প্রথম আলো কি বানোয়াট প্রতিবেদন করেছে

প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসের মুক্তি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে মানববন্ধন
ছবি : প্রথম আলো

১ ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের টাইমস পত্রিকা তাদের ওয়েবসাইটে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা দেখিয়েছে, একটা এনার্জি কোম্পানির ভাড়া করা প্রতিষ্ঠান জ্বালানি বিল আদায় করার জন্য মানুষের ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকছে। অমানবিক আচরণ করছে। এই রিপোর্ট করার জন্য রিপোর্টারকে সেই অর্থ আদায়কারী প্রতিষ্ঠানে নিজের পরিচয় লুকিয়ে চাকরি নিতে হয়েছিল।

রিপোর্টটি প্রকাশের পর সরকার থেকে শুরু করে আদালত, সবাই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। অর্থ আদায় করাটা যুক্তরাজ্যে অবৈধ কিছু নয়। কিন্তু মানবিকতা তার চেয়েও বড়। তাই আদালতকে পর্যন্ত মানবিক দিক বিবেচনায় জ্বালানি সংকটের সময় এসব অর্থঋণ আদায়কারী কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিতে হয়েছে। এমনকি আদালত এ–সংক্রান্ত কোনো আদেশ আপাতত আর ইস্যু করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

যুক্তরাজ্যের মতো দেশে মানুষের অর্থকষ্ট, কিংবা জ্বালানি ব্যবহারে আর্থিক অক্ষমতা, এসব কি গোপন কোনো বিষয়? না, মোটেও নয়। সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অনেক প্রতিষ্ঠান আছে এসব দেখভালের। কিন্তু তাদের কোনো পদক্ষেপই সাধারণের কষ্ট কমাচ্ছিল না। তাই সাধারণ মানুষের দুঃখ–দুর্দশার চিত্র তুলে আনতে হয়েছে একজন সাংবাদিককে।

ঘটনা এখানেই থামেনি। রাষ্ট্রের স্বায়ত্তশাসিত এক প্রতিষ্ঠান সেই দ্য টাইমসকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে। আইনের হুমকি দিয়েছে। জেল খাটাবে বলেছে। সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমকে নির্দেশ দিয়েছে ওই রিপোর্ট–সংক্রান্ত সব তথ্য তাদের সঙ্গে শেয়ার করতে। দ্য টাইমস সাফ না বলে দিয়েছে। তারা বলেছে, কোনো আইন বা নীতিতে তারা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে তথ্য সরবরাহ করবে না। এই পর্যন্ত পড়ে মনে হতে পারে ঘটনা বাংলাদেশের। কিন্তু না, এটা সভ্য দেশ যুক্তরাজ্যেই ঘটেছে। তবে এর পরের ঘটনাগুলো আর আমাদের দেশের সঙ্গে মেলে না।

যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্রের সেই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এটা গণতন্ত্রের ওপর আঘাত। সেই প্রতিষ্ঠানকেও তাদের অবস্থান বদলাতে হয়েছে।

আপনি হয়তো বলবেন যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আমাদের তুলনা কেন? কারণ, দেশের নাম এখনো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকরা নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবি করেন। আমাদের মন্ত্রীরা প্রায়ই বিভিন্ন উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করেন। কিছুদিন আগে তো পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে গণতন্ত্র বিষয়ে ছবক পর্যন্ত দিলেন।

আমার মন্ত্রীদের ছবক দেওয়া নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তাঁরা যে আমাদেরসহ বিদেশিদের ছবক দেন, কিসের ওপর ভিত্তি দেন? তাঁদের জ্ঞান, ছবক এবং তথ্যের উৎস কী?

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, রোজায় জিনিসপত্রের দাম বাড়েনি। তিনি এই তথ্য কিসের ভিত্তিতে মানুষজনকে দিলেন? তাঁর তথ্যের উৎস কী?

প্রথম আলোর বিরুদ্ধে যা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তার পুরো প্রক্রিয়াটাই রাজনৈতিক। তাই এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চাই, স্টিভেন ডি লেভিট এবং স্টিফেন জে ডুবনার তাঁদের ‘থিংক লাইক আ ফ্রিক’ বইয়ে বলেছেন : রাজনীতিকরা যখনই ভুল-শুদ্ধর মানদণ্ডে বিচার করে কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তখন প্রথমেই যাকে হত্যা করা হয়, তার নাম সত্য।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত যেকোনো তথ্যের সূত্র তো মোটামুটি যাচাই করা যায়। কিন্তু সরকার যে আমাদের তথ্য দেয়, তা আমরা কীভাবে যাচাই করব। কে যাচাই করবে?

পত্রিকা ভুল করলে, ভুল তথ্য ছাপালে সংশোধনী প্রকাশ করে। প্রথম আলো নিজেদের ভুলের সংশোধনী প্রকাশ করেছে দ্রুত সময়ের মধ্যে। বাংলাদেশে সরকারের ভুল স্বীকারের প্রবণতা কেমন?

সরকারি তথ্যের উৎস না জানলেও আমরা তাদের এই ধরনের বক্তব্যের পেছনের উৎসাহটা কী, তা জানি। তাদের উৎসাহে উৎসাহিত অনেক একমুখী গণমাধ্যমকেও আমরা চিনি।

প্রথম আলো ২৬ মার্চ একটি অনলাইন প্রতিবেদন করে। সেই প্রতিবেদন থেকে একটি ফটোকার্ড বানানো হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য। সেখানে মূল প্রতিবেদনে থাকা একটি ছবি ও একজনের উদ্ধৃতি যুক্ত করা হয়। ছবি ও উদ্ধৃতি আলাদা আলাদা দুজনের। কিন্তু ছবি ও উদ্ধৃতি দুটিই একজনের মনে হতে পারে বলে বিভ্রান্তির সুযোগ থাকায় ফটোকার্ডটি প্রথম আলো দ্রুত ফেসবুক থেকে তুলে নেয়। সেই উদ্ধৃতিতে কোনো ভুল ছিল না। বাংলাদেশের বাজারের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বানোয়াট কোনো কিছুও সেখানে বলা হয়নি। শুধু একজন সাধারণ মানুষের সাধারণ প্রতিক্রিয়া তারা প্রকাশ করেছে। তাও সাধারণ ভাষায়।

আমরা এরপরে সরকার বাহাদুরের প্রতিক্রিয়া দেখেছি। এমন প্রতিক্রিয়া আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু এ নিয়ে কিছু গণমাধ্যমের ভূমিকা অভূতপূর্ব। সাংবাদিকতার কোনো সংজ্ঞায় তা সংজ্ঞায়িত করা যাবে বলে মনে হয় না। একটি টিভি চ্যানেল প্রতিবেদনের সেই শিশুকে খুঁজে বের করেছে। ক্যামেরায় ফোকাস করে দেখিয়েছে, সেই পরিবারের ধার করা টাকায় কেনা টিভি ও খাট। উল্লেখ করেছে সেই শিশুর বাবার পেশা। এমনকি সে কোন জুতা পরে বিদ্যালয়ে যায়, তা–ও আমরা দেখেছি। অথচ এই শিশুর আর্থিক অবস্থা নিয়ে কিন্তু প্রথম আলোর প্রতিবেদনে কোনো আলোচনাই হয়নি। সেই টিভি চ্যানেল তাদের প্রতিবেদনটি করার সময় সাংবাদিকতার নীতি মেনে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখার বিষয়টিও মেনে চলেনি। অথচ কোনো বানোয়াট বা ভিত্তিহীন প্রতিবেদন না করেও প্রথম আলোর প্রতিবেদক এখন কারাগারে। সম্পাদকের বিরুদ্ধে করা হয়েছে মামলা।

একটি ফটোকার্ডের কারণে এই ধরপাকড় কেন? কেন এই মামলাবাজি? এর উত্তর আমরা জানি। কিন্তু এভাবে চলার পরিণতি কী? এভাবে চলতে দিলে তার শেষটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?

উত্তরটা একটু ঘেঁটে দিচ্ছি। গত ৩০ মার্চ গার্ডিয়ান একটা সংবাদ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, ব্রিটেনের মানুষ নিজেদের সরকারের চাইতেও বেশি আস্থা রাখে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ওপর। না, এই খবর ছাপানোর দায়ে কাউকে দেশদ্রোহীর মামলা দিয়ে জেলে পুরে দেওয়া হয়নি। কারণ, কোনো মনগড়া তথ্য থেকে তারা এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। তাদের তথ্যসূত্র ওয়ার্ল্ড ভ্যালু সার্ভে। এই সার্ভেতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। তা হলো মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষের গণমাধ্যমের ওপর আস্থা আছে। যুক্তরাজ্যের চেয়ে এই ক্ষেত্রে খারাপ অবস্থায় আছে মিসর (আট শতাংশ)।

গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাজ্যের গণতান্ত্রিক সরকারের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আস্থা কমে গেছে গণমাধ্যমের ওপর থেকেও। কারণ, যুক্তরাজ্যে মোটাদাগে মোটামুটি সব মিডিয়া হাউসেরই রাজনৈতিক পরিচয় আছে। বিবিসির বর্তমান চেয়ারম্যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে অর্থঋণ পেতে সাহায্য করেছিলেন। এসব কারণে মানুষের আস্থা কমে মোটামুটি একনায়কতন্ত্রে চলা দেশ মিসরের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকছে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশে কি আমরা এ রকমটা চাই? আমরা কি চাই, সরকারব্যবস্থার ওপর থেকে আস্থা উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আস্থা উঠে যাক আমাদের সংবাদমাধ্যম থেকেও? তাহলে দেশের মানুষ কার আশ্রয়ে দাঁড়াবে?

গণতান্ত্রিক দেশের মূল সম্পদ হচ্ছে তার স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকার সহনশীলতা এবং নিরপেক্ষতার অবস্থান হারিয়েছে বহুদিন হলো। এখন চোখ পড়েছে বেসরকারি ব্যবস্থার ওপর। অন্য অনেক সংস্থার মতো একটি পত্রিকা দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শেষ আশাটুকু বাঁচিয়ে রাখতে লড়ে যাচ্ছে। পত্রিকাটি প্রথম আলো। পত্রিকাটি আপনার পছন্দ না হতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার সঙ্গে এর সম্পর্ককে আপনি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারবেন না।

আরও পড়ুন

আমি আমার শুরুর প্রশ্নেই ফেরত আসতে চাই। একজন দিনমজুর তাঁর খাদ্যের স্বাধীনতা চেয়েছেন। শুনে মনে হতে পারে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশি। কথা হলো, এটা কি মিথ্যা? স্বাধীনতার সঙ্গে খাদ্যের সম্পর্ক কি নতুন কিছু? শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা তুমি মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী। ... স্বাধীনতা তুমি, চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।’ এখন খেতে না পেয়ে সেই মজুরের গ্রন্থিল পেশি যদি শুকিয়ে আসে, তবে তিনি কি মিথ্যা বলবেন? চা-খানায় আর মাঠে–ময়দানে সরকার সাধারণ সংলাপ বিনিময়ের সুযোগ দিচ্ছে না। এটা তো সত্য। তাই এমন কবিতা লেখার দায়ে শামসুর রাহমানকে কি মরণোত্তর জেল প্রদান করা হবে? এমনকি কাব্য করে সুকান্তও লিখেছেন : ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। তবে কি এই কবিতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে? সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা একটি কার্ডের ভুল নামকে নিয়ে ভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। অথচ আসল প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। একজন দিনমজুরের ক্রয়ক্ষমতা কি বেড়েছে? তিনি কি স্বাধীনভাবে খেতে পারেন? প্রথম আলো কি সেই দিনমুজরকে দিয়ে মিথ্যা বলিয়েছে?

প্রথম আলোর বিরুদ্ধে যা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তার পুরো প্রক্রিয়াটাই রাজনৈতিক। তাই এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চাই, স্টিভেন ডি লেভিট এবং স্টিফেন জে ডুবনার তাঁদের ‘থিংক লাইক আ ফ্রিক’ বইয়ে বলেছেন: রাজনীতিকরা যখনই ভুল-শুদ্ধর মানদণ্ডে বিচার করে কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তখন প্রথমেই যাকে হত্যা করা হয়, তার নাম সত্য।

  • রিনভী তুষার লেখক এবং গবেষক
    ই-মেইল: [email protected]