গায়েবি মামলার গায়েবি ককটেল

মাগুরায় বিএনপির লোকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগটি ভয়াবহ। কয়েক দিন আগে তাঁরা নাকি তাঁদের সমাবেশ থেকে পুলিশকে হত্যা ও গাড়ি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে ককটেল ছুড়ে মেরেছেন। এই অভিযোগে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে, অজ্ঞাতনামা আসামি করেছে ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে।

এ ধরনের অন্য অনেক মামলার মতো এটিও দায়ের করা হয়েছে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫ ধারায় ও ১৯০৮ সালের বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের ৪ ও ৫ ধারায়। দোষী সাব্যস্ত হলে প্রথম আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, দ্বিতীয়টিতে ২০ বছরের কারাদণ্ড। দোষ বিচার অবশ্য পরের কথা, এসব মামলায় শুধু গ্রেপ্তার হলেই জেলে থাকতে হবে কয়েক বছর পর্যন্ত। কারণ, এগুলো জামিন অযোগ্য অপরাধ এবং রাজনৈতিক কারণে করা হয় বলে এসব মামলায় জামিন পাওয়ার নজির নেই বললেই চলে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি জেনেশুনে এসব কাজ কেন করে চলেছে? তাদের সমাবেশটি কি আদৌ হয়েছিল? ককটেল কি আদৌ ছুড়ে মারা হয়েছিল? প্রথম আলোর প্রতিনিধি মাগুরার কথিত ঘটনাস্থলের দোকানদার ও হোটেল কর্মচারী এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে গিয়ে শোনেন, পুলিশের এজাহারে বর্ণিত দিনে এমন কোনো সমাবেশ হয়নি; ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেনি। (অবরোধ, ককটেল হামলা হয়নি, মামলা হয়েছে, প্রথম আলো ৮ আগস্ট, ২০২৩)।

আরও পড়ুন

এমন ঘটনা নতুন নয়। এ বছরের ২২ জুলাই ‘নির্বাচনের আগে এবারও গায়েবি মামলা’ শিরোনামে প্রথম আলোতে আসাদুজ্জামানের একটি রিপোর্ট ছাপানো হয়। সেখানে বলা হয়, গত বছর নভেম্বর মাস থেকে এ বছরের মে মাসে শুধু ঢাকা মহানগরে এ ধরনের ৫০টি মামলা হয়, যেখানে বিএনপির ১ হাজার ৭০১ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ২ হাজার ৫৭৫ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। নাশকতা ও ককটেল বিস্ফোরণের এ ধরনের ১৭টি মামলা সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদক দেখেন, ১৫টি ক্ষেত্রেই স্থানীয় লোকজন বলেছেন যে পুলিশ বা আওয়ামী লীগের ওপর হামলা বা ককটেল বিস্ফোরণের কোনো ঘটনা তারা দেখেননি বা শোনেননি। দুটি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু কে বা কারা করেছেন তা এলাকাবাসী বলতে পারেননি।

এসব মামলায় উল্লিখিত ঘটনাগুলো এমন সাজানো বা বানানো হয়ে থাকে বলে এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে ‘গায়েবি মামলা’। ঘটনা যে সাজানো, তার আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায় এসব মামলায় মৃত, কারাবন্দী বা বিদেশে থাকা ব্যক্তিদের আসামি করার বহু নজির থেকে। গায়েবি মামলার ওপর বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে এমনকি এ–ও দেখা গেছে যে মামলায় আহত হিসেবে বর্ণিত ব্যক্তি বলেছেন, তিনি আসলে আহত হননি বা বাদী বলেছেন তিনি আসলে কারও নির্দেশে মামলা করেছেন, জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর করা মানুষ বলেছেন, ধরিয়ে দেওয়া কাগজ না দেখেই তিনি তাতে স্বাক্ষর করেছেন।

গায়েবি মামলার এসব তেলেসমাতি আমরা সবাই মোটামুটি জানি। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, এসব মামলার দুটি বিশেষ দিক আমাদের আরও নজরে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, ১. এর সঙ্গে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন ও মানুষের ভোগান্তির বিষয়টি; ২. এর সঙ্গে ভুয়া বা কারচুপির নির্বাচনের সম্পর্কটি।

রাজনৈতিক চরিত্রের গায়েবি মামলা শুধু বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হয় বলে এসব মামলা সুষ্ঠু নির্বাচনের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে ওঠে। কোনো এলাকায় এ ধরনের মামলা দায়েরের পর গ্রেপ্তার ও কারাবাস–আতঙ্কে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা এলাকাছাড়া হয়ে পড়লে নির্বাচনে কারচুপি প্রতিরোধের সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায়।

২.

গায়েবি মামলায় ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগ যুক্ত করে এটিকে মৃত্যুদণ্ড বা ২০ বছরের কারাদণ্ডের শাস্তিসম্পন্ন করা হয় মূলত অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের আতঙ্কে রাখার জন্য। এই আতঙ্কে এলাকাছাড়া হয়ে বহু মানুষের ব্যবসা ও চাকরি ধ্বংস হয়ে যায়, প্রবাসীরা বছরের পর বছর দেশে আসতে পারেন না এবং তাঁদের পরিবারগুলো অবর্ণনীয় সমস্যায় পতিত হয়। আবার গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার হলে জামিনের জন্য ছোটাছুটি করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয় কিছু পরিবার। এসব ভোগান্তির মাধ্যমে আমাদের সংবিধানে বর্ণিত বহু মানবাধিকারের (যেমন: চলাচল, সমাবেশ ও সংগঠনের এবং আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার) গুরুতর লঙ্ঘনের শিকার হন তারা।

গায়েবি মামলায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে পারে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখিত অভিযুক্ত ছাড়াও যেকোনো মানুষের। এসব মামলায় অনিবার্যভাবে অজ্ঞাতনামা বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। ফলে মামলার তদন্তকালে যেকোনো ব্যক্তিকে এই মামলার আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় বা কোনো রাজনৈতিক কর্মীকে আটকের পর তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকলেও ওই ধরনের কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর সুযোগ থাকে। মামলাগুলোতে বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতনামা আসামি রাখার কারণে এসব মামলায় গ্রেপ্তারের আতঙ্ক হয়ে ওঠে আরও সর্বগ্রাসী।

আরও পড়ুন

রাজনৈতিক চরিত্রের গায়েবি মামলা শুধু বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হয় বলে এসব মামলা সুষ্ঠু নির্বাচনের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে ওঠে। কোনো এলাকায় এ ধরনের মামলা দায়েরের পর গ্রেপ্তার ও কারাবাস–আতঙ্কে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা এলাকাছাড়া হয়ে পড়লে নির্বাচনে কারচুপি প্রতিরোধের সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায়।

আমরা তাই বলতে পারি, গায়েবি মামলার চূড়ান্ত লক্ষ৵ হচ্ছে, একতরফা ও কারচুপির নির্বাচনকে সহজসাধ্য করা। এ কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সারা দেশে হাজার হাজার গায়েবি মামলা দায়ের হতে দেখা যায়। ২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে দায়ের করা একটি রিটের আবেদন অনুসারে সে বছর শুধু সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ২০ দিনে দেশের বিভিন্ন থানায় বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩ হাজার ৭৩৬টি গায়েবি মামলা দায়ের করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব মামলায় আসামি করা হয় ৩ লাখ ১৩ হাজার ১৩০ জনকে; আর অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় কয়েক হাজার মানুষকে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত গত এক মাসের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে এবারও সে রকম আলামত দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

আরও পড়ুন

৩.

আমরা যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা রাখি, তাহলে আমাদের অবশ্যই গায়েবি মামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এর জন্য দায়ী পুলিশ ও অন্যদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গায়েবি মামলায় সিস্টেম্যাটিকভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটে বলে এটি বন্ধে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে উচ্চ আদালতের ভূমিকা রাখার অবকাশ রয়েছে।

দুঃখজনক বিষয়টি হচ্ছে, গায়েবি মামলার ওপর বহু প্রামাণ্য সংবাদপত্র প্রতিবেদনের পরও এটি বন্ধ করার কোনো পদক্ষেপ রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান নেয়নি। ২০১৮ সালে হাইকোর্টে বিষয়টি আটকে যায় একটি বেঞ্চে জুনিয়র বিচারকের আদেশের কারণে। এরপর আর গায়েবি মামলা বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কোথাও, এসব মামলার প্রকোপ অব্যাহত থাকার পরও। গায়েবি মামলা আমাদের অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। না হলে এসব মামলায় গায়েবি ককটেলের বিস্ফোরণ হতে থাকবে অব্যাহতভাবে। এতে বিপর্যস্ত হবে শুধু আসামির জীবন আর জীবিকা নয়, এ দেশে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের সম্ভাবনাও।

  • আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক