞ্চলিক জোটের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। এই বসন্তে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বৈঠকে কিছু দুর্বলতা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। বৈঠক শেষে সাধারণত বিবৃতি জারি করা হয়। কিন্তু এবারের বৈঠক শেষে ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল কমিটি তা জারি করেনি।

ইতিমধ্যে জি-২০ আগের চেয়ে আরও বেশি বিভক্ত হয়েছে এবং সংগঠনটির কার্যকারিতা আরও কমে গেছে। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বৈশ্বিক মহামন্দার পর জি-২০ যেভাবে দ্রুতগতিতে একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে মাঠে নেমেছিল, এখনকার মন্দাবস্থা মোকাবিলা ও সাধারণ লক্ষ্য অর্জনে তাদের মধ্যে সে ধরনের তাগিদ দেখা যাচ্ছে না।

হ্যাঁ, এটি ঠিক যে জি-২০ এখনো বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন করছে এবং প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞরা কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনও করেছেন। কিন্তু ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার পর গ্রুপটিতে যে ফাটল দেখা দিয়েছিল, পরবর্তী সময় সে ফাটল আরও গভীর হয়েছে। ফলস্বরূপ জি-২০-কে এখন আর বিশ্বকূটনীতির প্রধান ফোরাম বলা যাচ্ছে না।

চীনের এই ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা স্পষ্টতই অকার্যকর ও বেশ পিছিয়ে থাকা পদক্ষেপ। জি-৭-কে আবার জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তেমন হেলদোল নেই।

আর এর ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব–প্রতিপত্তিকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে চীনের উদ্যোগে দাঁড় করানো ব্রিকস প্লাস সংগঠনটি আরও শক্তিধর হয়ে উঠেছে। এটি এখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এটি এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করছে, যেখানে একটি উদীয়মান শক্তি আন্তর্জাতিক আধিপত্যকে স্থানচ্যুত করার হুমকি দিয়ে বিবদমান শক্তিগুলোকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

প্রথমে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে ব্রিকস গঠিত হলেও চীনের উদ্যোগে এই গ্রুপে এখন মিসর, ইথিওপিয়া, সৌদি আরব, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে যুক্ত করা হয়েছে।

এর মাধ্যমে চীন মূলত বৈশ্বিক দক্ষিণে এমন একটি বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, যা পশ্চিমাদের বিশ্বব্যবস্থাকে মোকাবিলা করতে সক্ষম একটি ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে।

২০২৪ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, ব্রিকস প্লাসের দেশগুলোর হাতে বিশ্বব্যাপী জিডিপির ৩৬ শতাংশের মালিকানা আছে। তাদের জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ।

আরও পড়ুন

ইউরোপীয়দের নেতৃত্বাধীন আইএমএফ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সামর্থ্য অর্জনের লক্ষ্যে চীন যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এটিকে তারই অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। চীন বৈশ্বিক দক্ষিণকে এক করে নিজের নেতৃত্বে নিতে পারবে কি না, তা এখনই বলা যাবে না। আমেরিকা নিশ্চিতভাবেই তেমনটা আশা করে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো অন্যরা ব্রিকস প্লাসকে একটি নতুন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছে।

চীনের এই ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা স্পষ্টতই অকার্যকর ও বেশ পিছিয়ে থাকা পদক্ষেপ। জি-৭-কে আবার জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তেমন হেলদোল নেই।

ফলে এই গ্রুপের পক্ষে উদীয়মান অথচ শক্তিশালী ব্রিকস প্লাসকে ঠেকানো কঠিন হবে। আর ব্রিকস প্লাসের দুর্দমনীয় গতি বৈশ্বিক দক্ষিণকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে, যা পশ্চিমা ব্যবস্থার যথার্থ বিকল্প শক্তি হয়ে উঠবে। আর সেটি হলে গোটা বিশ্বব্যবস্থারই খোল নলচে বদলে যাবে।

  • উইলিয়াম আর রোডস ব্যাংকার টু দ্য ওয়ার্ল্ড: লিডারশিপ লেসনস ফ্রম দ্য ফ্রন্ট লাইনস অব গ্লোবাল ফাইন্যান্স বইয়ের লেখক এবং

  • স্টুয়ার্ট পি এম ম্যাকিন্টোশ গ্রুপ অব থার্টির নির্বাহী পরিচালক

    স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত